দেখা থেকে লেখা

ভূমি অফিসের রেকর্ড রুমে ভূত!

প্রকাশ | ০৯ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ১৪:৩৯

সারওয়ার-উল-ইসলাম

আমাদের দেশে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি হয় ভূমি অফিসগুলোতে। মনে হয় এ কথায় কেউ দ্বিমত করবেন না। কমবেশি সবারই এই ভূমি অফিসে যাওয়া পড়ে। আর গিয়ে বাস্তব অভিজ্ঞতা যদি কারো থেকে থাকে, তা হলে অস্বীকার করবেন না বা বাড়িয়েও বলবেন না।

পত্র-পত্রিকায় এ বিষয়ে অনেক রিপোর্ট হয়েছে। হয়েছে টেলিভিশনেও। এমনকি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও ভূমি অফিসে ঘুষ নেওয়ার ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। সরকার এ বিষয়ে নানা সময় নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। তদন্ত সংস্থাকে সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কোথাও কোথাও তদন্ত সংস্থা সফল হয়েছে, কোথাও আবার কিছুই পায়নি। কারণ যারা এই দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত থাকে, তাদের দৌড় এতটাই উপরে থাকে যে, আগেই দুর্নীতিগ্রস্তরা টের পেয়ে যায় কবে কোথায় তদন্ত সংস্থার লোকজন যাবে। তাই আগে থেকেই সাবধান হয়ে যায় ভূমি অফিসগুলোর লোকজন, যারা টাকা-পয়সার লেনদেনের সঙ্গে সরাসরি জড়িত থাকে।

বড় বড় কর্মকর্তারা কখনো এই টাকা-পয়সা লেনদেনে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত থাকতে চায় না, অফিসগুলোতে গেলে দেখা যাবে, একটু বড় কর্মকর্তারা খুব সুন্দরভাবে কথা বলছেন, এই কাগজ নিয়ে আসেন, ওই কাগজটা নিয়ে আসেন, জমা দেন, সরকারি নিয়মে ৪৫ দিনের মধ্যে হয়ে যাবে আপনার কাজ। 

কতভাবে মানুষকে হয়রানি পোহাতে হয়, একমাত্র ভুক্তভোগী মাত্রই টের পান। কি হয় ভূমি অফিসগুলোতে। জমাজমির রেকর্ড থেকে শুরু করে খাজনা দেওয়াসহ নামজারি করার জন্য যাওয়াই লাগে। এর বাইরেও একশ্রেণির মানুষ নিয়মিত যাতায়াত করেন এই ভূমি অফিসগুলোতে। 
এরা কারা যাদের কাজই হচ্ছে কোথায় কার পূর্ব পুরুষের জমি ছিল, সেগুলোর খবর হয়তো পরবর্তী প্রজন্মের অনেকের জানা নেই বা দূরে থাকে, ঠিকমতো খেয়াল রাখে না বা কেউ মারা গেছে, তার বংশধর নেই। ওই জমি কীভাবে হাতিয়ে নেওয়া যায় বা কোথায় কত বিঘা খাসজমি পড়ে আছে, সেগুলো প্রভাবশালী বা সরকারের উচ্চ পর্যায়ের লোকজনদের সহায়তায় আধাআধি ভাগ করে নেওয়া যায়Ñ এই ধরনের কূটচালবাজদেরই এই ভূমি অফিসে যাতায়াত নিয়মিত। এদের সঙ্গে ভূমি অফিসের রেকর্ড রুমের দায়িত্বে থাকা লোকজন, সার্ভেয়ার, কানুনগো, চেইনম্যান, ভূমি উপ-সহকারী কর্মকর্তাদের চমৎকার যোগাযোগ থাকে। এরা টেবিলে চুপচাপ বসে থাকবে। আর নিচুস্বরে, কখনো ইশারা-ইঙ্গিতে কথা বলবে। অফিস শেষে বাইরে চায়ের আড্ডায় এরা কোথায় কোন কোন জমিতে সমস্যা আছে সেগুলো নিয়ে আলাপ করে।

নিরীহ মানুষকে হয়রানি করার জন্য রেকর্ড রুমের কাগজপত্র গায়েব করা থেকে শুরু করে আপনার জমির সিএস, আরএস-এর কাগজপত্র ঠিক নেই। জমি তো আরেকজনের নামে রেকর্ড হয়ে গেছে। আরও নানাভাবে হয়রানির জন্য এরা গল্প সাজিয়ে ফেলে। ভূমি অফিসগুলোতে গেলে আরেকটা বিষয় বেশ ইন্টারেস্টিং লাগেÑ অফিসের লোক কে, আর অফিসের বাইরের লোক কে, অনেক সময় বোঝার খুব বেশি উপায় নেই।
সাম্প্রতিক একটি অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরলে কিছুটা বোঝা যাবে। যদিও গণমাধ্যমকর্মী পরিচয় দেওয়ার পর তিক্ত অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়নি। 
৩১ জুলাই যাই মিরপুর ১৩ নম্বর সেকশনের বাইশটেকীতে অবস্থিত সহকারী কমিশনার (ভূমি) এর কার্যালয়, মোহাম্মদপুর সার্কেল, ঢাকায়। উদ্দেশ্য, নামজারি করার জন্য। ঢোকার পর খানিকটা পথ এগুলেই হাতের ডান দিকে চলে গেছে তহশিল অফিস। আর সামনে সহকারী কমিশনার (ভূমি) এর কার্যালয়। এ কার্যালয়ে ঢোকার সময় চোখে পড়বে ডান দিকে একটি রুম। উপরে লেখা আছে সেবা কুঞ্জ। একজন বসে থাকার কথা থাকলেও তিনি বারবার উঠে এদিক-সেদিক যাচ্ছেন। একটু ভেতরে জনসাধারণের বসার জন্য একটি রুম, ভেতরে বসার স্টিলের চেয়ার পাতা রয়েছে। 

