রোহিঙ্গা সংকট: দরকার বিকল্প পরিকল্পনা

মাসুদ কামাল
 | প্রকাশিত : ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ১১:০৯

রোহিঙ্গাদের তাদের দেশ মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর জন্য দুই দফা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। উদ্যোগটা নেওয়া হয়েছে দুইপক্ষের সম্মতির মাধ্যমে। মিয়ানমারের আমরা যতই সমালোচনা করি না কেন, প্রকৃত সত্য হচ্ছে এই যে, গত মাসে তিন হাজার রোহিঙ্গা পরিবারকে পাঠানোর জন্য তালিকা করা হয়েছিল, তারা যেতে রাজি হলে কিন্তু মিয়ানমার তাদেরকে ফিরিয়ে দিতো না। সে জন্য তাদের প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি ছিল। সেই প্রস্তুতির প্রকৃতি নিয়ে অনেকেরই আপত্তি থাকতে পারে, কিন্তু প্রস্তুতি অবশ্যই একটা ছিল।

মাঝে বিবিসির একটা প্রতিবেদন দেখলাম। সেখানে দেখা গেল সীমান্তের ওপারে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের লোকজন, বিশেষ করে সেনাবাহিনীর লোকেরা টেবিল চেয়ার নিয়ে অপেক্ষা করেছে। প্রায় প্রতিটা টেবিলে ল্যাপটপগুলো খোলা অবস্থায় রয়েছে, নিরাপত্তা পরীক্ষার কিছু যন্ত্রপাতি, আর একটু পরপর অস্ত্র হাতে সেনাবাহিনীর লোকেরা হাঁটাহাঁটি করছে। সব মিলিয়ে কোনো হৈ-হট্টগোল নেই। তবে যে নীরবতা দৃশ্যমান, তাতে যেন অদৃশ্য এক ভীতি বিরাজ করছে। আমি নিশ্চিত, এমন দৃশ্য আর প্রস্তুতি দেখামাত্র যেকোনো রোহিঙ্গার অন্তরাত্মা শুকিয়ে যাবে। মনে পড়বে তাদের দু’বছর আগের সেই আতঙ্কের কথা। তাহলে কে আর ফিরে যেতে চাইবে? তারপরও এই রোহিঙ্গাদের একজনেরও ফিরে না যাওয়া, এর দায়টা আসলে শেষ পর্যন্ত পড়বে কাদের ওপর?

মিয়ানমার সরকার এখন বলছে, এই যে প্রত্যাবাসন হচ্ছে না, এর দায় মূলত বাংলাদেশের। কারণ রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর দায়িত্ব ছিল বাংলাদেশের। বাংলাদেশ সেটা পারেনি, ব্যর্থ হয়েছে। ফলে দায়টা তাদেরই। মিয়ানমার এরই মধ্যে বলেছে, তারা অপেক্ষা করেছে, কিন্তু বাংলাদেশ থেকে কেউ যায়নি। মিয়ানমারের দিক থেকে প্রস্তুতিটা কি? তারা বেশ কিছু ক্যাম্প বানিয়েছে। বলছে, এগুলো হচ্ছে অন্তর্বর্তীকালীন ক্যাম্প।

বাংলাদেশ থেকে যারা যাবে, তাদেরকে প্রথমে নিয়ে ঢুকানো হবে এসব ক্যাম্পে। তারপর এখান থেকে ধীরে ধীরে যার যার গ্রামে পাঠানো হবে।

এই যে ক্যাম্প তৈরি করে রাখা, এগুলো কি রোহিঙ্গাদের জন্য কোনো বিবেচনাতেই স্বস্তিকর? মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের ধারণা, এই অন্তর্বর্তীকালীন ক্যাম্পগুলো আসলে হবে তাদের বন্দিশালা। জীবন হবে তাদের আগের চেয়েও কষ্টকর, দুর্বিষহ। হয়তো বাকি জীবন এসব বন্দিশালায় কাটাতে হবে তাদেরকে। মুখোমুখি হতে হবে কঠিন নির্যাতনের। তখন সেই সব নির্যাতনের খবর আর বাইরেও আসবে না।

আবার অন্তর্বর্তীকালীন ক্যাম্প থেকে রোহিঙ্গাদেরকে তাদের গ্রামে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা যে বলা হচ্ছে, সেগুলোই বা কতটুকু বাস্তবসম্মত? তাদের সেই গ্রামগুলো কি এখন বসবাসের উপযোগী আছে? তাদের ফেলে আসা জায়গায় এখন কি নানা ধরনের সরকারি স্থাপনা গড়ে ওঠেনি? তাহলে এরা গিয়ে উঠবে কোথায়? থাকবে কোথায়? মাঝেমধ্যে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার লোকজন মিয়ানমারে যায়। সেখানকার সরকার তাদেরকে জানায় যে, তারা এখন রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে প্রস্তুত। কিন্তু সেই প্রস্তুতি বাস্তবে আসলে কতটুকু সম্পন্ন হয়েছে, সেটা সরেজমিনে আর কাউকেই তারা দেখায় না। দেখাবে কিভাবে? যে গ্রামগুলোতে রোহিঙ্গারা থাকতো, সেগুলোর তো কোনো অস্তিত্বই আর নেই। তার মানে ফিরে গেলে রোহিঙ্গাদের জীবন হবে ভয়ংকর কষ্টকর। অন্তত এখনকার জীবনের চেয়ে হাজার গুণ খারাপ। ভালো রেখে খারাপের দিকে কেউ কি আর যেতে চায়?

সে এক রিপোর্টে দেখলাম, মিয়ানমার নাকি এখন বাংলাদেশ থেকে কেবল বাস্তুচ্যুত হিন্দুদের ফেরত নিতে চায়। কারণ হিন্দুরা স্বেচ্ছায় ফিরতে ইচ্ছুক, আর মুসলিমরা ফিরতে ইচ্ছুক নয়। তাহলে এর অর্থ কি দাঁড়াচ্ছে? বাংলাদেশ মুসলিমপ্রধান রাষ্ট্র বলে মুসলিম রোহিঙ্গাদের তারা বাংলাদেশেই রাখতে চায়। কেউ কেউ এমনও বলে থাকেন, ভারতের চাপেই তারা কেবল হিন্দু রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে আগ্রহী। মুসলিমদের ব্যাপারে ভারত, চীন বা এরকম কোনো রাষ্ট্রের কাছ থেকে চাপ এলে হয়তো তাদেরকেও ফেরত নিতো। কিন্তু মুসলিম রোহিঙ্গাদের জন্য সেরকম চাপ দেওয়ার তো কেউ নেই।

সব মিলিয়ে বাস্তবতা হচ্ছে, রোহিঙ্গা সংকট থেকে আমাদের জনবহুল এবং দরিদ্র দেশের কোনো মুক্তি নেই। কিছু দিন পরপরই দেখা যায় রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে নানা ধরনের সভা-সেমিনার হচ্ছে। সেখানে বক্তারা এই সমস্যা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে, এর সমাধান না হলে কি ধরনের আঞ্চলিক সংকট তৈরি হতে পারে তা নিয়েও আশঙ্কা প্রকাশ করে। কিন্তু এই সমস্যার সমাধানটা কি সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো দিক-নির্দেশনা থাকে না। সমাধান বলতে তারা কেবল একটাই দেখেন, আর সেটা হচ্ছেÑ এই বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গাকেই মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো।

কিন্তু বাস্তবতা কি বলে? এই এগার লাখ (যা আবার প্রতিদিনই বাড়ছে) রোহিঙ্গাকে কি আদৌ মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো সম্ভব হবে? যদি না হয়, তাহলে কি হবে? আমাদের হাতে কি কোনো বিকল্প পরিকল্পনা আছে? এখন পর্যন্ত সরকারের কাছ থেকে সেরকম বিকল্প কোনো পরিকল্পনার কথা শোনা যায়নি। অবশ্য থাকলেও কৌশলগত কারণেই সরকারের পক্ষে তা প্রকাশ করা সম্ভব নয়। হয়তো আছে, হয়তো নেই। তবে থাকা উচিত। কেবল উচিত নয়, তা নিয়ে কাজ শুরু করাও জরুরি।

আমার ধারণা, মিয়ানমার রোহিঙ্গাদেরকে কখনোই ফেরত নেবে না। নেবে যে না, সেটা বুঝতে কষ্ট হয় না। মিয়ানমার সরকার এখনো তাদেরকে রোহিঙ্গা হিসাবে স্বীকারই করে না। এদেরকে অভিহিত করে তারা ‘বাঙালি’ হিসাবে। বলেÑ এই বাঙালিরা নাকি সেই ব্রিটিশ আমল থেকে এখান থেকে গিয়ে ওদের দেশে বসতি গড়েছে। সে কারণেই আন্তর্জাতিক চাপে যখন তারা এদেরকে ফেরত নেওয়ার কথা বলতে শুরু করেছে, তারা কিন্তু শর্ত দিয়েছেÑ ফেরত নিলেও তারা এদেরকে নাগরিকত্ব দেবে না। বড়জোর প্রত্যেককে ন্যাশনাল ভেরিফিকেশন কার্ড দেবে, আর দেবে চলাফেরার স্বাধীনতা। এভাবে নাগরিকত্ব ছাড়া যদি রোহিঙ্গারা ফিরে যায়, তাহলে প্রকারান্তরে তাদেরকে নিজেদের বাঙালি বলেই স্বীকার করে নিতে হবে। ঠিক এ কারণেই বেশির ভাগ রোহিঙ্গা আর মিয়ানমারে ফিরে যেতে রাজি হচ্ছে না।

মিয়ানমার ওখানে রোহিঙ্গাদের জন্য কি কি সুযোগ-সুবিধা দেবে, সেটা তাদের ব্যাপার। তবে আমাদের উচিত হবে এখানে তাদের সুযোগ-সুবিধা কিছু কমিয়ে দেওয়া। বেশি সুযোগ-সুবিধা এখানে পেলে তারা যেতে চাইবে কেন? তবে সুযোগ-সুবিধা কতটুকু কি কমানো হবে, সেটাও চিন্তাভাবনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। এই যে হঠাৎ করে মোবাইল নেটওয়ার্ক বন্ধের কথা বলা হলো, এটাকে খুব একটা সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত বলা যায় না। বরং আমি তো মনে করি প্রত্যেকটি রোহিঙ্গাকে বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে মোবাইল ফোন দেওয়া উচিত। এতে বরং তাদেরকে খুব ক্লোজভাবে মনিটরিং করা যাবে। রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে আমার বিবেচনায় সবচেয়ে বড় ভুল হয়েছে, মাত্র তিন মাসের মাথায় মিয়ানমারের সঙ্গে একটা দ্বিপাক্ষিক সমঝোতা করা। এ সমঝোতার মাধ্যমে রোহিঙ্গা সংকটকে বাংলাদেশ এবং মিয়ানমারের দ্বিপক্ষীয় বিষয় হিসেবে আবদ্ধ করা হয়েছে, যাতে বাংলাদেশের কোনো লাভ হয়নি। বরং এরকম করাতে আমরা আন্তর্জাতিক বিভিন্ন শক্তিকে এই কাজের সঙ্গে জড়িত করতে পারছি না।

তবে কিছু অর্জনও যে হয়নি তা বলা যাবে না। একেবারে শুরুর দিকেই, এক মাসের মধ্যেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে বিষয়টি নিয়ে গেছেন, সেখানে ভাষণ দিয়েছেন। সারা দুনিয়া জেনেছে, মিয়ানমার কি করেছে, আর এর বিপরীতে আমরা কি করেছি। এটা কিন্তু আমাদের জন্য কম অর্জন নয়। বর্তমান সময়ে আন্তর্জাতিক পরিচিতি একটা বড় বিষয়। কোনো কিছু পেতে হলে, বারগেইন করতে হলে, পরিচিতিটা গুরুত্বপূর্ণ। সেই পরিচিতি আমরা পেয়েছি। কেবল পরিচিতি নয়, ইতিবাচক পরিচিতি। এখন দেখার বিষয় হলো, এই ইতিবাচক ইমেজকে আমরা কিভাবে কাজে লাগাতে পারি।

প্রত্যাবাসন প্রচেষ্টার পাশাপাশি আমাদের আরও কিছু বিকল্প পথের কথা চিন্তা করতে হবে। রোহিঙ্গাদেরকে অন্য কোনো দেশে পাঠানোর কথা ভাবা যেতে পারে। পৃথিবীতে অনেক দেশই আছে, যেখানে জনসংখ্যার ঘনত্ব খুবই কম। সেসব দেশে পাঠানোর জন্য কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালানো যেতে পারে। এই সংকটে যে সকল মুসলিম দেশ নানাভাবে সমবেদনা প্রকাশ করেছে, সমবেদনার ভান করেছে, তাদেরকেও বলা যেতে পারে কিছু সংখ্যক রোহিঙ্গাকে তাদের দেশে নেওয়ার জন্য। এই নেওয়ার জন্য কূটনৈতিক দূতিয়ালীটা ভালোভাবে করা গেলে সফল হওয়ার সম্ভাবনা যে একেবারেই থাকবে না তা বলা যাবে না।

ইদানীং একটা প্রবণতা খুব লক্ষ্য করা যাচ্ছে, জাতীয় পরিচয়পত্র কিংবা পাসপোর্ট করতে গিয়ে ধরা পড়ছে রোহিঙ্গারা। আমার এক সাবেক সহকর্মী, যিনি এখন প্রবাসে রয়েছেন, সেদিন আমাকে ফোন করে কিছু কথা বললেন। তিনি বললেনÑ আচ্ছা, রোহিঙ্গারা পাসপোর্ট করলে আমাদের অসুবিধা কি? পাসপোর্ট করে তারা যদি বিদেশে চলে যায়, তাহলে তো ভালোই, আমাদের মাটি থেকে একটি আপদ তো দূর হলো। ওরা যদি বাইরে চলে যেতে পারে, আমাদের বরং উৎসাহ দেওয়া উচিত।

আচ্ছা, আমার বন্ধুটি কি খুব একটা ভুল বলেছেন?

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :