ক্রিসেন্ট গ্রুপের অর্থ জালিয়াতি

পলাতক আজিজের ‘মাসুদ রানা’ যজ্ঞ

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকাটাইমস
| আপডেট : ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ১২:১৬ | প্রকাশিত : ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ১১:৩৮

জনতা ব্যাংকের টাকা আত্মসাৎ ও বিদেশে টাকা পাচারের অভিযোগে মামলায় জাজ মাল্টিমিডিয়ার কর্ণধার আব্দুল আজিজ (এম এ আজিজ) পলাতক হলেও নানা রোশনাই নিয়ে চলছে তার বৃহৎ বাজেটের ছবি ‘মাসুদ রানা’র নির্মাণযজ্ঞ। অর্থ আত্মসাৎ মামলার আসামির মালিকানাধীন সব প্রতিষ্ঠানই তদন্তের আওতায় আসা উচিত বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

৮৩ কোটি টাকার ছবি ‘মাসুদ রানা’র নায়ক চরিত্র বাছাইয়ের জন্য ইতিমধ্যে চ্যানেল আইয়ের মাধ্যমে কাজ প্রায় শেষ। আবার হলিউড থেকে কো-প্রযোজক এসে চ্যানেল আইয়ের বাইরে থেকে অডিশন নিয়ে গেছে কয়েকজনের। এ নিয়ে প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান জাজ মাল্টিমিডিয়ার সঙ্গে দ্বন্দ্বের উপক্রম চ্যানেল আইয়ের।

একটি সূত্র জানায়, গ্রেপ্তার এড়াতে পালিয়ে থাকার কারণে আব্দুল আজিজ সরাসরি তত্ত্বাবধান করতে পারেননি বলে চ্যানেল আইয়ের রিয়েলিটি শোর মাধ্যমে ‘মাসুদ রানা’য় আস্থা রাখতে পারছেন না। তাই হলিউড থেকে প্রতিনিধির মাধ্যমে নিজের নির্দেশনামতো বাইরের কয়েকজনের অডিশন নিয়েছেন মাসুদ রানা নির্বাচনের জন্য।

বিদেশে টাকার পাচার মামলায় আব্দুল আজিজ পালালেও তার ভাই ক্রিসেন্ট গ্রুপের কর্ণধার এম এ কাদের গ্রেপ্তার হয়ে এখন কারাগারে। গত ৩০ জানুয়ারি এম এ কাদেরকে গ্রেপ্তার করে গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর। পরে ৯১৯ কোটি ৫৬ লাখ টাকা বিদেশে পাচারের অভিযোগে কাদের ও আজিজসহ ক্রিসেন্ট গ্রুপ সংশ্লিষ্টদের পাশাপাশি ১৩ ব্যাংক কর্মকর্তাকে আসামি করে মামলা করে সংস্থাটি।

গ্রেপ্তার এম এ কাদের আদালতে দোষ স্বীকার করে টাকা ফেরত দেওয়ার অঙ্গীকার করলেও ব্যাংকে টাকা ফেরত আসেনি এখনো।

এই দুই ভাইয়ের নামে মামলা আছে দুদকেরও। জনতা ব্যাংকের ১ হাজার ৭৪৫ কোটি ৬৬ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে গত ফেব্রুয়ারি মাসে এম এ কাদেরসহ ২২ জনের বিরুদ্ধে পাঁচটি মামলা করে দুদক। মামলার অন্যতম আরেক আসামি এম এ কাদেরের ভাই রিমেক্স ফুটওয়ারের চেয়ারম্যান আব্দুল আজিজ। তারই প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান জাজ মাল্টিমিডিয়া।

রাজধানীর চকবাজার থানায় করা এসব মামলার তদন্ত চলছে বলে জানান দুদকের উপপরিচালক প্রণব কুমার ভট্টাচার্য।

ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, ক্রিসেন্ট ফুটওয়ার প্রতিষ্ঠানটি চামড়া রপ্তানির আড়ালে জালিয়াতি করে জনতা ব্যাংক থেকে বের করে নেয় তিন হাজার ৫৭২ কোটি টাকা। এই টাকা ফেরত না দেওয়ায় প্রতি প্রান্তিকেই স্থিতি বাড়ছে ঋণের।

অর্থপাচারের দায়ে ভাই কাদের গ্রেপ্তার হওয়ার পর থেকে পলাতক আব্দুল আজিজ বর্তমানে দেশে না বিদেশে অবস্থান করছেন, তা নিশ্চিত নয় দুদক কিংবা শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর। তবে আব্দুল আজিজসহ মামলার বাকি আসামিদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি আছে বলে গণমাধ্যমকে জানান শুল্ক গোয়েন্দা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শহিদুল ইসলাম।

শুল্ক গোয়েন্দা অধিদপ্তরের মামলায় অভিযোগ করা হয়, ক্রিসেন্ট গ্রুপের তিনটি প্রতিষ্ঠানের রপ্তানি বিলের বিপরীতে জনতা ব্যাংক থেকে নেওয়া অর্থের মধ্যে ৯১৯ কোটি ৫৬ লাখ দেশে ফেরত আসেনি। এর মধ্যে আবদুল আজিজের রিমেক্স ফুটওয়্যার ৪৮১.২৬ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছে।

২০১১ সালে দেশের চলচ্চিত্র জগতে হঠাৎ করে আলোড়ন তোলে জাজ মাল্টিমিডিয়া। এরপর কলকাতা ও বাংলাদেশের শিল্পীদের নিয়ে বেশ কয়েকটি সিনেমা বানিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের অবস্থা বদলে দেওয়ার ঘোষণা দিয়ে দেশের অনকেগুলো প্রেক্ষাগৃহ যন্ত্রপাতিসহ নানা সুবিধা সংযোজনের মাধ্যমে বিপুল ব্যয় করে সেগুলো নিজের নিয়ন্ত্রণে নেন আব্দুল আজিজ।

তার এসব অর্থের উৎস নিয়ে প্রশ্ন উঠছে এখন। আজিজের জাজ মাল্টিমিডিয়া তদন্তের আওতায় আসতে পারে মনে করেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। তিনি ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘দুদকের মামলায় আসামি পলাতক আছে। এ ক্ষেত্রে পুরো বিষটি তদন্তের স্বার্থে তার অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোও তদন্তের আওতায় আনা প্রয়োজন। আসামির অন্যান্য যে ব্যবসা আছে সেগুলোর ক্ষেত্রেও তদন্ত হতে পারে।’

‘ভালোবাসার রং’ ছবির মধ্য দিয়ে প্রযোজক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করা আব্দুল আজিজের সব ছবিই ছিল বড় বাজেটের। প্রায় সব ছবির শুটিং থেকে শুরু করে মুক্তি পর্যন্ত নানাভাবে আলোচনায় থাকতেন তিনি। ছবির প্রমোশনেও নিয়মিত দেখা গেছে তাকে। কিন্তু গত ফেব্রুয়ারি থেকে কোথাও তার উপস্থিতি নেই। এমনকি তার সর্বশেষ ছবি ‘প্রেম আমার-২’ দেশের ৫৬টি সিনেমা হলে মুক্তির সময়ও তার কোনো ধরনের উপস্থিতি দেখা যায়নি কোনো মাধ্যমে। এমনকি এই সময়ে মাসুদ রানার খোঁজার কোনো কর্মসূচিতেও তার নাম উচ্চারিত হয়নি।

মূলত গত ৩০ জানুয়ারি ক্রিসেন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান এম এ কাদেরকে গ্রেপ্তারের পর থেকে লাপাত্তা এম এ আজিজ। তাদের অনুপস্থিতিতে তাদের সম্পদ নিলাম ডেকেও পাওনা টাকা আদায় করতে পারেনি জনতা ব্যাংক। নিলামকৃত সম্পদের মধ্যে ছিল বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় সাড়ে ১৬ শতাংশের প্লট, সাভার ও হাজারীবাগে জমি, যন্ত্রপাতিসহ কারখানা, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য।

এসব টাকা কীভাবে উদ্ধার হবে, কিংবা উদ্ধারে কী ব্যবস্থা নিয়েছে ব্যাংক। চানতে চাইলে জনতা ব্যাংকের জনসংযোগ বিভাগের উপ-মহাব্যবস্থাপক মিজানুর রহমান ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘খেলাপি ঋণ আদায়ের জন্য আমরা ইতোমধ্যে একটি কমিটি করেছি। চলতি বছরে খেলাপি ঋণ আদায়ে যা যা করা দরকার সব করা হবে।’