ঢুকেই দেখলাম বেশ কয়েকজন বসে আছেন। দুজন ভদ্র মহিলা আর দুজন ভদ্রলোক। তারা এসেছেন ফ্ল্যাটের নামজারির বিষয়ে কি কি কাগজপত্র লাগবে জানার জন্য। তাদের পেছনে আমি দাঁড়িয়ে থাকলাম। কি কথা হয় তা শোনার জন্য। 

হার্ট ফাউন্ডেশনের একজন মহিলা চিকিৎসক, বয়স ষাটোর্ধ্ব হবে। তার সব কাগজপত্র সঙ্গেই আছে। কি করা লাগবে অফিস সমন্বয়ক সাতক্ষীরার ভদ্রলোক বেশ হাসিমুখে জানালেন, আজ কাগজপত্র জমা দিয়ে যান, সাত দিনের ভেতর মূল কাগজ নিয়ে তহশিল অফিসে দেখিয়ে নেবেন। একটা তারিখ দিয়ে দিব, সেদিন শুনানির জন্য আসতে হবে। তারপর ৪৫ দিনের মধ্যে নামজারি হয়ে যাবে। আর যদি না আসতে চান তা হলে ১১ হাজার টাকা দিলে এক মাস পর এসে আমার কাছ থেকে নামজারি ও জমা ভাগের প্রস্তাবপত্র নিয়ে খাজনা আর ডিসিআরের টাকা দিতে পারবেন। চিকিৎসক মহিলা তাকে কিছু কম নিতে বললেন, কিন্তু অফিস সমন্বয়ক বেশ হাসিমুখে বললেন, না আপা কম নেওয়া যাবে না। আপনাকে ১১ হাজার টাকাই দেওয়া লাগবে। শেষমেশ তিনি ১১ হাজার টাকা দিতে রাজি হলেন। ৮ হাজার টাকা অগ্রিম দিয়ে পরবর্তী সময়ে ৩ হাজার টাকা দেবেন বলে উঠলেন। হাসিমুখে অফিস সমন্বয়ক ভদ্রলোক বললেন, আপনার একটা কার্ড দিয়ে বাকি টাকা কাউকে দিয়ে পাঠিয়ে দিলে দিয়ে দিব। আপনার আসা লাগবে না।

এই হলো সেবা কুঞ্জের নমুনা। এরপর একজন পরিচয় দিলেন তিনি সহকারী কমিশনার সাহেবের পরিচিত। তার কাছ থেকে পাঁচ শ টাকা নিলেন খুব মন খারাপ করেই। কোর্ট ফি বাবদ ২০ টাকার পরিবর্তে পাঁচ শ টাকা। কি সুন্দর সেবা! ওই ভদ্রলোক যাবার পর আমি বললাম, উনি ৪৫ দিন পরে পেয়ে যাবেন কাগজ দেখেন না ৪৫ দিনেও পায় কি না। বেশ হাসিমুখেই সাতক্ষীরার ফর্সামতো ভদ্রলোক বললেন। দেখলাম আলামত সুবিধা ঠেকছে না। আমি পরিচয়টা দেওয়ার প্রয়োজন অনুভব করলাম। কারণ তার হাঁড়ির খবর তো জানাই হয়ে গেছে। ভয় নেই, খুব বেশি যন্ত্রণা দিতে পারবে না।
আমার পরিচয় পাবার পর কিছুটা সময় পর বললেন, দুই শ টাকা দেন। দিয়ে দিলাম ২০ টাকা কোর্ট ফি-এর পরিবর্তে দুই শ টাকা। 

