আসাম সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া দিতে হবে

প্রকাশ | ০৯ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ১৬:৫৭

মোহাম্মদ জমির

আসামে বর্তমানে অধিবাসী ৩.৩ কোটির মতো। এরা এখানে কবে থেকে বসবাস শুরু করেছে সেটা সবার আগে জানা দরকার। বহু আগের কথা, লর্ড কার্জন ১৯০৫ সালে বাংলা বিভক্ত করলে ভারতের দিকটা ছিল পশ্চিম বাংলার অংশ আর এদিক হচ্ছে বাংলা ও আসাম। যার কারণে সিলেটের কিছু অংশ আসামে ছিল আবার আসামের কিছু অংশ সিলেটের মধ্যে ছিল। শুধু তাই নয়, পুরোনো রংপুরের কিছু অংশও আসামের মধ্যে ছিল। তখন আসামে লোকসংখ্যা ১ কোটি বা তার চেয়েও কম ছিল। সেই সময়টাতে ইংরেজরা সিদ্ধান্ত নিল যে, আসামে অনেক বিস্তৃত জমি পড়ে আছে এবং চা চাষ করার উপযুক্ত একটা জায়গা। সেই সময়টাতে বিলেতে চা যেত দার্জিলিং থেকে। যেহেতু চা খাওয়াটা তাদের নেশায় পরিণত হলো ওরা দেখল দার্জিলিং ছাড়াও আসামের পাহাড় বা বিস্তৃত ভূমিতে চা চাষ করা যেতে পারে। ইংরেজরা তখন ছোট ছোট অঞ্চল পরিচালনা করা ডেপুটি কমিশনারদের বলল উড়িষ্যা, পশ্চিমবঙ্গ ও কুচবিহার থেকে সিলেটের ওদিক থেকে লোকজন নিয়ে আস। 

সাদা চামড়ার সাহেবদের কথামতো আসামে বিভিন্ন জায়গা থেকে লোকজন নিয়ে আসা হলো। যাদের চায়ের বাগান করার জন্য নিয়ে আসা হলো এদের মধ্যে বেশিরভাগ হচ্ছে গালিব সম্প্রদায়ের যারা কি না নমঃশূদ্র। এরা ছাড়াও গুরখা আসে সেখানে, যারা কি না নেপাল ও ভুটানের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসামে আসে। এসব লোকের আসামে বৌ-বাচ্চা নিয়ে থাকার জন্য ইংরেজরা বন্দোবস্ত করে দিল। তারা চা চাষ করে জীবন চালাতে লাগল। তাদের যেহেতু ওখানে বসবাস, তাই সেখানে তাদের আত্মীয়স্বজনরাও এসে বসবাস শুরু করল। এককথায় তারা সেখানে পুরোপুরি বসবাস করতে শুরু করল। এটা চলতেই থাকল। এর মধ্যে দেশভাগ হলো। ভারত ও পাকিস্তান নামক দুটো আলাদা রাষ্ট্র হলো। আসামে কিন্তু তখনও বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা লোকজনের বসবাস প্রক্রিয়া চলতেই থাকল। আর সেখানকার কৃষিবিদরা তাদের দিয়ে চায়ের পাশাপাশি তামাক, সবজি চাষ করাতে লাগল, আর সেগুলো ভারতের বিভিন্ন জায়গায় রপ্তানিও হতো আসাম থেকেই। 

কিন্তু বহুদিন আসামে বসবাসকারী বাংলাভাষীদের আমাদের এখানকার বলে দাবি করা হচ্ছে বিভিন্ন সময়ে। এর পেছনে দায়ী ১৯৭১ সালের পশ্চিম পাকিস্তান আর পূর্ব পাকিস্তানের যুদ্ধ ইস্যু। ’৭১ সালের ২৫ মার্চ যখন যুদ্ধ শুরু হলো তখন আমাদের এখানকার লোকজন ভারতের দিকে যাওয়া শুরু করল। ভারত সরকারও আমাদের এখানকার শরণার্থীদের জন্য হৃদয় ও সীমান্ত দুটোই খুলে দিল। প্রায় ১ কোটির মতো বাঙালি তখন ভারতের কলকাতা ছাড়াও বিভিন্ন জায়গায় আশ্রয় নেয়। 

এখানে যুদ্ধ চলছে। আমাদের লোকজন যুদ্ধ চলা পর্যন্ত অর্থাৎ ৯ মাস ভারতে শরণার্থী হিসেবে থাকল। একটা সময় এসে পাকবাহিনী আত্মসমর্পণ করল। যারা শরণার্থী হিসেবে ভারত গিয়েছিল তারাও একে একে দেশে ফেরা শুরু করল। অল্প কিছু দিনের মধ্যে যারা ভারত গিয়েছে তাদের প্রায় ৯৭ ভাগ দেশে ফিরে আসে। 

আমাদের এখান থেকে যারা ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল তাদের মধ্যে বড়জোর দুই হাজার লোকের মতো সেখানে থেকে গেল। কারণ এখানে এসে তারা কোথায় উঠবে, তাদের বাড়িঘর সব শেষ করে দিয়েছে পাকবাহিনী। 

আসামে নাগরিকপঞ্জি বিষয়টি প্রথমে আসে ১৯৫১ সালে। এরপর ক্ষণে ক্ষণে এই ইস্যুটি বিতর্ক হয়ে জ্বলে ওঠে আবার ডুবে যায়। কিন্তু সর্বশেষ গত কয়েক দিন আগে কেন্দ্রীয় সরকার ১৯ লাখ ৬ হাজার ৬৫৭ মানুষের একটা তালিকা প্রকাশ করে। এদের মধ্যে ১১ লাখের বেশি হিন্দু, পাঁচ লাখের বেশি মুসলমান আর ১ লাখের মতো হচ্ছে বিভিন্ন উপজাতি। 

ভারতে পরপর দুইবার বিজেপি সরকার ক্ষমতায়। এরা ক্ষমতায় আসার পর উচ্চারিত হচ্ছে, মুসলিম দেশ থেকে আসামে আগতদের ভারতে রাখা হবে না। আর এটা হচ্ছে বিজেপির একটা রাজনৈতিক কৌশল। তারা এই নাগরিকপঞ্জি নিয়ে একটা রাজনীতি করছে। আসামে রাহেনী মোহন নামের এক সাংবাদিকের ভাষ্য, নাগরিকপঞ্জি থেকে যাদের বাদ দেওয়া হয়েছে এদের নিয়ে আঞ্চলিক কোর্টে পাঁচ শর মতো কেইস হয়েছে। সেখানে শতকরা ৭২ জন ট্রায়ালে আসেনি।  

ভারতের এই বিষয়টি নিয়ে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলছে, এটা কোনোমতে গ্রহণযোগ্য নয়। 

এবার আসি আসামের নাগরিকপঞ্জি ও বাংলাদেশ প্রসঙ্গে। আসামে যাদের নাগরিকপঞ্জিতে রাখা হয়নি তাদের বলা হচ্ছে এরা বিদেশি বা ভারতীয় নয়। বিষয়টি ভারতের একেবারে অভ্যন্তরীণ বিষয়। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্কর বাংলাদেশ সফরে এসে এমনটাই বলে গেছেন আর আশ্বাস দিয়েছেন। অর্থাৎ বাংলাদেশ এটা নিয়ে ভাবারও দরকার নেই। 

কিন্তু আসামের নাগরিকপঞ্জি নিয়ে সেখানকার প্রভাবশালী মন্ত্রী এবং সরকারি দলের নেতারা হরহামেশাই মন্তব্য করে যাচ্ছেন। আসামের অর্থমন্ত্রী হিমান্ত বিশ্ব শর্মাতো বলছেন, বাংলাদেশের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা বলা হবে। এমন অবস্থায় বাংলাদেশ বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ না করতে চাইলেও এটাই সামনে এসে হাজির হয়। 

বাংলাদেশ ইতিমধ্যে সিলেটের সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে যেন কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে সেজন্য নজরদারি বাড়িয়েছে। এবং সীমান্তবর্তী গ্রামাঞ্চলে যারা বসবাস করছে তাদের বিজেপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, কোনো সতর্কতা যদি দেওয়া হয় তারা যেন সেটা মানেন। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আমাদের মনে রাখতে হবে এটা কিন্তু শেষ কথা নয়। কথা হলো ওরা যদি তাদের আমাদের এখানে ঠেলে দিতে চায় তাহলে রোহিঙ্গা সমস্যার মতো আরেকটা সমস্যা সৃষ্টি হবে। আমরা রোহিঙ্গা সমস্যার মতো আরেকটি সমস্যা সৃষ্টি হতে দিতে পারি না। আমি মনে করি, যে জায়গায় আসামের সঙ্গে আমাদের সীমান্ত আছে সেখানে সম্পূর্ণভাবে কাঁটাতারের বেড়ার বন্দোবস্ত করা উচিত। এবং বেড়ার জন্য যেসব পয়সা খরচ হবে সেটা যারা আমাদের ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট আছে তারা দিবে। কতই বা খরচ হবে? সোশ্যাল করপোরেট রেসপনসিবিলিটির দায় থেকে তাদের এটা করতে হবে। 
আমরা তো দ্বিতীয়বার রোহিঙ্গা সমস্যার মতো আরেকটি সমস্যা নিয়ে আসতে পারি না। আমাদের আগে থেকে এটা বন্ধ করতে হবে। যেন তারা পরিষ্কার করে বুঝতে পারে ঠেলে দিলেই আমরা নিয়ে নিব না। ন্যাড়া বেলতলায় একবারই যায়। 

লেখক: সাবেক রাষ্ট্রদূত ও সাবেক প্রধান তথ্য কমিশনার

অনুলিখন: নজরুল ইসলাম