‘মাসুদ রানা’র খবর

কথাসাহিত্যিক কাজী আনোয়ার হোসেনের ‘মাসুদ রানা’ সিরিজের প্রথম পর্ব ‘ধ্বংস পাহাড়’ অবলম্বনে নির্মীয়মান ইংরেজি ‘এমআর-৯’ আর বাংলা ‘মাসুদ রানা’ ছবিটি বিশ্বব্যাপী মুক্তি পাবে ২০২০ সালে। ৮৩ কোটি টাকা বাজেটের এই ছবির শুটিং হওয়ার কথা বাংলাদেশের পাশাপাশি থাইল্যান্ড ও মরিশাসে। ছবিতে বলিউড ও হলিউডের বেশ কয়েকজন অভিনেতা-অভিনেত্রী কাজ করবেন বলে জাজা মাল্টিমিডিয়ার দাবি।

ছবির মূল চরিত্র মাসুদ রানার খুঁজে গত বছরের নভেম্বরে চ্যানেল আইয়ে শুরু ‘কে হবে মাসুদ রানা’ শিরোনামের রিয়েলিটি শো। সেখানে চূড়ান্তভাবে তিনজন নির্বাচিত হয়েছেন ইতিমধ্যে। কিন্তু তাদের বাইরে থেকে কেউ মাসুদ রানা হতে পারেন বলে খবর প্রচার হচ্ছে।

এ নিয়ে চ্যানেল আইয়ের সঙ্গে জাজ মাল্টিমিডিয়ার একরকম দ্বন্দ্ব চলছে বলেও শোনা যাচ্ছে। জাজের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আলিমউল্লাহ খোকনও গণমাধ্যমকে বলেছেন, প্রতিযোগিতার বাইরে থেকেও ‘মাসুদ রানা’ চরিত্রটির জন্য যে কেউ চূড়ান্ত হতে পারেন!

অথচ চ্যানেল আইয়ের টিভি রিয়েলিটি শো থেকেই মাসুদ রানা নির্বাচনের জন্য চ্যানেল আইয়ের সঙ্গে আবদুল আজিজের কথা রফা হয়েছে বলে জানা যায়। কিন্তু জাজের প্রধান নির্বাহী তা স্বীকার-অস্বীকার কিছুই করছেন না। তিনি বলেন, ‘জাজ মাল্টিমিডিয়ার চেয়ারম্যান আবদুল আজিজ। তার সঙ্গে কোনো চুক্তি হয়েছে কি না আমার জানা নেই। চ্যানেল আইও এ বিষয়ে আমাদের অফিসে কোনো ডকুমেন্ট সাবমিট করেনি এখনো।’ যৌথ প্রযোজনার এই ছবিতে রয়েছেন হলিউডডের একজন প্রযোজক। চ্যানেল আইয়ের বাইরে থেকে মাসুদ রানা বাছাইয়ের জন্য দেশে এসেছিলেন হলিউডের প্রযোজক, পরিচালক ও ফাইটিং টিম। তারা সেখানে ‘ঢাকা অ্যাটাক’ তারকা এ বি এম সুমন ও ‘বেপরোয়া’ ছবির নায়ক রোশানের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। তাদের সঙ্গে অবশ্য চ্যানেল আইয়ের প্রতিযোগিতার তিনজনও ছিলেন।

ধারণা করা হচ্ছে, আবদুল আজিজ এখন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন। যেহেতু তিনি চ্যানেল আইয়ের কার্যক্রম সরাসরি দেখভাল করতে পারেননি না, তাই এই শো থেকে বাছাই ‘মাসুদ রানা’ নিয়ে তিনি আশ্বস্ত হতে পারছেন না। ছবির অন্য প্রযোজক ও পরিচালককে পাঠিয়ে নিজের নির্দেশনামতো যাচাই করে নিয়েছেন।

(ঢাকাটাইমস/১৬সেপ্টেম্বর/জেআর/মোআ)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বিশেষ প্রতিবেদন বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :