আর পারছে না ঢাকা!

প্রকাশ | ০৯ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ১৫:০৮ | আপডেট: ০৯ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ১৫:৩০

হাবিবুল্লাহ ফাহাদ

“ওরে ঢাকা খুলে দেখলে পরে, 

থাকবে না তো সাবেক মন
ঢাকা শহর ঢাকা যতক্ষণ।”

বাউল শিল্পীর চোখে ‘ঢাকা শহর’, ঢাকাই শ্রেয়। কিন্তু ঢাকা কি আর সেই ঢাকা আছে? যে ঢাকা ছিল কবিতার শহর। ছিল শিল্পের আর রুচিশীলতার। ইতিহাস ও ঐতিহ্যের। সময়ের সাথে বদলে গেছে ঢাকা। পুরোনো দিনের মানুষরা, যারা এখনো বেঁচেবর্তে আছেন, তারা এই ঢাকার সাথে সেই ঢাকার খুব একটা মিল পান না। ঝাপসা চোখে তাকিয়ে থাকেন বড় বড় দালানের দিকে। ঘিঞ্জি বাণিজ্য বেসাতির দিকে। যেখানে এক সময় ছিল খেলার মাঠ। জলাধার। কোথায়? নেই তো! 

এই তো সেই ঢাকা, এক সময় যাকে বলা হতো তিলোত্তমা। বাংলা একাডেমির অভিধান বলছে, ‘পুরাণমতে সুন্দ ও উপসুন্দ নামে দুই অসুরকে বিনষ্ট করার অভিপ্রায়ে সৃষ্টির সকল উত্তম পদার্থ থেকে তিল তিল করে আহৃত উৎকৃষ্ট অংশ দিয়ে সৃষ্ট অপ্সরাবিশেষ।’ এক কথায় ‘পরমা সুন্দরী’।
পরমা সুন্দরীর ঢাকার রূপও এখন অস্তগামী। ফুরিয়ে গেছে অনেকটাই। আদি ঢাকা দিনে দিনে ঘিঞ্জি হয়েছে। শুরুতে স্থাপনায় যে পরিকল্পনার ছাপ ছিল, তার ধারাবাহিকতা ছিল না। প্রয়োজনে ভবন বেড়েছে। জলাশয় ভরাট হয়েছে। খেলার মাঠে উঠেছে দালান। পথগুলো পর্যাপ্ত প্রশস্ত হয়নি। সব এখন অলিগলি। 

পুরান ঢাকার উদাহরণ দেওয়া সহজ হলেও সারা ঢাকার অবস্থাও প্রায় একই। হাতেগোনা কয়েকটি পরিকল্পিত আবাসিক এলাকা ছাড়া। আবার অনেক আবাসিক এলাকাতেও আছে অর্ধপরিকল্পনার ছাপ। প্রশস্ত পথ আছে, খেলার মাঠ নেই। খেলার মাঠ আছে, পুকুর নেই। হয়নি সবুজায়ন।

এখন ঢাকায় বুক ভরে শ্বাস নেওয়ার জন্য আসা যায় হাতিরঝিলে। একটা সময় তা-ও ছিল না। জল-স্থল উভয় পথেই যাতায়াত করা যায় হাতিরঝিলে। কী সুন্দর পরিবেশ! না চাইলেও মন বলে ওঠে। কিন্তু তা পার হলেই আবার সেই ঘিঞ্জি বসতি। 

ঘরবাড়িগুলো পরগাছার মতো একটার গা বেঁয়ে আরেকটা উঠেছে। দুই ভবনের মাঝে এক হাত জায়গা নেই পার হয়ে যাওয়ার জন্য। পথগুলোও সরু। পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা দুর্বল। ড্রেনেজের সক্ষমতা গড়ে ওঠেনি অতটা। যে কারণে একটু বৃষ্টি হলে ঘরে ঢুকছে পানি। পথঘাট তলিয়ে যাওয়া তো খুবই সাধারণ ব্যাপার। এই দায় আসলে কার? যারা মাসের শুরুতে কিংবা শেষে ভাড়া গোনেন তাদের? নাকি যারা এভাবে গড়ে তুলেছে বসতি, তাদের? 
এই শহরে যাদের বাস, তাদের কাছে যদি চান, কোন সমস্যাটা বড় মনে হয় আপনার কাছে? বলবে, যাতায়াত। এই শহরে চলাফেরা একটা ঝক্কিই বটে। প্রতিদিন কর্মজীবী মানুষের ভোর হয় অফিস যাবার আতঙ্ক নিয়ে! শুনে অবাক হলেও এটাই সত্যি। নির্ঝঞ্জাট যাতায়াতের কোনো উপায় নেই।

