বিচারে দীর্ঘসূত্রতার এক চক্কর

আশিক আহমেদ, ঢাকাটাইমস
 | প্রকাশিত : ০৮ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ১৪:০৯
ফাইল ছবি

৩১ বছরে শেষ হয়নি পুরান ঢাকার চাঞ্চল্যকর একটি হত্যা মামলার বিচার। এর মধ্যে দেশে সরকার পাল্টেছে ১১টি। বিচারকও পাল্টেছেন ১১ জন। মারা গেছেন ভুক্তভোগীর বাবা, মা। এখন পরিবারে একমাত্র ছোট ভাই বেঁচে আছেন বোন হত্যার বিচারের অপেক্ষায়।

এই মামলার আসামি কেউকেটা কেউ নন। খুবই সাধারণ একজন মানুষ, যাকে পুলিশ একবার গ্রেপ্তারও করেছিল। তবে তার সম্পর্কে বিস্তারিত জানাতেও পারছে না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তার পরেও তিনি জামিন পেয়েছেন এবং এরপর আত্মগোপনে চলে যান। আর আসেননি আদালত পাড়ায়। তার অবস্থান এখন কোথায়, সেই ধারণাও নেই পুলিশের। আর এত বছর পর তাকে দেখলেও শনাক্ত করা যাবে কি না, সেটা নিয়েও আছে প্রশ্ন।

মামলায় পাঁচজনের সাক্ষ্য গ্রহণের পর বাকি কাউকে আর আদালতে আনা যায়নি। যে কারণে বিচার আগায়নি। আর এর ফাঁকে ১০৫ দিন সাক্ষী হাজিরার দিন গেছে। কিন্তু পুলিশ কাউকে আনতে পারেনি।

বিচারের দীর্ঘসূত্রতা নিয়ে বরাবর কথা হয় দেশে। এ নিয়ে সর্বোচ্চ আদালতও নানা সময় প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছে। কিন্তু মামলার পাহাড় জমে আছে দেশের প্রতিটি আদালতে। সব মিলিয়ে ৩১ লাখ মামলার বিচারপ্রত্যাশীরা ঘুরছে প্রতিকারের আশায়। কিন্তু কেবল তারিখ পরে, মামলা আগায় না, এটি এক নিয়মিত চিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে।

কী কী কারণে বিচারে বিলম্ব হতে পারে, তার একটি উদারহণ হতে পারে এই সীমা হত্যা মামলা। এখানে তদন্ত শেষ হয়েছে দ্রুতই। কিন্তু অভিযোগপত্র আদালতে যাওয়ার পর অভিযোগ গঠনে সময় লেগেছে ১৩ বছর। এরপর ১৮ বছরে শেষ করা যায়নি শুনানি। এর কারণ, সাক্ষী উপস্থিত করতে না পারা। পুলিশের কোনো চেষ্টাই চোখে পড়েনি। ময়নাতদন্তকারী একজন চিকিৎসককে আদালতে হাজির করতে না পারা মামলা ঝুলে থাকার প্রধান কারণ। তাকে আদালতে আনতে অর্ধশত গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির তথ্যও মিলেছে। তবু তাকে আনা যায়নি।

খুন, মামলা এবং বিচারের চক্কর

১৯৮৮ সালের ২৬ এপ্রিল সকাল সাড়ে ৯টার দিকে পুরান ঢাকার লালবাগের ১৬৬ জগন্নাথ সাহা রোডের বাড়িতে ঢুকে ছুরিকাঘাতে সীমাকে হত্যা করা হয়। ঘটনায় পর পর লালবাগ থানায় মামলা করেন সীমার মা ইজহার মোহাম্মদী। এতে অভিযোগ করা হয়, সীমাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন আমিন। কিন্তু রাজি ছিল না পরিবার। আর এই আক্রোশে সীমাকে প্রকাশ্যে খুন করেন আমিন।

মামলাটির তদন্তে কোনো জটিলতা ছিল না। ছিল প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী। মাত্র দুই মাসেই প্রতিবেদন দেয় পুলিশ। ওই বছরের ২৫ জুন আমিনকে আসামি করে আদালতে দেওয়া হয় অভিযোগপত্র।

