ছাত্রলীগে নতুন মডেল হয়নি, উল্টো বেড়েছে বিশৃঙ্খলা

প্রকাশ | ০৯ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ০৮:২৬ | আপডেট: ০৯ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ১৩:১৪

মনিরুল ইসলাম
ফাইল ছবি

ঘোষণা অনুযায়ী বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে নতুন কোনো মডেলে দাঁড় করানো যায়নি। উল্টো সংগঠনটিতে বিপরীত আদর্শের নেতাকর্মীদের অনুপ্রবেশ, স্বজনপ্রীতি, বিতর্কিত কর্মসূচিসহ নানা কারণে সংগঠনে বেড়েছে বিশৃঙ্খলা, হতাশা। পরিস্থিতি এমন যে, খোদ সংগঠনের অভিভাবক আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনা ক্ষুব্ধ। তিনি মেনে নিতে পারছেন না তার ছাত্রজীবনের সংগঠনের এই হাল।

গত বছরের ১১ ও ১২ মে ছাত্রলীগের সম্মেলন হয়। এর প্রায় দেড় মাস পরে ৩১ জুলাই আওয়ামী লীগ সভাপতির সম্মতিক্রমে রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন ও গোলাম রাব্বানীকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়।

১০ মাস পর চলতি বছরের মে মাসে যে পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণার পর পর ছাত্রলীগে দেখা দেয় বিভেদ। পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে অছাত্র, বিবাহিত, ব্যবসায়ী, মাদক সম্পৃক্তরা স্থান পেয়েছে অভিযোগ তুলে বিক্ষোভ দেখায় এক পক্ষ।

ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটিকে মানতে পারছে না একটি পক্ষ। তারা প্রকাশ্যেই বিরোধিতা করছে। কেন্দ্রের নামে কর্মসূচি পালনের পোস্টার করার পরেও বিতর্ক উঠার পর সেটা হয়নি। আর কর্মসূচির দায় দায়িত্ব অস্বীকারও করা হয়েছে কেন্দ্রের পক্ষ থেকে।

কেন্দ্রীয় কমিটির দুই বছরের মেয়াদের আর দশ মাস বাকি থাকলেও এখনো সারা দেশের বেশিরভাগ ইউনিটেরই সম্মেলন আটকা। সংগঠনের নেতৃত্বে ছাত্রদল, শিবির সম্পৃক্তদের স্থান পাওয়া নিয়ে তোলপাড় চলছে। বিতর্কিত হিসেবে ১৯ জনের পদ বাতিলের ঘোষণা এসেছে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে। কিন্তু বিস্ময়কর হলো, তাদের কারো নাম প্রকাশ করা হয়নি। ফলে আদৌ কারও পদ গেছে কি না, এ নিয়ে উঠেছে প্রশ্ন।

ছাত্রলীগের সম্মেলনের আনুষ্ঠানিকতা শুরুর আগে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, এবার ছাত্রলীগ হবে ‘নতুন মডেল’ এর। তবে এখন অবধি স্পষ্ট হয়নি সেই নতুন মডেল কী আর শীর্ষ নেতাদের নানা কর্মকা- নিয়ে তৈরি হয়েছে ক্ষোভ।

দলে নেতৃত্ব নিয়ে কোন্দলের পাশাপাশি ছাত্রলীগের নানা কর্মসূচি নিয়ে সংগঠনের মধ্যেই দেখা দিয়েছে বিভেদ। ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক দর্শনের অনুসারী হলেও ইদানীং ধর্মীয় আবেগ কাজে লাগাতে নানা কর্মসূচির দিকে ঝোঁকার প্রবণতাকে ঘিরে সংগঠনে বিরোধ স্পষ্ট হয়েছে। আর ক্ষুব্ধরা কেউ ‘সর্বদলীয় ছাত্রলীগ’, কেউ ‘শিবির লীগ’, কেউ বা ‘বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রলীগ’ বলে নিজের সংগঠনকে কটাক্ষ করছেন।

এর মধ্যে শনিবার রাতে ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক গণভবনে গেলে তাদেরকে দেখা দেননি প্রধানমন্ত্রী। বলেন বের হয়ে যেতে। রাগ করে কমিটি ভেঙে দেওয়ার কথাও বলেন তিনি।

ছাত্রলীগের কমিটিতে যারা স্থান পেয়েছেন, তাদের বহুজনের বিরুদ্ধে মাদক সম্পৃক্ততার অভিযোগ আনছেন সংগঠনে বিক্ষুব্ধরাও। এই অভিযোগ গেছে শেখ হাসিনার কাছেও। তিনি স্পষ্টতই ক্ষুব্ধ। বলেছেন, ‘আমি ছাত্রলীগের এমন নেতা চাই না... যাদের বিরুদ্ধে মাদকের অভিযোগ পর্যন্ত উঠেছে।’

