মায়ের মতো সম্পদ দ্বিতীয়টি আর নেই

প্রকাশ | ০৭ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ২১:৫৭

মো. রিয়াজুল ইসলাম
প্রতীকী ছবি

মা, পৃথিবীর সবচেয়ে আকর্ষণীয়, মধুর ও হৃদয় জুড়ানো শব্দ। মহান আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিনের সবচেয়ে উৎকৃষ্ট সৃষ্টি ও উপহার হচ্ছে মা। মা, নামের প্রিয় মানুষটির জন্যই পৃথিবীতে আমরা আলোর মুখ দেখেছি। মা, শব্দটির সঙ্গেই আমাদের প্রথম পরিচয়,  মনের প্রথম মিতালি। পৃথিবীর সব লোকের দোয়া ও শুভেচ্ছা বিফলে গেলেও মায়ের দোয়া কখনো বিফলে যায় না, এই কারণে বলা হয় মায়ের দোয়া পৃথিবীর সবচেয়ে উচ্চমাত্রার দোয়া। যে ব্যক্তির মা আছে তার সব আছে। যে ব্যক্তির মা জীবিত থাকার পরও মায়ের দোয়া, ভালোবাসা ও স্নেহ নিতে পারলো না, তার মতো অভাগা পৃথিবীতে আর নেই।

মুঘল সম্রাট জহির উদ্দীন মুহাম্মদ বাবরের ঘটনাটি হয়তো অনেকেই জানেন। ১৫২৬ সালে পানিপথের প্রথম যুদ্ধে তিনি ইব্রাহীম লোদীকে পরাজিত করে ভারতে মোঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন। ইব্রাহীম লোদী পরাজিত হলে তাঁর অসংখ্য সৈন্যর সাথে লোদীর আম্মাজানও সম্রাট বাবরের সৈন্যর হাতে ধরা পড়েন। সম্রাট বাবর ছিলেন উদার ও দয়ালু, তিনি পরাজিত শত্রুর ‘মা, কে রাজ অন্তঃপুরে থাকার সুব্যবস্থা করে দেন। সম্রাট বাবরের পরম আদর যত্ন পেয়েও ইব্রাহীম লোদীর ‘মা, তার ছেলে হত্যার প্রতিশোধ নেয়ার জন্য অস্থির হয়ে ওঠেন। রাজ অন্তঃপুরে থাকার সুবাদে প্রথম সুযোগেই তিনি সম্রাটকে বিষ খাইয়ে মারার চেষ্টা করেন। ভাগ্যক্রমে সম্রাট বেঁচে যান এবং ইব্রাহীম লোদীর মায়ের এই অপকর্ম জানতে পারেন। রাজসভার মন্ত্রিবর্গ যখন ইব্রাহীম লোদীর মায়ের বিচার দাবি করেছিল তখন সম্রাট বাবর তাদের যা বলেছিলেন তা পৃথিবীর সকল মায়ের জন্য সম্মানের, তিনি বলেছিলেন ‘মায়েদের কোনো দোষ নেই, অপরাধ নেই, তারা নিষ্পাপ ও নিরাপরাধী’।

বিশ্বের পাপী-তাপী, ভালো-মন্দ সব শ্রেণির মানুষ তাদের মায়ের কাছে বড় আদরের, স্নেহের ও ভালোবাসার। পৃথিবীতে মা, তার সন্তানের জন্য যত ত্যাগ স্বীকার  করতে পারেন আর কেউ তা করতে পারেন না। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ আজাদ ও তার মায়ের ঘটনাটি কথা সাহিত্যিক আনিসুল হকের ‘মা’ উপন্যাসটি পাঠ করলে জানা যায়।  ১৯৭১ সালে আজাদকে পাক হানাদার বাহিনী ধরে নিয়ে বন্দিশিবিরে রেখে খুব অত্যাচার করেছিল। একদিন আজাদের মা, আজাদের সাথে বন্দিশিবিরে দেখা করতে গিয়েছিলেন, আজাদ মাকে কাছে পেয়ে বলেছিলো ‘মা, আমি দুদিন ভাত খাইনি! তুমি আমাকে ভাত রান্না করে খাওয়াবে? আজাদের মা পরের দিন ছেলের জন্য ভাত রান্না করে নিয়ে গিয়ে আর ছেলেকে পাননি সেই থেকে তিনি যতদিন জীবিত ছিলেন (প্রায় ১৪ বছর) ততদিন আর ভাত খাননি! কী অসাধারণ, করুণ ও হৃদয় বিদারক ঘটনা! একজন ‘মা, ছাড়া পৃথিবীতে আর কারও দ্বারা এমন উদাহরণ সৃষ্টি করা সম্ভব নয়!!

আমার পরিচিত একজন মহৎ ও উদার মনের সমাজতাত্ত্বিককে  দেখেছি যিনি প্রতিদিন সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে সর্বপ্রথম মায়ের সাথে মোবাইলে কথা বলেন, মায়ের দোয়া ও আশির্বাদ নিয়ে দিন শুরু করেন। তিনি সব সময় গর্ব করে বলেন ‘আল্লাহর রহমতে আমার জীবনের বড় বড় অর্জন সম্ভব হয়েছে আমার মায়ের দোয়া ও আর্শিবাদের কারণে’। পৃথিবীতে মায়ের দোয়া যার সাথে আছে তার সামনে কোনো কিছুই বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না, সে ভেঙে ফেলতে পারে সকল দুর্দশার চক্র, গড়ে তুলতে পারে সফলতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। মায়ের প্রতি যাদের অশেষ শ্রদ্ধা, ভক্তি ও ভালবাসা রয়েছে তাদের কোনো ভয় নেই, সংকোচ নেই, তারা জীবনে সফল হবেই, তাদের কাছে সকল দুঃখ, যন্ত্রনা, বেদনা পরাজিত, নিষ্প্রাণ ও নির্জীব। মায়ের হাসি বিশ্বে অমূল্য সম্পদ, মায়ের একচিলতে ভুবন ভোলানো হাসিতে যার হৃদয় আনন্দে উদ্বেলিত হয়, মনে সৃষ্টি হয় প্রাণ-চাঞ্চল্য সেই প্রকৃত মানুষ তাঁর আত্ম অমর, তাঁর সৃষ্টি সীমাহীন সুখের, মহা-আনন্দের।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন বলেছিলেন ‘যার মা আছে সে কখনোই গরিব নয়’। মা, হচ্ছেন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় শিক্ষক ও পদ প্রদর্শনকারী। সাংবাদিকরা একবার একটি অনুষ্ঠানে জর্জ ওয়াসিংটনকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন ‘আপনার কাছে সবচেয়ে সুন্দরী মহিলা কে? তিনি উত্তরে বলেছিলেন ‘আমার দেখা সবচেয়ে সুন্দরী মহিলা আমার মা, আমার জীবনের সমস্ত অর্জন তাঁরই কাছ থেকে পাওয়া’। যার মা জীবিত আছে তাঁর কোন পীর মাশায়েক, দরবেশ-হুজুর দরকার নেই, তাঁর কাছে মাতাই সবচেয়ে বড় পীর, বড় নেয়ামত।

কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ বলেছেন ‘মা হলো পৃথিবীর একমাত্র ব্যাংক, যেখানে আমরা আমাদের সব দুঃখ, কষ্ট জমা রাখি এবং বিনিময়ে নেই বিনাসুদে অকৃত্রিম ভালোবাসা।’ মা-বাবা সন্তুষ্ট হলে মহান আল্লাহ্ তায়ালা সন্তুষ্ট হোন। আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন ‘পিতা-মাতার সন্তুষ্টিতে আল্লাহ্ সন্তুষ্ট হোন, আর পিতা-মাতার অসন্তুষ্টিতে আল্লাহ্ অসন্তুষ্ট হোন (তিরমিযী)। প্রিয়নবী (সা) আরও বলেছেন ‘জান্নাত মায়ের পদতলে (মুসলিম)। যে ব্যক্তি মায়ের সাথে ভালো আচরণ করবে, মায়ের দোয়া নেবে, সৎ কাজ করবে নিশ্চয় তিনি শান্তিতে থাকবেন, সকল বিপদ থেকে রক্ষা পাবেন।

মাকে ভালোবাসার ও ভক্তি করার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। কলকাতা থাকাকালীন সময়ে একদিন তিনি শুনলেন তাঁর মা খুব অসুস্থ। তিনি মায়ের অসুস্থতার কথা শুনেই রওনা দিলেন মাকে দেখতে, পথে ঘটলো বিপত্তি, উত্তাল দামোদর নদী পার হওয়ার জন্য কোনো লঞ্চ কিংবা নৌযান পেলেন না, কিন্তু যে করেই হোক তিনি মায়ের কাছে যাবেন এই প্রতিজ্ঞা করে বসলেন, তাই নির্ভয়ে প্রচণ্ড বর্ষার রাতে উত্তাল দামোদর নদী সাঁতরে তিনি অসুস্থ মায়ের কাছে ছুটে গেলেন। পৃথিবীতে মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা, ভালোবাসার এমন মহৎ ও উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত বিরল। মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভক্তির কারণেই তিনি হয়েছিলেন বিদ্যাসাগর। ঢাকা সিটির প্রয়াত মেয়র আনিসুল হক এক বক্তৃতায় বলেছিলেন ‘তিনি জীবনে বড় ব্যবসায়ী হয়েছেন, সফলতা অর্জন করেছেন তার মায়ের দোয়ার কারণে’ তাঁর বিভিন্ন বক্তৃতায় ও কাজে মায়ের প্রতি গভীর ভালবাসার প্রমাণ পাওয়া যায়।

মহাগ্রন্থ আল্ কোরআনে মহান রাব্বুল আলামিন মা-বাবার প্রতি উত্তম আচরণের নির্দেশ দিয়েছেন। মহান আল্লাহ্ বলেন ‘আর তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো, তাঁর সঙ্গে কাউকে শরিক কোরো না এবং পিতা-মাতার সঙ্গে সুন্দর আচরণ করো’ (সুরা-৪ নিসা, আয়াত-৩৬)। পবিত্র কোরআনের এই বাণী থেকে সহজেই অনুধাবন করা যায়, আল্লাহ্ পাকের পরেই মা-বাবার অধিকার। মায়ের উদর থেকেই জন্ম হয়েছে একজন প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.), একজন যিশু খ্রিষ্ট, গৌতম বুদ্ধ কিংবা একজন মহাত্ম গান্ধীর। মায়ের কারণেই পৃথিবী সুন্দর, মনোরাম ও বসবাস উপযোগী। মায়ের মতো বড় সম্পদ পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি আর নেই। মায়ের আদর, স্নেহ, ভালোবাসা অকৃত্রিম ও নির্ভেজাল। মায়ের মুখের হাসি কোটি টাকা দিয়েও ক্রয় করা  যাবে না, এ সম্পদ ক্রয় করা যায় না। মাকে ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা করার মধ্যেই পৃথিবীর সকল সুখ, শান্তি ও নির্মল আনন্দ নিহিত।

লেখক: প্রভাষক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ; জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়; ত্রিশাল, ময়মনসিংহ।