আমি টাকা দিয়ে সরাসরি চলে গেলাম সহকারী কমিশনারের রুমে। গিয়ে পরিচয় দিলাম। বেশ ভদ্রলোক মনে হলো। কেন এসেছি, জানার পর বললেন ওখানে জমা দিয়ে আসেন। আমি বললাম দিয়ে এসেছি। কিন্তু অভিজ্ঞতা তো ভালো হলো না। কেন জানতে চাইলেন। বললাম, যা দেখলাম, যা শুনলাম। ৩৩ বিসিএস-এর ওই ভদ্রলোক বললেন, আপনি এক মাস পর আমার কাছে চলে আসেন, শুনানির জন্য আসতেও হবে না। শুধু এক সপ্তাহের মধ্যে প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের মূলকপি তহশিল অফিসে দেখিয়ে নিয়েন। আগামী ১ সেপ্টেম্বর নিয়ে যাবেন আপনার নামজারির কাগজ। আর আপনার ওই ফাইলের ভেতর আপনার ভিজিটিং কার্ডটা পিন করে রাখতে বলেন ওনাকে (সাতক্ষীরার অফিস সমন্বয়কের কথা বললেন)। আমি তার কথা শিরোধার্য মনে করে তাই করলাম।

এক মাস পর ২ সেপ্টেম্বর হাজির হলাম। স্লিপ দেওয়ার পর আমার ফাইল নিয়ে এলেন একজন অফিস সহকারী। আমার আবেদনপত্রের ওপর লেখা প্লটের দুই মালিকের একজনের খাজনার রসিদে প্লট নম্বর নেই। সহকারী কমিশনার সাহেবকে আমার কাগজপত্র দেখিয়ে বললাম, এই যে দেখেন আমার কাছে ফটোকপিতে প্লটের নম্বর উল্লেখ আছে। তিনি ডাকলেন ভূমি সহকারী কর্মকর্তাকে। তিনি এলেন। সহকারী কমিশনার বললেন, কি সমস্যা এই ফাইলে উনি কিছুটা ভড়কেই গেলেন মনে হয় ওনাকে এভাবে ডেকে আনায়। উনি ইনিয়ে-বিনিয়ে কিছু একটা বলার আগেই সহকারী কমিশনার সাহেব বললেন, এটাতে তো লেখা আছে। আর খাজনা রসিদ তো আপনারাই লেখেন নাকি। যান ঠিক করে দেন। বয়স্ক উঁচু লম্বা লোকটা হেলতে দুলতে চললেন, সঙ্গে আমি। তাকে আমার পরিচয় দিলাম। তিনি নিয়ে গেলেন আরেকজনের কাছে। ভূমি উপ-সহকারী কর্মকর্তা তিনি। আগেই তার সঙ্গে কথা হয়েছিল। উনি কাগজপত্র দেখে বললেন, যিনি আপনার আবেদনপত্র পূরণ করেছেন উনি ভুল করেছেন। আপনি আমার কাছে আসতেন। আমি ভালোভাবে দেখে দিতাম। অর্থাৎ সেই সাতক্ষীরার হাসিমুখের অফিস সমন্বয়ক ভুলটা করেছেন। কতটুকু জমি স্পষ্টই লেখা আছে। প্লটের নম্বরও স্পষ্ট আছে। ভুলটা কেন করলেন ১১ হাজার টাকা না পেয়ে আমি জানি না।
এরপর আমার কাজ বেশ দ্রুতই হয়ে গেল। গেলাম রেকর্ড রুমে। 

আমার কোনো তিক্ত অভিজ্ঞতা নেই সহকারী কমিশনার (ভূমি) এর কার্যালয়ের। কিন্তু অবাক হয়ে গেলাম। রেকর্ড রুমে যার কাছে গেলাম সে প্রথমেই বলল, কিছু খরচাপাতি লাগবে রেজিস্ট্রি খাতায় নাম ওঠাতে। আমি বললাম, কি নাম তার বললেন, মনির। বাড়ি কোথায় বললেন, মানিকগঞ্জ। এখানকার স্টাফ বললেন, না। তা হলে আমি আমার ভিজিটিং কার্ড দিয়ে বললাম, সহকারী কমিশনার সাহেবকে বলব, ভূমি উপ-সহকারীকে বলব টাকা চেয়েছেন। তিনি আমার কার্ডটা পকেটে নিয়ে বললেন, যান বলেন। বলেই আমার কাজ শুরু করলেন।
আমার কি অবাক হওয়াটা খুব অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে, পাঠক

পরে এক কানুনগোকে বললাম বিষয়টা। তিনি বললেন, না এই নামে তো আমাদের রেকর্ড রুমে কেউ নেই। ফোন করলেন রেকর্ড রুমের একজন স্টাফকে। তিনি ফোন ধরছিলেন না। পরে ধরে জানালেন তিনি অফিসের সামনেই আছেন। আসছেন।
আমার তাড়া থাকায় চলে আসি। 

অনেক ভৌতিক গল্প-উপন্যাস পড়েছি জীবনে। তবে কখনো ভয়টয় পাইনি। এবার পেতে যাচ্ছি মনে হয়। কারণ আমার নামজারি ও জমা ভাগের প্রস্তাবপত্রটি রেকর্ড করেছেন রেজিস্ট্রিতে কে তা হলে যিনি এই মিরপুর ১৩ নম্বরের ভূমি অফিসের কোনো স্টাফ নন। খুবই অযতেœ রাখা বইগুলো কে দেখভাল করছেন জানতে চাই, মাননীয় ভূমিমন্ত্রীর কাছে।