গণপরিবহনে স্বস্তি নেই। পায়ে পায়ে মানুষ। একে অন্যের কাঁধে ভর করে ওঠে পরিবহনে। গাড়িতে ওঠাও যেন এক ধরনের প্রতিযোগিতা। দুর্বল শরীর আর চিত্তের মানুষ হলে পিছিয়ে পড়তে হবে। তার ওপর যানজটে নাকাল হওয়া তো নতুন নয়। 

ঢাকায় এখন উন্নয়ন হচ্ছে। যাতায়াত সহজের জন্য হচ্ছে মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেস ওয়ে। বাস-র‌্যাপিড ট্রানজিট। উড়াল সেতু তো আছেই। নির্মাণ কাজ চলছে। শহরের গুরুত্বপূর্ণ পথের বুকগুলো বাইপাস সার্জারির মতো কাটা হয়েছে। দিনরাত কাজ চলছে। কঠিন পাথরের খুঁটিগুলো একের পর এক মাথা তুলছে। এই মাথায় বোঝার মতো তুলে দেওয়া হবে পথ। সেই পথেই আসবে যানজটের সমাধান।

কিন্তু তার আগে আরও দীর্ঘ সময় সইতে হবে দুর্ভোগ। কর্মদিবসে সারা ঢাকাই যেন যানজটের শহর। গাড়িগুলো গা ঘেঁষাঘেঁষি করে চলে। কেটে ফেলায় সরুপথে পিঁপড়ের সারির মতো একটার পিছু একটা যেতে হয়। দশ মিনিটের পথ পাড়ি দিতে হয় এক ঘণ্টায়। উন্নয়নের কথা ভেবে এতটুকু অগত্যা মেনে নিয়েছে নগরবাসী। 

এই শহর আবার দূষণেরও শহর। বায়ু দূষণ। ধুলো ঝড়। বুক ভরে শ্বাস নেওয়ার খুব বেশি জায়গা নেই খোলা। ধুলায় আকীর্ণ। ধুলিধূসর পরিবেশ। ধুলা থেকে বাঁচতে নাক চেপে চলতে হয়। আছে গাড়ির হর্নের বিকট শব্দ। শহরের প্রায় সব এলাকাতেই শব্দ গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে দুই থেকে তিনগুণ বেশি। এ অবস্থা চলতে থাকলে ২০২১ সালের মধ্যে ঢাকার জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ কোনো-না-কোনো ধরনের বধিরতায় আক্রান্ত হবেন। 

ঢাকা এক সময় ছিল নদী বেষ্টিত। সেই নদীগুলোও দখল আর দূষণে হারিয়ে যেতে বসেছিল। সরকারের নানা উদ্যোগে এখন নতুন করে দখল বন্ধ হলেও পুরোপুরি দখলমুক্ত করা যায়নি। দূষণও হচ্ছে। আগের চেয়ে মাত্রা কিছুটা কমেছে, এই যা। নদীগুলো দখল-দূষণের কারণে হারিয়ে গেছে মৎস্য সম্পদ। বর্ষা আর নিত্যদিনে মানুষের ব্যবহৃত পানি নেমে যাওয়ার জন্য নদীগুলো একমাত্র উপায়। কিন্তু দখলের কারণে নদীগুলো শুকিয়ে খালে পরিণত হয়েছিল। খনন আর সংরক্ষণের উদ্যোগে এই পরিস্থিতির কিছুটা উত্তরণ হলেও পুরোপুরি হয়নি। যে ক্ষতি হয়েছে নদীগুলো তা সহসা পুষিয়ে নেওয়াও সম্ভব নয়। এজন্যও লম্বা সময় লাগবে।    

যুক্তরাজ্য থেকে প্রকাশিত বাণিজ্যবিষয়ক প্রভাবশালী সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্টের গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইকোনমিক ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (সিপিইউ) সম্প্রতি একটি তালিকা প্রকাশ করেছে। ‘গ্লোবাল লিভিব্লিটি ইনডেক্স’ শিরোনামের এই তালিকায় গেল বছর ১৪০টি শহরের মধ্যে ঢাকা শহরের অবস্থান ছিল ১৩৯তম। এ বছর একধাপ অগ্রগতি হয়েছে। এখন ঢাকার অবস্থান ১৩৮। সিপিইউ বসবাসের যোগ্যতার দিক থেকে শহরগুলোর ছয়টি বিষয়কে সূচক হিসেবে বিবেচনা করে। এগুলো হচ্ছে শহরের স্থিতিশীলতা, স্বাস্থ্যসেবা, সংস্কৃতি ও পরিবেশ, শিক্ষা এবং অবকাঠামো। যদিও তাদের এই গবেষণা বা জরিপ নিয়ে প্রশ্ন আছে। কোন প্রক্রিয়ায় এটি নির্ধারণ করা হয়, তা-ও স্পষ্ট নয়। তাছাড়া যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের সঙ্গে ঢাকার তুলনাটিও বিশেষজ্ঞদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। 

অন্যান্য শহরের তুলনায় ঢাকায় জনসংখ্যাও অনেক বেশি। আয়তন অনুযায়ী জনসংখ্যার ঘনত্ব বেশি। প্রায় পৌনে দুই কোটি মানুষের শহর ঢাকা। এখানে  প্রতি বর্গকিলোমিটারে বসবাস করে ৪৫ হাজার লোক। এ কথা ঠিক যে, এত মানুষের আবাসনের সুব্যবস্থা এখনো গড়ে ওঠেনি। এখনো ফুটপাতে রাত কাটায় মানুষ। বস্তিঘরের ঝুপড়িতেও থাকে লাখ লাখ পরিবার। কিন্তু না খেয়ে থাকে এই শহরে এমন মানুষ হয়তো পাওয়া কঠিন হবে। যা হয়তো পৃথিবীর অন্য কোনো শহরে বিরল।

ইকোনমিস্টের জরিপ কিংবা তালিকা যদি আমলেও না নিই, তাহলেও ঢাকাবাসী বুক চিতিয়ে বলতে পারবেন না, ‘ভালো আছি।’ নাগরিকের সমস্যার অন্ত নেই। একদাগে সব বলে ফেলাও সম্ভব নয়। ঢাকার বড় বড় সমস্যাগুলো নীতি-নির্ধারকদের কাছে তো অজানা নয়। ভুলগুলো শুধরে নেওয়ার সুযোগ আছে। অপরিকল্পিত স্থাপনা ভেঙে নতুন করে গড়া যায়। এ জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা আর মানুষের অংশগ্রহণ প্রয়োজন। মানুষকে তার ভালোটা বোঝাতে হবে। দৃশ্যমান ভালো উদ্যোগ নিতে হবে। রাজধানীর উন্নয়ন দেখার দায়িত্ব যাদের, তারা কতটুকু পারছেন, তাও দেখতে হবে। 
বিপুল জনসংখ্যার চাপ তো কম নয়। ঢাকাকে তাও সইতে হচ্ছে। দিন যত যাচ্ছে, রাজধানীমুখী মানুষের চাপও বাড়ছে। ঢাকা শহর হলেও তারও প্রাণ আছে। তারও আছে সইবার সীমা। ঢাকা হয়তো এখন আর অতিরিক্ত মানুষের চাপ সইতে পারছে না। এজন্য এখন থেকেই দেখতে হবে সুদূরে। কতটা বাসযোগ্য থাকবে, কতটা বাসযোগ্য করা যাবে, এসব নিয়ে ভাবার সময় এখনই।