তবে তদন্তে দুর্বলতা ছিল। একমাত্র আসামি হলেও আমিনের পেশা ও পূর্ণাঙ্গ ঠিকানা জানতে পারেনি পুলিশ। অভিযোগপত্রে তার বিষয়ে বিস্তারিত বর্ণনাও নেই। এতে বলা হয়, ‘জামিলের ছেলে আমিন থাকত তার ভগ্নিপতি মাহতাবের ১৪/৮ শাজাহান রোডের বাসায়। তবে আমিন প্রায়ই পুরান ঢাকার উর্দু রোডের একটি বোর্ডিংয়ে রাতযাপন করত। সীমা হত্যার পরদিন থেকে আর ওই বোর্ডিংয়ে সে যায়নি। সেখান থেকে তার ট্রাঙ্ক ও জামাকাপড় উদ্ধার করে পুলিশ।’

মামলাটি বর্তমানে আছেন ঢাকার ‘জননিরাপত্তা বিঘœকারী অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনাল’ এ। নথিপত্র দেখে ট্রাইব্যুনালের একজন কর্মী জানান, আমিন একবার পুলিশের কাছে ধরাও পরেছিলেন। কিন্তু তিনি জামিন পেয়ে যান। পরে আর তাকে ধরা যায়নি। আর জামিন নিয়ে দেওয়া আইনজীবীরাও তার সন্ধান দিতে পারেননি।

আদালতে অভিযোগ গঠনের শুনানিতে আমিন উপস্থিত না হওয়ায় তাকে হাজির করতে ১৯৯৯ সালের ২২ জুন পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তিও দেওয়া হয়। তবু তার সন্ধান মেলেনি।

আসামি আসছেন না বলে অভিযোগ গঠন বা বিচার শুরু হতেও সময় লেগে যায় ১৩ বছর। ২০০১ সালের ২৯ এপ্রিল অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে বিচার শুরু হয় একমাত্র আসামির।

এরপর পাঁচ জনের সাক্ষ্যগ্রহণের পর এক চুল আগায়নি বিচার কাজ। এর ফাঁকে কেটে গেছে আরো ১৮ বছর।

একজনকে গ্রেপ্তারে ৫০ পরোয়ানা

আদালতের একজন কর্মকর্তা এই মামলাটি নিয়ে জানান, তদন্ত কর্মকর্তা ও ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসকের অনীহার কারণে বিচার বারবার পিছিয়েছে। ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের সে সময়ের প্রভাষক আনোয়ার হোসেনকে বারবার তাগাদা দিলেও তিনি আদালতে যাননি।

আদালতের আদেশ উপেক্ষা করায় আনোয়ার হোসেনের বিরুদ্ধে ৫০টিরও বেশি অজামিনযোগ্য গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির তথ্যও মিলেছে। কিন্তু গরজ দেখায়নি পুলিশ। তামিল করা হয়নি একটি পরোয়ানাও।

পুলিশ নিয়ে আসছে না দেখে অন্য পথে চেষ্টা করে আদালত। ওই চিকিৎসককে হাজির করতে নোটিশ পাঠানো হয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বরাবর। কিন্তু অধিদপ্তরও তাকে পাঠাতে পারেনি। পরে আদালতের এক কর্মচারী ব্যক্তিগতভাবেও যোগাযোগ করেন ওই চিকিৎকের সঙ্গে। কিন্তু তিনি আদালতে যাননি।

এরই মধ্যে সরকারি চাকরি শেষ করেছেন আনোয়ার হোসেন। এখন একটি বেসরকারি হাসপাতালে চাকরি করছেন বলে ট্রাইব্যুনালে তথ্য আছে। কিন্তু সেই হাসপাতালের সুনির্দিষ্ট ঠিকানা জানে না তারা। তাই সেখানে সমন পাঠানো যাচ্ছে না।

আদালতের একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘একজন সরকারি চিকিৎসক অবসরে গেলে পুলিশের পক্ষে তাকে খুঁজে বের করা কোনো ব্যাপার না। কিন্তু তাদের মধ্যে কোনো চিন্তাই দেখিনি এই কয় বছরে।’

মেয়ে হত্যার বিচার না পাওয়ার আক্ষেপ নিয়েই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন সীমার বা ও মামরার বাদী ইজহার মোহাম্মদী। মারা গেছেন সীমার বাবাও। পরিবারে একমাত্র সদস্য হিসেবে বেঁচে আছেন সীমার ছোট ভাই। তিনি কোথায় থাকেন, সেই বিষয়টি বহু চেষ্টা করেও বের করা যায়নি।

এর মধ্যে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সরকার, সাহাবুদ্দিন আহমেদের তত্ত্বাবধায়ক সরকার, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে তিনটি করে সরকার এবং আরো তিনটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদ শেষ হয়েছে।

ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসককে গ্রেপ্তারে ৫০টিরও বেশি পরোয়ানা জারির পরও তাকে গ্রেপ্তার না করার বিষয়ে জানতে চাইলে লালবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কে এম আশরাফ উদ্দিন সব শুনে ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘এটা ১৯৮৮ সালের মামলা। এত আগেও ওয়ারেন্ট কোথায় গেছে কীভাবে গেছে আমি বলতে পারব না। অভিযোগ পত্রে পুলিশ হয়ত আসামির ঠিকানা লালবাগ থানায় দিয়েছিল, তাই লালবাগ থানায় আসতে পারে। পরে লালবাগ থানা ভেঙে চকবাজার থানা হয়েছে। ওই গ্রেপ্তারি পরোয়ানা চকবাজার থানাতেও যেতে পারে। সেটা কি আমি বলতে পারব?’

‘আর ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসকের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা যাবে শাহবাগ থানায়। সেটা শাহবাগ থানা পুলিশ বলতে পারবে। শাহবাগ থানার আগে সেটা ছিল রমনা থানার মধ্যে তখনকার ওসি হয়ত বলতে পারতেন কী হয়েছিল।’

এ ব্যাপারে শাহবাগ থানার বক্তব্য অবশ্য পাওয়া যায়নি ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবুল হাসান ফোন না ধরায়। একাধিকবার তার ফোনটি বেজে চললেও তিনি তা ধরেননি।

রাষ্ট্রপক্ষ যা বলছে

প্রকাশ্যে ঘটা একটি হত্যা, যেখানে কোনো জটিলতা নেই, এমন একটি মামলা তিন দশকেও শেষ করতে না পারার বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকার ‘জননিরাপত্তা বিঘœকারী অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনাল’ এরর বিশেষ পিপি আনোয়ার সাদাত শাওন ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘আসামি জামিনে যাওয়ার পর আর আসেনি। তিনি এখন পলাতক। তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। আশা করছি, ওই ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক সাক্ষ্য দিলেই মামলাটি শেষ হবে।’

‘মামলার বাদীর প্রতিও শতবার ওয়ারেন্ট দেওয়া হয়েছে। পরে আমরা জানতে পরেছি তিনি মারা গেছেন। বাদীপক্ষের কোনো আইনজীবী ও তদবিরকারী নেই। আমরা ওয়ারেন্ট দিয়েও সাক্ষী আনতে পারেনি। সাক্ষী পাওয়া যাচ্ছে না।’

বাদীপক্ষে কেউ না থাকায় পরে রাষ্ট্র বাদী হয়েছে এই মামলায়। আসামির সর্বোচ্চ সাজা হতে পারে বলে তার পক্ষে সরকারি খরচে আইনজীবীও নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। মামলায় যত তারিখ পড়ে, তত লাভ আইনজীবীর। কারণ, আদালতে তারিখ পরলেই তিনি পাবেন তারা।

জ্যেষ্ঠ আইনজীবীদের বিস্ময়

সাবেক আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘কোন স্বাক্ষীর কারণে মামলার বিচার আটকে থাকবে এমন কোন আইন নেই। তবে যাদের স্বাক্ষীদের হাজির করা দায়িত্ব তাদের যদি জবাবদিহিতা থাকত তাহলে এতদিনে অবশ্যই স্বাক্ষীকে হাজির করা যেত।’

‘স্বাক্ষীকে হাজির করার দায়িত্ব কাদের ? পুলিশের বা রাষ্ট্রপক্ষের তাদের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো দরকার’- মত দেন সাবেক আইনজীবী।

প্রখ্যাত ক্রিমিনাল লইয়ার খন্দকার মাহবুব হোসেন পুরো মামলাটির চক্করের কথা শুনে অবাক হয়েছেন। ঢাকা টাইমসকে তিনি বলেন, ‘এটি অত্যন্ত দুঃখজনক ব্যাপার। এটা খামখেয়ালিপনা ছাড়া আর কিছু নয়। ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক না আসলে ওই ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনই আদালতে গ্রহণযোগ্য হবে। আপনারা পত্রপত্রিকায় লেখুন। এতে উপকার হবে।’

ঢাকাটাইমস/৮সেপ্টেম্বর/এএ/ডব্লিউবি

সংবাদটি শেয়ার করুন

বিশেষ প্রতিবেদন বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন এর সর্বশেষ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :