বঙ্গবন্ধু মেডিকেলে ‘অমানবিক লাইন’

প্রকাশ | ০৮ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ০৮:৩১ | আপডেট: ০৮ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ২০:৫৯

জহির রায়হান, ঢাকাটাইমস

বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে আল্ট্রাসাউন্ড পরীক্ষা করাবেন রাজধানীর শনির আখড়ার সালমা আক্তার। ভোর ছয়টায় এসে লাইনে দাঁড়িয়েছেন সিরিয়ালের জন্য। কিন্তু সেদিন পরীক্ষা করাতে পারলেন না। কারণ, এক দিনে যতজনের পরীক্ষা করা হবে ততজন রোগী তার আগে লাইনে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলেন।

তিন ঘণ্টা দাঁড়িয়ে অবর্ণনীয় কষ্টের পর সালমা জানতে পারেন, তার পরীক্ষা হবে না। পরে হাসপাতালের কর্মীদের কাছে জানতে পারেন, আরও আগে লাইন না ধরলে পরীক্ষার সিরিয়াল পাবেন না।

সেই পরামর্শ মেনে পরদিন লাইনে দাঁড়ালেন সালমা এবং তিনি সিরিয়ালও পেয়েছেন। কিন্তু এ জন্য তাকে হাসপাতালে এসে দাঁড়াতে হয় প্রতিষ্ঠানটি খোলার পাঁচ ঘণ্টা আগে, অর্থাৎ রাত তিনটায়। অসুস্থ শরীরে এটি এক অসহনীয় কষ্ট।

বৃহস্পতিবার সকালে হাসপাতালে গিয়ে কথা হয় এই নারীর সঙ্গে। ঢাকা টাইমসকে তিনি বলেন, ‘রাত তিনটায় এখানে এসে লাইন ধরেছি। তাই নারীদের লাইনে সবার আগে আমি।’

আগের দিনের অভিজ্ঞতা ও ভোগান্তির বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, ‘গতকাল ভোর ছয়টায় এসে লাইন ধরেও আল্ট্রাসনোগ্রাম পরীক্ষা করাতে পারিনি। আজ রাত তিনটায় শুধু আমি লাইন ধরিনি, আরও অনেকে আল্ট্রাসনোগ্রাম পরীক্ষার রশিদের জন্য লাইন ধরেছে।’

এই লাইনই শেষ কথা নয়। সিরিয়াল পেয়ে টাকা জমা দিতে ব্যাংকের বুথে গিয়ে আবার লাইনে দাঁড়াতে হয় সালমাকে। সেখানে সময় তুলনামূলক কম লাগলেও এই দুর্ভোগ এড়ানো যেত প্রথম সিরিয়াল দেওয়ার সময় সেখানেই টাকা নেয়ার সুযোগ থাকলে।

বেসরকারি হাসপাতালগুলোর তুলনায় সরকারি হাসপাতালে রোগ পরীক্ষার ফি যেমন কম, তেমনি এর মানও তুলনামূলক ভালো। তাই বঙ্গবন্ধু মেডিকেলে পরীক্ষার জন্য আগ্রহ বেশি মানুষের। আর এই অতি আগ্রহ রোগীদের জন্য তৈরি করেছে ভোগান্তি। বিভিন্ন বিভাগে একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক রোগীর পরীক্ষা করা যায়। আর ততজনকেই দেওয়া হয় সিরিয়াল। যারা সিরিয়াল পান না, তাদের পরের দিন নতুন করে ধরতে হয় লাইন। আর তাই এই সিরিয়ালের জন্য রাতদুপুরে এসে লাইন ধরার দৃশ্য ধরা পড়ে দেশের প্রথম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালটিতে। আর এই বিষয়টি অমানবিক বলছেন রোগীরা। কিন্তু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ভিন্ন কোনো উপায়ের সন্ধান করছে না।

এই হাসপাতালে প্রতিদিন ৩৫০ থেকে ৪০০ জনের আল্ট্রাসাউন্ড পরীক্ষা করা হয়। কিন্তু রোগী আসে তার চেয়ে অনেক বেশি। আর তাদের বড় একটা অংশ কয়েক ঘণ্টা অপেক্ষার পর জানতে পারে সেদিন তাদের পরীক্ষা করা হবে না।

হাতের টিউমারের চিকিৎসার জন্য বরিশাল থেকে ঢাকায় এসেছেন আসাদুর রহমান। উঠেছেন যাত্রাবাড়ীতে। সকাল সাতটায় এসে লাইন ঠেলে টিকিট সংগ্রহ করে ডাক্তার দেখালেন। চিকিৎসক রক্ত পরীক্ষা ছাড়াও আল্ট্রাসাউন্ড পরীক্ষা দিয়েছেন। সকাল ৯টার দিকে এই পরীক্ষা করাতে এসে জানতে পারেন, আজ হবে না। ফরম পাওয়া যাবে না। পরদিন ভোর ৫টায় লাইন ধরতে পারলে হবে।

পরদিন ভোর ৫টায় লাইন ধরে বেলা ১১টার দিকে সিরিয়াল পেয়ে পরীক্ষা করান। দুপুর ২টার দিকে রিপোর্ট হাতে পান। কিন্তু ততক্ষণে চিকিৎসককে রিপোর্ট দেখানোর সময় শেষ। বৈকালিক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দেখাবেন, সেই সুযোগও নেই। কারণ এই টিকিট কাটতে হলেও লাইনে দাঁড়াতে হতো সকালে।

