ইয়াবা পাচারের নতুন রুট

কাঁটাতার পেরিয়ে যায় হুন্ডির টাকা, আসে ইয়াবা

প্রকাশ | ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ০৮:৩৯

সাইমুম সাব্বির শোভন, রৌমারী থেকে ফিরে

ভারতের আসাম সীমান্ত দিয়ে নতুন চারটি পয়েন্টে আসছে ইয়াবা। কুড়িগ্রামের রৌমারী থেকে জামালপুর মহাসড়কটিকে ইয়াবা পাচারের নতুন রুট বানিয়েছে আন্তর্জাতিক ইয়াবা পাচার চক্র। এ রুটে একাধিক হাতবদল হয়ে রাজধানীসহ দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করছে ইয়াবার বড় বড় চালান।

রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশ-মিয়ানমারের বৈরী সম্পর্কে টেকনাফ ও উখিয়া সীমান্তে কড়া নজরদারি থাকায় নতুন এই রুট চালু করেছে ইয়াবা পাচারের একাধিক সিন্ডিকেট। প্রতিদিনই বিপুল পরিমাণ ইয়াবা সীমান্ত দিয়ে নতুন পদ্ধতিতে ও নতুন রুটে আসছে বাংলাদেশে।

৯ আগস্ট রাজধানীর রামপুরায় ভারতের আসামের নাগরিক ছবুর মিয়া ও রৌমারীর তেকানী ঝগড়ার চর গ্রামের জাকির হোসেন ও শামসুল আলম ১০ হাজার পিস ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার হলে ইয়াবা পাচারের নতুন রুটের খবরটি ফাঁস হয়।

নতুন এই রুটে মাঝেমধ্যেই বড় বড় চালান ধরা পড়ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে। তবে পাচারের তুলনায় উদ্ধার, গ্রেফতার ও মামলার সংখ্যা কম বলে জানিয়েছে একাধিক সূত্র।

কুড়িগ্রামের রৌমারী থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আবু মো. দিলওয়ার হাসান ইনাম ঢাকা টাইমসকে বলেন, সীমান্তে ইয়াবা পাচারের মূল দায়িত্ব বিজিবির। বিজিবি নাইট পেট্রোলসহ সীমান্তে টহল জোরদার ও নিয়মিত অভিযান তৎপরতা শক্তিশালী করলে কিছুটা কমে আসার সম্ভাবনা রয়েছে।

জামালপুরের দুই উপজেলা বকশীগঞ্জ ও দেওয়ানগঞ্জ এবং কুড়িগ্রামের উলিপুর, নাগেশ্বরী, রাজিবপুর ও রৌমারী উপজেলায় অনুসন্ধান এবং সীমান্তঘেঁষা অঞ্চলগুলোর লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সীমান্তঘেঁষা অঞ্চলগুলোতে হুন্ডি ব্যবসায়ীরাই এই ইয়াবা পাচারের সঙ্গে জড়িত। বাংলাদেশি ইয়াবা সিন্ডিকেটের হুন্ডির টাকা যাচ্ছে ভারতে, বিনিময়ে ইয়াবা পাঠাচ্ছে সেখানকার মাদক কারবারিরা। ভারতের আসামের সীমান্তঘেঁষা কুড়িগ্রামের চারটি উপজেলা ও জামালপুরের দুই উপজেলার সীমান্তের কাঁটাতার দিয়ে স্থলপথে ও নদীপথে আসছে ইয়াবার চালান। পরিবহনে সহজতর ও অধিক লাভজনক হওয়ায় বাংলাদেশের সীমান্ত ঘেঁষে গড়ে উঠেছে ইয়াবার শক্তিশালী নেটওয়ার্ক। এই নেটওয়ার্কের মধ্যে ইয়াবার ট্রানজিট পয়েন্ট কুড়িগ্রামের রৌমারী উপজেলা। জেলার রৌমারীসহ উলিপুর, নাগেশ্বরী ও রাজিবপুর উপজেলার সীমান্তের ওপার থেকে আসা ইয়াবার ডাম্পিং স্টেশন রৌমারী হয়ে জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ-বকশীগঞ্জ-ঢাকা রুটে নানা পরিবহনে ও নানা কায়দায় রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ছে ইয়াবা। পাচারের ক্যারিয়ার হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে নারী, শিশুসহ নানা বয়সের সীমান্ত এলাকার দরিদ্র মানুষ। ১০ হাজার টাকার বিনিময়ে ভাড়ায় খাটা এসব নারী-পুরুষ ও শিশু-কিশোররা রাজধানীসহ নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে দিচ্ছে ইয়াবার চালান।

জানা যায়, রৌমারী থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে ছেড়ে আসা নাইট কোচের ড্রাইভার ও হেলপাররা এই ইয়াবার চালান পরিবহনের সঙ্গে জড়িত। রৌমারীর পরিবহন সেক্টরকে ম্যানেজ করেই বাস-সিএনজিসহ নানা পরিবহনে ভাড়ায় খাটা ইয়াবার ক্যারিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত নারী-পুরুষ-শিশু-কিশোরদের মাধ্যমে পাচার হচ্ছে ইয়াবার চালান। এছাড়া পাচার হচ্ছে ব্যক্তিগত পরিবহনের মাধ্যমেও।

ইয়াবা পাচার ঘিরে কুড়িগ্রামের চারটি ও জামালপুরের দুটি উপজেলায় গড়ে উঠেছে শক্তিশালী একাধিক সিন্ডিকেট। এসব সিন্ডিকেটের মূল হোতা রৌমারীর বামুনের চর গ্রামের মজিবর রহমানের ছেলে হুন্ডি ব্যবসায়ী মিনহাজ উদ্দিন। দীর্ঘদিন ধরে মিনহাজ গরু পাচার সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। গরু পাচার বন্ধ হওয়ায় তিনি নেমে পড়েন হুন্ডি ব্যবসায়। তার সঙ্গে যোগ দেন অর্ধশতাধিক মানুষ। এরা রৌমারীর বিভিন্ন গ্রামের বাসিন্দা।

দেওয়ানগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) এমএম মইনুল ইসলাম ঢাকা টাইমসকে জানান, এই রুটে চেকপোস্ট বসানো হয়েছে। নিয়মিত টহল বাড়িয়েছি। সন্দেহভাজন কোনো ব্যক্তি ও পরিবহন পাওয়া মাত্রই চেকিং করা হচ্ছে।

বকশীগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. হযরত আলী ঢাকা টাইমসকে বলেন, আমার এরিয়ায় চেকপোস্ট বসানো হবে। কোনো পরিবহন চেকিং ছাড়া যেতে দেওয়া হবে না। এলাকাবাসীদের নিয়ে এই রুটে ইয়াবা পাচার বন্ধে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাবো।

জামালপুরের পুলিশ সুপার মো. দেলোয়ার হোসেন ঢাকা টাইমসকে বলেন, রৌমারী-জামালপুর মহাসড়কে সাম্প্রতিক ইয়াবার বড় বড় চালান ধরা পড়েছে। এ রুটে ইয়াবার চালান বন্ধে নানা পরিকল্পনা হাতে নিয়েছি। ঘন ঘন তল্লাশি চালিয়ে বড় বড় চালান ধরা হচ্ছে, পাচারকারীদেরও গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। গ্রেপ্তারকৃতরা রৌমারী, রাজিবপুর, উলিপুরের মানুষ। ইয়াবা পাচারে কোনোভাবেই জামালপুরের পথ ব্যবহার করতে দেয়া হবে না পাচারকারীদের। পাচারসহ মাদক ব্যবসায়ী যত প্রভাবশালীই হোক না কেন, কাউকে ছাড় দেয়া হবে না। ইয়াবা পাচার জিরো টলারেন্সে আনা হবে।

৩৫ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল মো. নজরুল ইসলাম ইয়াবা পাচার নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে ঢাকা টাইমসকে বলেন, ইয়াবা পাচার তো হাওয়া থেকে হয় না, মানুষেই পাচার করে। পাচারের সঙ্গে বিজিবির কোনো সদস্য জড়িত থাকলে তাদের বাড়ি চলে যেতে হবে। পাচার বন্ধে বিজিবির টহল ও নজরদারি জোরদার করা হবে। সেই সঙ্গে বেশি বেশি সচেতনমূলক সভা-সেমিনার করে সীমান্ত এলাকার মানুষকে সচেতন করতে হবে। এই পাচার বন্ধ করতে হলে বিজিবি, পুলিশ, র‌্যাবসহ সমাজের নানা শ্রেণিপেশার মানুষের সম্মিলিত প্রয়াসে ইয়াবা পাচার বন্ধ হবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।

ঢাকাটাইমস/১২সেপ্টেম্বর/প্রতিনিধি/জেবি