‘নতুন মডেল’ নিয়ে ধারণা নেই

ছাত্রলীগ নতুন কী মডেল দাঁড় করাল- জানতে চাইলে সংগঠনটির সাংগঠনিক সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনান ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘শেখ হাসিনার স্বপ্ন বাস্তবায়নে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ লালনে বর্তমান ছাত্রলীগ আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি প্রায়োগিক ও বাস্তববাদী। এটাই ছাত্রলীগের নতুন মডেল।’

নতুন মডেল বলতে ধর্মীয় অনুভূতি কাজে লাগানোর চেষ্টা কি না জানতে চাইলে এই নেতা বলেন, ‘এটা একটা মিথ্যা প্রচার। ছাত্রলীগ কোন ধর্ম বিদ্বেষী সংগঠন না। প্রতিটি প্রোগ্রামে আমাদের নির্দেশনা থাকে  মসজিদে দোয়া, মন্দিরে পূঁজা অর্থ্যাৎ সব ধর্মীয় উপসনালয়ে প্রার্থনার আয়োজন করা হবে। প্রেস রিলিজেও এর উল্লেখ থাকে।’

তবে ছাত্রলীগের সাবেক উপ দপ্তর সম্পাদক নকিবুল ইসলাম সুমন বলেন, ‘যারা এই প্রেস রিলিজ করে, তারা সাম্প্রদায়িক। এরা জামায়াত-বিএনপির প্রেতাত্মা। তারা ছাত্রলীগে অনুপ্রবেশ করে ছাত্রলীগকে ধ্বংস করতে চায়। আর এদেরকে অনুপ্রবেশ করিয়েছেন সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকই।’

‘অনেক সময় সভাপতি সাধারণ সম্পাদক বলেন, এটা তারা করেন নাই। করেছেন আওয়ামী লীগের দায়িত্বপ্রাপ্ত চার নেতা। এই কথা বলার সময় তাদের (সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক) লজ্জা হওয়া উচিত। কারণ, দিনশেষে দায়িত্বটা সভাপতি সাধারণ সম্পাদকেরই।’

ছাত্রলীগের গত কমিটির সদস্য ও ডাকসুর সদস্য তানভীর হাসান সৈকত ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘নতুন মডেলের ছাত্রলীগ বলতে আমি তো দেখি সর্বদলীয় ছাত্রলীগ; যেখানে ছাত্রদল, ছাত্রশিবির, মৌলবাদীরা থাকবে। প্রগতিশীল ছাত্রসংগঠন হয়েও বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ধর্মীয় প্রোগ্রাম দিচ্ছে আমার মতে এটাই নতুন মডেল।’

‘বর্তমান ছাত্রলীগ অনেক বিতর্কিত কাজ করছে। ব্যক্তিগত লাভের জন্য কীভাবে তারা এত টাকা ভাড়া দিয়ে ফ্লাটে থাকে, কীভাবে এতবড় গাড়িবহর নিয়ে চলে? সংগঠন নষ্ট করে নিজেদের ক্যারিয়ার গোছানোর জন্য তারা এই কাজ করছে। তারা সংগঠনকে বিক্রি করে দিচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী বিশ্বাস করে যে দায়িত্ব দিয়েছেন, সেটির প্রতি তারা বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। এই অন্যায়ের শাস্তি তারা একদিন পাবেই।’

ছাত্রলীগের সাবেক উপ দপ্তর সম্পাদক নকিবুল ইসলাম সুমন বলেন, ‘ওবায়দুল কাদের স্যার হয়ত ধারণা করেছিলেন জননেত্রী দেশরতœ শেখ হাসিনার হাতকে শক্ত করতে দুর্দিনে বা মাঠে শ্রম ঘাম দিয়ে সংগঠনকে শক্তিশালী করতে যারা কাজ করছেন, এবারের ছাত্রলীগ তাদের মূল্যায়িত করবে। তিনি চেয়েছিলেন এমন দুইজন ছাত্রলীগের নেতৃত্বে আসবে যারা নেত্রীর কমান্ডের বাইরে যাবেন না, ছাত্রলীগকে সুসংগঠিত করতে কাজ করে যাবেন, সব ধরনের বলয়ের বাইরে এসে যারা ছাত্রলীগটাই করে, তাদেরকে মূল্যায়িত করবে।’

‘কিন্তু অনেক সময় জেলার অনেক প্রভাবশালীর কারণে অযোগ্য কাউকে পদ দিতে হয়। ওবায়দুল কাদের স্যার চেয়েছিলেন এবারের ছাত্রলীগ এই বলয় থেকে মুক্ত হবে, তারা মাদকদ্রব্যের বাইরে থাকবে। কিন্তু সেটা হয়নি।’