আসাদুর রহমান বলেন, ‘এটা অমানবিক। পরীক্ষা করতে রাত থেকে লাইনে ধরতে হয়। অনেক সময় এমন হয় পাঁচ ঘণ্টার বেশি লাইনে দাঁড়িয়ে থাকার পর জানানো হয় আজকের মতো টিকিট শেষ, আগামীকাল আসুন। আগামীকাল আবার একইভাবে লাইনে দাঁড়াতে হবে। সেদিন যে টিকিট পাবে তার নিশ্চয়তাও নেই।’

বৃহস্পতিবার হাসপাতালের ‘এফ ব্লকের’ রেডিওলজি ও ইমেজিং বিভাগের গেটের বাইরে ভোর ৫টায় দেখা যায় প্রায় ১০০ মানুষের লাইন। সেখানে রসিদ দেওয়া শুরু হবে সকাল ৮টায়।

গুলিস্তান থেকে এসেছেন সবুজ মিয়া। পুরুষ রোগীদের লাইনে সবার সামনে ছিলেন। বলেন, ‘রাত ৩টায় এখানে এসে লাইন ধরেছি। কিছু করার নেই। একটু ভোর হলেই লোকে লোকারণ্য হয়ে যায়। তখন তো শত শত লোকের পেছনে পড়তে হবে।’

নরসিংদী থেকে আসা মাসুম মিয়া বলেন, ‘গত (বুধবার) এসে আল্ট্রাসনোগ্রাম পরীক্ষা করতে পারিনি। সকাল ৭টায় এসেছিলাম। আজ (বৃহস্পতিবার) ভোর ৫টায় রওয়ানা দিয়ে এসেছি। আজও ৭টা বেজে গেল আসতে আসতে। জানি না পরীক্ষা করাতে পারব কি না।’

জানা যায়নি মাসুম মিয়া দ্বিতীয় দিন সিরিয়াল পেয়েছেন কি না। তবে এটা জানা গেল বঙ্কিমচন্দ্র নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ থেকে টানা চার দিন এসেও পরীক্ষা করাতে পারেননি। ঢাকা টাইমকে তিনি বলেন, “হাসপাতালে আসতে আসতে সাড়ে ৭টা বেজে যায়। আর পরীক্ষা করাতে পারি না। লাইন ধরে থাকি কয়েক ঘণ্টা। এক দিন এমন হলো লাইনে আমার সামনে পাঁচজন ছিল। তখন বলা হলো, ‘রসিদ শেষ’। গুলিস্তান থেকে আজকে (বৃহস্পতিবার) ভাইয়ের ছেলেকে আসতে বলেছি। সে এসে ভোর ৫টায় লাইন ধরে রশিদ নিয়েছে। এরপর সেই রশিদ নিয়ে লাইন ধরে আবার ব্যাংকের বুথে টাকা জমা দিয়েছি। তারপর ঘণ্টা দুই বসে থেকে আল্ট্রাসনো করেছি। বেসরকারি হাসপাতাল থেকে পরীক্ষা করাতে পারতাম, কিন্তু এখানের মেশিন নাকি খুবই উন্নত তাই এখানে আসলাম।”

একই চিত্র দেখা যায় এমআরআই পরীক্ষায়। সেখানে দিনে পরীক্ষা করা হয় ১৫ থেকে ২০টা। কিন্তু রোগী আসে কয়েক গুণ। আর রসিদ শেষ হয়ে না যাওয়ার আগে কাউকে বলা হয় না ‘আজ হবে না’।

যেভাবে কমানো যায় ভোগান্তি

আগারগাঁওয়ের নিউরো সায়েন্স হাসপাতালে কেউ পরীক্ষা করাতে গেলে সঙ্গে সঙ্গে না হলে যেদিন সিরিয়াল হবে, সেদিনের তারিখ এবং সময় দিয়ে দেওয়া হয়। সেদিন সকাল ৮টায় হাসপাতাল খুললে তখন এসে টাকা জমা দিয়ে পরীক্ষা করা যায়। কিন্তু বঙ্গবন্ধু মেডিকেলে এই ব্যবস্থা নেয়।

নিউরো সায়েন্সের পদ্ধতি বঙ্গবন্ধু মেডিকেলে কেন প্রয়োগ করা হচ্ছে না- জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের রেডিওলজি অ্যান্ড ইমেজিং বিভাগের চেয়ারম্যান (বিভাগীয় প্রধান) ইকবাল হোসেন জানান, এই ভোগান্তি দূর করার উপায় নিয়ে তারাও ভাবছেন। ঢাকা টাইমকে তিনি বলেন, ‘এখানে রোগীর চাপ বেশি। আগে তিনটি মেশিন দিয়ে পরীক্ষা হতো এখন সেটা ১০টি মেশিনে হয়। শিগগিরই আমরা অটোমেশন চালু করব। যাতে রোগী বাড়িতে বসেই পরীক্ষার করার জন্য সিরিয়াল নিয়ে রাখতে পারবেন। এতে তার আর কষ্ট করে লাইন ধরতে হবে না। নির্ধারিত তারিখে পরীক্ষা করার জন্য আসতে পারবে। এতে রোগীদের সময় সাশ্রয় ও লাইনে দাঁড়িয়ে থাকার দুর্ভোগ লাঘব হবে।’

ঢাকাটাইমস/৮সেপ্টেম্বর/এএ/ডব্লিউবি