জীবন সংগ্রামে জয়ী এক মহানায়কের গল্প

ঢাকাটাইমস ডেস্ক
 | প্রকাশিত : ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ১৫:০২

রেস্তোরাঁয় বসে মুচমুচে ভাজা মাংসে কামড় দিয়ে উল্টো দিকের দেয়ালে আপনি তাঁর ছবি দেখেছেন। চশমা পরা সদাহাস্যময় এক বৃদ্ধ। জানেন কি, তাঁর এই রেসিপিকে জনপ্রিয় করতে ওই বৃদ্ধকে অপেক্ষা করতে হয়েছিল জীবনের ৬২টি বসন্ত। এর আগেও কম রোমাঞ্চকর ছিল না তাঁর চলার পথ। তিনি কর্নেল স্যান্ডার্স। কেন্টাকির ভাজা মুরগিকে পৌঁছে দিয়েছেন বিশ্বের কোণায় কোণায়।

পুরো নাম হারল্যান্ড ডেভিড স্যান্ডার্স। আমেরিকার ইন্ডিয়ানায় জন্ম ১৮৯০ সালের ৯ সেপ্টেম্বর। বাবা উইলবার ছিলেন কৃষক। মা মার্গারেট ব্যস্ত থাকতেন ঘর-সংসার নিয়ে। মার্গারেট ছিলেন ধর্মপ্রাণ ক্যাথলিক। তিন ভাই-বোনের মধ্যে সবথেকে বড় ছিলেন হারল্যান্ড।

হারল্যান্ডের বয়স যখন পাঁচ, হঠাৎই তার বাবা মারা যান। আর গৃহবধূ থাকতে পারলেন না মার্গারেট। উপার্জনের জন্য বেরোতে হল তাঁকে। ছোট দুই ভাই-বোনকে দেখভালের দায়িত্ব পড়ল হারল্যান্ডের উপর। তাদের খাওয়ানোর ব্যবস্থা করতে নিজেই মাথা খাটিয়ে বের করলেন মাংস আর পাউরুটি দিয়ে চটজলদি রকমারি পদ।

দুই বছরের মধ্যে হারল্যান্ড পাকা শেফ। দাদার হাতে তৈরি স্ন্যাক্স খুব পছন্দ করত খুদে দুই ভাই-বোন। কিন্তু বেশি দিন এই জীবনে থাকতে পারলেন না হারল্যান্ড। ১০ বছর বয়সে তাঁকেও যেতে হল খামারবাড়িতে কাজ করতে। এর দুই বছর পরে তা মা মার্গারেট আবার বিয়ে করলেন। কিন্তু সৎ বাবা কিছুতেই মেনে নিতে পারলেন না তিন সন্তানকে।

সৎ বাবার অত্যাচারে বিরক্ত ও হতাশ হারল্যান্ড বাড়ি ছাড়লেন মাত্র ১৩ বছর বয়সে। চলে গেলেন ইন্ডিয়ানার অন্য প্রান্তে। মায়ের অনুরোধে আশ্রয় জুটল এক আত্মীয়ের বাড়িতে। শুরু হল নানা রকমের জীবিকা সংস্থান। কী করনেনি হারল্যান্ড! বাসের কন্ডাক্টর, সেনাবাহিনীতে চাকরি, রেল ইঞ্জিনে বেলচা দিয়ে কয়লা ফেলা, কয়লার ইঞ্জিনের ছাই সাফাইয়ের কাজ- বিচিত্র ভূমিকায় দেখা গেছে হারল্যান্ডকে।

জীবন সংগ্রামের মাঝেই ১৯ বছর বয়সে জোসেফিনকে বিয়ে করেন। এই সংসারে জন্ম হয় এক ছেলে, দুই মেয়ের। পুত্রসন্তান শৈশবেই মারা যায় টনসিলের সংক্রমণে। রেলে চাকরির পাশাপাশি করেসপন্ডেন্স কোর্সে আইন বিষয়ে পড়তে শুরু করলেন হারল্যান্ড। কিন্তু কাজের জায়গায় বিবাদের জেরে চলে গেল চাকরি। প্রভাব পড়ল সংসারেও। দুই মেয়েকে নিয়ে স্ত্রী জোসেফিন চলে গেলেন তাঁর বাবা-মায়ের কাছে।

হারল্যান্ডের বদমেজাজের জন্য বারবার পড়তে হয়েছে বিপাকে। আইন পাশ করে শুরু করলেন প্র্যাক্টিস। ভালোই পসার জমেছিল। কিন্তু সেখানেও মক্কেলের সঙ্গে ঝামেলা। বন্ধ হয়ে গেল আইন প্র্যাক্টিস। বদমেজাজের জন্য ভাটা পড়েছিল মক্কেল-সংখ্যায়।

আবার শুরু হল রকমারি পেশা। জীবনবিমায় কিছুদিন কাজের পরে শুরু করলেন নিজের ফেরি সংস্থা। সেটাও বন্ধ করে আরম্ভ করলেন অ্যাসিটিলিন বাল্ব তৈরি। বন্ধ করে দিতে হল সেটাও। কারণ বাজারে এসে গেল ইলেকট্রিক বাল্ব।

থিতু হতে পারছিলেন না কোনওমতেই। নানা রকম কাজের সূত্রেই হারল্যান্ড এলেন কেন্টাকিতে। সেখানেও কিছু দিন এ কাজ, সে কাজের পরে তেল সংস্থায় চাকরি। কাজের ফাঁকে শুরু করলেন শৈশবের শখ, রান্না করা। নতুন করে ঝালিয়ে নিলেন পুরনো রেসিপি। যেগুলো বানিয়ে ছোট ভাই-বোনদের দিতেন খুদে হারল্যান্ড।

পরিচিতদের খাওয়াতে লাগলেন তাঁর তৈরি মাংস ভাজা। এরপর কেন্টাকির এক গ্যাস স্টেশনে, যেখানে তিনি কাজ করতেন, সাজিয়ে রাখলেন তাঁর তৈরি ফ্রায়েড চিকেন। খাবারের স্বাদ দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠায় তিনি এই ব্যবসাকেই গুরুত্ব দিলেন। ধীরে ধীরে ফ্রায়েড চিকেন বিক্রিই হয়ে উঠল তাঁর মূল ব্যবসা। তাঁর নতুন পরিচয় হল ‘কর্নেল অব কেন্টাকি’।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্য বন্ধ হয়ে গেল তাঁর ব্যবসা। কয়েক বছরের বিরতি। তারপর ১৯৫২ সালে আমেরিকার উটাতে সাউথ সল্টলেক এলাকায় আত্মপ্রকাশ করল হারল্যান্ড স্যান্ডার্সের রেসিপিতে তৈরি মাংসভাজার দোকান। যেহেতু যাত্রা শুরু হয়েছিল কেন্টাকি থেকে, তাই এর নাম হল, ‘কেন্টাকি ফ্রায়েড চিকেন’ সংক্ষেপে কেএফসি।

হারল্যান্ডের এই সাফল্যের পেছনে এক নারীর অবদান অনুঘটকের মতো কাজ করেছে। তিনি হারল্যান্ডের দোকানের কর্মী ক্লদিয়া। ১৯৪৭ সালে প্রথম স্ত্রী জোসেফিনের সঙ্গে বিয়ে ভেঙে যায় হারল্যান্ডের। তাঁর বাউন্ডুলেপনা মেনে নিতে পারেননি জোসেফিন। বিয়ে ভাঙার আগেই অবশ্য ক্লদিয়ার সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন হারল্যান্ড।

মূলত ক্লদিয়ার উৎসাহ আর অনুপ্রেরণায় পথ চলা শুরু করে কেএফসি। ক্লদিয়াকে ১৯৪৯ সালে বিয়ে করেন হারল্যান্ড। তবে কেএফসি নিয়েও বেশি দিন থাকতে পারেননি হারল্যান্ড। বেশি দিন কোনও কিছুই ভালো লাগত না তাঁর। একঘেয়ে লাগতে শুরু হওয়ায় ১৯৬৪ সালে দুই মিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে বিক্রি করে দেন কেএফসি। চুক্তি হয়েছিল, লোগোতে তাঁর ছবি থাকবে এবং মোটা পারিশ্রমিক পাবেন।

পরে তাঁর মনে হয়েছিল, কোম্পানির হাতবদলে তিনি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তাঁর আরও বেশি অর্থ পাওয়া উচিত ছিল। কিন্তু তত দিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে। নতুন মালিকের বিরুদ্ধে মামলা করেও সুবিধা করতে পারেননি তিনি।

জীবন নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষায় মেতে থাকা কর্নেল অব কেন্টাকি, হারল্যান্ড ডেভিড স্যান্ডার্স প্রয়াত হয়েছিলেন ১৯৮০ সালের ১৬ ডিসেম্বর। শুধু আমেরিকার কেন্টাকি নয়, তাঁর আস্তিনে লুকিয়ে থাকা গোপন রেসিপিতে আজ পরম তৃপ্তিতে আঙুল চাটছে সারা বিশ্ব।

ঢাকাটাইমস/১৬ সেপ্টেম্বর/এএইচ

সংবাদটি শেয়ার করুন

ফিচার বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :