সালমান হত্যা: বিচার দাবিতে আজও সোচ্চার ভক্তরা

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকাটাইমস
 | প্রকাশিত : ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ১৯:৫০

অল্প সময়ে বাংলা চলচ্চিত্রে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়াতা পাওয়া নায়ক সালমান শাহ্্র মৃত্যু নিয়ে ধূম্রজাল কাটেনি গত ২০ বছরেও। ১৯৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর তিনি কি আত্মহত্যা করেছিলেন এ কথা বিশ্বাস করতে চান না বেশিরভাগ মানুষই। তাই তদন্ত প্রতিবেদনে আসা আত্মহত্যার রিপোর্ট প্রত্যাখ্যান করেছেন তার পরিবার ও কোটি ভক্তরা। আর তাই আজও তার মৃত্যকে হত্যা দাবি করে জড়িতদের বিচার চেয়ে আসছেন ভক্তরা।

পুলিশের তদন্ত রিপোর্ট নিয়ে লাখ লাখ ভক্তদের রয়েছে সন্দেহ। তাইতো সালমান শাহর পিতা-মাতার মত ভক্তরা বিশ্বাসই করেন না যে তিনি আত্মহত্যা করেছেন।

সালমান শাহর মৃত্যুশোকে অনেক তরুণী আত্মহত্যা করেছে। আবার অনেক ভক্ত গুরুতর অসুস্থ্য হয়ে পড়েছিলেন। তারা তাদের স্বপ্নের নায়কের হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের বিচারের দাবিতে দুই যুগ ধরে রাস্তায় নেমে মানববন্ধন ও সমাবেশ করে প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন।

সালমানের পরিবারের মতো ভক্তদেরও আফসোস সালমান শাহ্্’র মৃত্যুর দুই যুগ হতে চললেও রহস্যজনক এই মৃত্যুর সঠিক তদন্ত সম্পন্ন হয়নি।

১৯৯২ সালের দিকে তৎকালীন খ্যাতনামা এক প্রযোজনা সংস্থা ভারত থেকে বলিউডের তিনটি সিনেমার প্যাটেন্ট কিনে আনে বাংলাদেশে রিমেক করার জন্য। সেখান থেকে একটি সিনেমা বানানোর দায়িত্ব পড়ে গুণী পরিচালক সোহানুর রহমান সোহানের হাতে। তিনি নতুন মুখের সন্ধান করতে থাকেন। এর মধ্যে নায়িকা হিসেবে নবাগত মৌসুমীকে পেয়েও নায়ক নিয়ে চিন্তায় পড়ে যান।

একদিন তিনি ইমন নামের একটি ছেলেকে দেখেই পছন্দ করেন, যার পুরো নাম চৌধুরী মোহাম্মদ সালমান শাহরিয়ার। তাকে প্রথমে ‘সনম বেওয়াফা’র রিমেক করার প্রস্তাব দিলেও তিনি ‘কেয়ামত সে কেয়ামত তক’ সিনেমাটি পছন্দ করেন।

ইমন জানান, এই সিনেমাটি ২৬ বার দেখেছেন। পরিচালক সোহানুর রহমান সোহান তার সম্মতিতেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ সিনেমাটি তৈরি করবেন।

শুটিং শেষে ১৯৯৩ সালের ২৫ শে মার্চ ছবিটি মুক্তি পায়। তারপরই নায়ক সালমান শাহ্্কে নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়। এরপর একের পর এক সুস্থ্যধারার চলচ্চিত্র উপহার দিতে থাকেন তিনি। তার মোট ২৭টি সিনেমা মুক্তি পেয়েছিলো। দু একটি বাদে সবগুলোই ছিলো সুপারহিট।

সালমান শাহর অভিনয় দক্ষতা, সংলাপে সাবলীলতা, সময়কে ছাড়িয়ে যাওয়া স্টাইল, ফ্যাশন দিয়ে বাংলা চলচ্চিত্রে যিনি আসন গেড়ে বসেছিলেন, ক্রমেই বাংলা সিনেমাকে নিয়ে যাচ্ছিলেন নতুন উচ্চতায়। একঘেয়ে অভিনয় আর স্টাইল দেখতে দেখতে ক্লান্ত দর্শকদের সামনে তিনি হয়ে আসেন নতুন প্রত্যাশার বাতিঘর হিসেবে। তার রোমান্টিক, মেলোড্রামা, ফ্যামিলি ড্রামা, অ্যাকশন, প্রতিবাদ সব চরিত্রেই ছিলো নতুনত্বের স্বাদ। তার কাউবয় হ্যাট, গগলস, লং কোটে ডিটেকটিভ লুক, হুডি শার্ট, ব্যাক ব্রাশ করা চুল, কানে দুল, ফেড জিন্স, মাথার স্কার্ফ, ফ্যাশন সেন্স- সবকিছু মিলিয়ে তিনি হয়ে ওঠেছিলেন তারুণ্যের স্টাইল আইকন।

তার অভিনিত ২৭টি সিনেমার মধ্যে ১৪টি ছবির জুটি ছিলেন নায়িকা শাবনূর। কবরী-রাজ্জাক জুটির পর সালমান-শাবনূর জুটিই এদেশের দর্শকদের পছন্দের শীর্ষে রয়ে গেছে। শাবনূর ছাড়াও মৌসুমী, শাহনাজ, লিমা, কাঞ্চি, শাবনাজ, বৃষ্টিসহ কয়েকজন নায়িকার সাথেও জুটি বেঁধেছিলেন তিনি।