‘ছাত্রলীগের বর্তমান মডেল ওবায়দুল কাদেরের মডেল থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। কিন্তু ছাত্রলীগ মানে শুধু ছাত্রলীগ না। এর সঙ্গে জড়িত জননেত্রীর (শেখ হাসিনা), আওয়ামী লীগের ইমেজ। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের এই কমনসেন্সটুকু নেই। যদি থাকত তাহলে তারা বিভিন্ন অপকর্মের সাথে জড়িযে পড়ত না।’

‘কেন্দ্রীয় বডি করতে এক বছর সময় নিয়েছে। হল কমিটি করতে পারছে না। বিতর্কিতদের বাদ দিতে পারছে না। নেত্রী মডেল চেয়েছিলেন সেটা করতে এই দুই নেতা সম্পূর্ণ ব্যর্থ। তিনি  চেয়েছিলেন ছাত্রলীগ হবে একটা সুসংগঠিত ইউনিট, যেটা জননেত্রীর হাতকে সুসংগঠিত করবে।’

‘ছাত্রলীগ তো এমন কোন সংগঠন না যে তারা সাম্প্রদায়িকতার দিকে ঝুঁকে যাবে, মাদকের সঙ্গে জড়িয়ে যাবে। এসব করলে তো জননেত্রীর ইমেজের ক্ষতি হবে। এই জন্য নেত্রী এখন তাদের উপর ফেডআপ।’

ছাত্রলীগে নারীদের নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে উল্লেখ করে এই নেতা বলেন, ‘আমাদের বোনেরা এমনি ছাত্র রাজনীতি করতে চায় না। তার উপর সদ্য সাবেক অনেক নেতা আছে যারা পদ দেওয়ার বিনিময়ে বিভিন্ন অপকর্মের অফার দেয়। যেটা খুবই দুঃখজনক।’

‘জননেত্রী ওমেন এমপাউয়ারমেন্টের জন্য কাজ করছেন। এখন ছাত্রলীগে যদি কোন মেয়ে ভালো করে, সেটা যারা নারীদের ক্ষমতায়নের বিশ্বাস করে না, তাদের জন্য একটি বার্তা। কর্মসূচিতে গেলে আমরা আমাদের বোনদের জন্য জায়গা ছেড়ে দেই। কিন্তু কিছু লোক আছে যারা এই  বোনদের সাথে এমন কিছু করে যার কারণে তারা নিরুৎসাহিত হয়।’

তবে ছাত্রলীগে দৃশ্যমান পরিবর্তন দেখছেন উপ প্রচার সম্পাদক এম এ আহাদ চৌধুরী রায়হান। তিনি বলেন, ‘আগে একটা গৎবাঁধা নিয়মে ছাত্রলীগের কমিটি হতো। এবার সে ধারা থেকে বের হয়ে জননেত্রী শেখ হাসিনার নিজের হাতেই এই  কমিটি করা হলো। এটাকেই নতুন মডেল বলা যায়। এবারের ছাত্রলীগ বিভিন্ন প্রোগ্রামের ক্ষেত্রে নতুনত্ব আনার চেষ্টা করছে, অতীত  ঐতিহ্যের দিকে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করছে। ছাত্রলীগ তার ইতিবাচক অনেক কাজের মাধ্যমে ছাত্রদের মন জয় করে  ডাকসু নির্বাচনে বিশাল ব্যবধানে জয়লাভ করেছে। এবারের ছাত্রলীগ বন্যাদুর্গত এলাকায় যাওয়াসহ বিভিন্ন ইতিবাচক কাজ করেছে এবং  মানুষের দ্বারে দ্বারে গিয়ে তাদের দুঃখ বোঝার চেষ্টা করছে। এটাই নতুন ধারার ছাত্রলীগ।’

‘বিতর্কিতদের ব্যাপারে নেত্রী সরাসরি নির্দেশনা দিচ্ছেন, কেন্দ্রীয় ফোরাম নীতিগত সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। এটাই তো পজিটিভ ধারা।’

পদ বঞ্চিতদের বিষয়ে এই নেতা বলেন, ‘আমরা  এখন আমাদের ভাইদের বিরুদ্ধে কথা বলছি, তারা আমাদের বিরুদ্ধে বলছে, আমরা এটা চাই না। চাই না বলেই সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক  তাদের সঙ্গে বসে কথা বলছে। বিতর্কতদের বাদ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। বাদ দেওয়ার বিষয়টা এখন প্রক্রিয়াধীন। আগের কমিটিতেও বিতর্কিত ছিল। কিন্তু তখন কাউকে বাদ দেওয়া হয়নি। এটাই তো নতুনত্ব।’