রোমান্টিক ও মেলোড্রামায় বেশি কাজ করলেও তার চরিত্রগুলোতে বৈচিত্র ছিলো। কখনও ছাত্রনেতা, কখনও প্রতিবাদী যুবক, কখনও গ্রামের ছেলে, কখনও প্রেমের জন্য ঘরছাড়া তরুণের চরিত্রে অভিনয় করেছেন। সিনেমায় শুধু অভিনয় আর ফ্যাশনই নয়, গানও ছিলো আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে। তার প্রতিটি সিনেমাই ছিলো চমকপ্রদ গানে ভরপুর। ইতিমধ্যে অনেক গানই কালজয়ী হিসেবে স্থান করে নিয়েছে।

সালমানের সহজাত অভিনয় দক্ষতা ও চরিত্রের সাথে মিশে যাওয়ার গুণটা ছিলো প্রবল। তার প্রথম ছবি কেয়ামত থেকে কেয়ামত যারা দেখেছেন, তারা সালমানের সপ্রতিভ ও সহজাত অভিনয় দেখে যে কারও মনে হওয়ার উপায় ছিলো না ওটাই ছিলো তার প্রথম চলচ্চিত্র। চার বছরের ছোট্ট ফিল্ম ক্যারিয়ারে যা করে গেছেন, যেসব নাটকে অভিনয় করে গেছেন সেগুলোই তাকে অমর অভিনেতার সম্মান দিয়েছে।

১৯৮৫ সালে সালমান শাহর অভিনয় জীবন শুরু হয়। বিটিভিতে, হানিফ সংকেতের গ্রন্থনায় ‘কথার কথা’ নামক একটি ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ছিল। অনুষ্ঠানটিতে একটি গানে মাদকাসক্ত এক তরুণের ভূমিকায় অভিনয় করেন তিনি। যে গানটি গেয়েছিলেন হানিফ সংকেত নিজেই। সে বছর বিটিভির আকাশ ছোঁয়া নাটকের মাধ্যমে তার অভিষেক হয় টিভি নাটকে। এরপর পরে দেয়াল (১৯৮৫), সব পাখি ঘরে ফিরে (১৯৮৫), সৈকতে সারস (১৯৮৮), নয়ন (১৯৯৫), স্বপ্নের পৃথিবী (১৯৯৬) নাটকেও অভিনয় করেন তিনি।

‘নয়ন’ নাটকটি সে বছর শ্রেষ্ঠ একক নাটক হিসেবে বাচসাস পুরস্কার লাভ করে। এছাড়াও তিনি ১৯৯০ সালে মঈনুল আহসান সাবের রচিত উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত ‘পাথর সময়’ ও ১৯৯৪ সালে ‘ইতিকথা’ ধারাবাহিক নাটকে অভিনয় করেন। প্রেমযুদ্ধ ও ঋণশোধ চলচ্চিত্রে প্লেব্যাকও করেন তিনি। মিল্ক ভিটা, জাগুয়ার কেডস, ইস্পাহানি গোল্ড, স্টার টি, কোকাকোলা, ফান্টাসহ কয়েকটি পণ্যের বিজ্ঞাপনচিত্রেও অভিনয় করেন।

১৯৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর শুক্রবার প্রিয় নায়ক সালমান শাহ্্র মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে চলচ্চিত্রপ্রেমীদের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে। ওইদিন সকাল ১১টায়ই প্রিয় নায়ক সালমান চলে যান না ফেরার দেশে। মৃত্যুর পর সালমানের বাবা কমরউদ্দিন চৌধুরী রাজধানীর রমনা থানায় অপমৃত্যুর মামলা করেন। ময়নাতদন্ত শেষে রিপোর্ট আসে আত্মহত্যাজনিত মৃত্যু হয়েছে সালমানের। কিন্তু সালমানের মা-বাবা দু’জনেই ওই রিপোর্টে নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে নারাজি দেন। ফলে বিচারক তার লাশ কবর থেকে তুলে পুনরায় ময়নাতদন্তের নির্দেশ দেন। সিলেটের ওসমানি মেডিকেল কলেজের ময়না তদন্তের চিকিৎসক ‘কৌশলগত কারণে’ তখন ময়নাতদন্ত রিপোর্ট নিয়ে কোনো মন্তব্য না করার ফলে সন্দেহটা গাঢ় হয়ে দেখা দেয় তার পরিবার ও ভক্তদের মধ্যে।

তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশে মামলাটি গোয়েন্দা পুলিশের হাত থেকে সিআইডিতে যায়। সিআইডি তদন্ত করাকালীন হঠাৎ করেই আবার মামলাটি সিআইডি থেকে গোয়েন্দা পুলিশে হস্তান্তরিত হয়। অবশেষে ২০১৭ সালে মামলাটি পুলিশের নতুন গোয়েন্দা সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয়।

সালমান শাহর জন্ম ১৯৭১ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর সিলেট নগরীর দাড়িয়াপাড়ায়। বাবা কমরউদ্দিন চৌধুরী সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন। মা নীলা চৌধুরী করতেন রাজনীতি। একাধিকবার সংসদ নির্বাচনও করেছেন। সালমানের একমাত্র ছোট ভাইয়ের নাম চৌধুরী মোহাম্মদ শাহরান (ইভান)।

১৯৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর ১১/বি নিউ ইস্কাটন রোডের ইস্কাটন প্লাজার বাসার নিজ কক্ষে ফ্যানের সঙ্গে সালমান শাহ্্’র ঝুলন্ত দেহ পাওয়া যায়। প্রথমে হলি ফ্যামেলি হাসপাতাল, পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করে।

ঢাকাটাইমস/১৪সেপ্টেম্বর/কারই/ইএস

সংবাদটি শেয়ার করুন

বিনোদন বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :