অপরাধমুক্ত গ্রাম: দরজাহীন ঘর, তালাবিহীন ব্যাংক-থানা

ঘর ছেড়ে বাইরে কোথাও বের হলেও সবচেয়ে বড় চিন্তার বিষয় হয় দরজায় তালা লাগিয়েছি তো বা তালা কী ঠিকমতো আটকেছিল। কারণ ঘর ছেড়ে বাইরে গেলে তালা ঠিকমতো না লাগালে ঘরের সব জিনিসপত্র হাওয়া হওয়ার সম্ভাবনায় বেশি। তবে ভারতের মহারাষ্ট্রের এই গ্রামের বাসিন্দাদের মধ্যে এমন কোনো ভয় কাজ করে না। গ্রামের কোনো বাড়ি-দোকান বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে দরজা নেই। গ্রামে যে থানা ও সরকারি ব্যাংকের শাখা রয়েছে তাতে দরজা থাকলেও তালা লাগানো হয় না।

মহারাষ্ট্রে এমন একটা গ্রাম রয়েছে, যেখানে নির্ভয়ে জীবন কাটান বাসিন্দারা। এই গ্রামের কোনো বাড়িতেই দরজা লাগানো নেই। তাও ভিতরে টাকা-পয়সা, গয়না, দামি জিনিসপত্র চুরি যায় না! খবর আনন্দবাজারের।

গ্রামের নাম শনি-শিঙ্গাপুর। মহারাষ্ট্রের আহমেদনগর জেলায় অবস্থিত এটি। গ্রামে শুধুমাত্র বাড়ি নয় বরং দোকানপাট, স্কুল-কলেজ, সরকারি বিল্ডিং, ব্যাঙ্ক- কোথাও কোনো দরজা নেই।

গ্রামের বাসিন্দাদের বিশ্বাস, শনি দেবতা তাদের রক্ষা করবেন। শোনা যায়, আজ পর্যন্ত কোনো দিন চুরি হয়নি এই গ্রামে। গ্রামবাসীদের বিশ্বাস, কেউ যদি চুরি বা অপরাধ করার সাহস দেখায় তার জন্য তাকে পস্তাতে হবে। সারা জীবনের জন্য দৃষ্টিশক্তি হারাবেন তিনি।

গ্রামবাসীরা শনি দেবতাকে এতটাই মানেন যে, গ্রামের পাবলিক টয়লেটেও গোপনীয়তা বজায় রাখতে কোনো দরজা লাগাননি। কোনো ক্ষেত্রে মহিলাদের জন্য কাপড়ের পর্দা লাগানো থাকে। যাতে পর্দা দেওয়া দেখে অন্যেরা বুঝতে পারেন ভিতরে কেউ রয়েছেন।

শোনা যায়, ৩০০ বছর আগে গ্রামের প্রান্তে পানাস্নালা নদীতে একটা কালো পাথর ভেসে এসেছিল। এক গ্রামবাসী তাতে লাঠি দিয়ে আঘাত করার পরই পাথর থেকে রক্তক্ষরণ হতে শুরু করেছিল। সেটা কী তখনও জানতেন না গ্রামের কেউ। তবে ওই রাতেই নাকি গ্রামের প্রধানকে স্বপ্ন দিয়েছিলেন স্বয়ং শনি দেবতা। তিনি বলেছিলেন, ভেসে আসা ওই পাথর তারই মূর্তি। পাথরটাকে যেন গ্রামে প্রতিষ্ঠা করা হয়।

তবে স্বপ্নাদেশের একটি শর্তও ছিল তার। দেবতা নাকি তাকে আদেশ দিয়েছিলেন, এই পাথরের মূর্তি এতটাই শক্তিধর যে তাতে কোনো ছাদের তলায় রাখা যাবে না। চারপাশে কোনো দেয়াল যেন না থাকে যাতে তিনি সারা গ্রামকে বিনা বাধায় চোখের সামনে দেখতে পান এবং গ্রামকে সমস্তরকম বিপদ থেকে রক্ষা করার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিলেন।

স্বপ্নাদেশ পাওয়ার পর গ্রাম প্রধানের মনে এতটাই ভক্তির উদ্রেক হয় যে গ্রামবাসীদের সঙ্গে সম্মিলিত ভাবে সিদ্ধান্ত নেন দরজা বয়কট করার। নিজেদের রক্ষার ভার পুরোপুরি ওই ভেসে আসা পাথরের উপরই ছেড়ে দেন তারা।

এখনও যা কিছু তৈরি হোক না কেন তার কোনো দরজা থাকে না। ২০১১ সালে ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাঙ্ক এই গ্রামে তাদের শাখা খোলে। এই ব্যাঙ্ক দরজা লাগিয়েছে যদিও, তবে দরজায় কোনো তালা লাগানো হয় না। এটাই ভারতের প্রথম এবং একমাত্র লকলেস ব্যাঙ্ক।

গ্রামবাসীদের বিশ্বাস, যদি কোনো ব্যক্তি চুরি করেন বা কোনো অসৎ কাজ করেন তাহলে তার সাড়ে সাতি দশা চলবে। অর্থাৎ পরবর্তী সাড়ে সাত বছর ধরে তিনি এবং তার পরিবার দুর্ভাগ্য ভোগ করবেন। মামলা মোকদ্দমা ফাঁসা, পথ দুর্ঘটনা, মৃত্যু বা ব্যবসায় ক্ষতি- এরকম যেকোনো দুর্ভাগ্য তার পরিবারে নেমে আসবে।

একবার নাকি এক গ্রামবাসী তার ঘরের সামনে কাঠের দরজা লাগিয়েছিলেন, পরদিনই তার গাড়ির দুর্ঘটনা ঘটেছিল। ২০১৫ সালে প্রথম পুলিশ স্টেশন তৈরি হয় এই গ্রামে। তারও কোনো দরজা নেই। তবে এখনও পর্যন্ত কোনো অভিযোগ পুলিশের কাছে জমা পড়েনি। যে কটা অভিযোগ হয়েছে প্রতিটাই পাশের গ্রাম থেকে এসেছে। এই গ্রামগুলো পুলিশ স্টেশনের আওতায় পড়ে।

সত্যিই কি এই গ্রামে কোনো অপরাধ হয় না? শনি দেবতা সত্যিই তাদের রক্ষা করে চলেছে? এই বিষয় নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, এককালে গ্রামবাসীদের মধ্যে এই বিশ্বাসটা এতটাই গাঢ় ছিল যে, ভয় থেকেই হয়তো কেউ অপরাধ করতেন না। কিন্তু বর্তমানে এটা একটা পর্যটনের জায়গা।

প্রচুর পর্যটক এই গ্রামে আসেন। পর্যটন শিল্পই প্রত্যন্ত এই গ্রামের অন্যতম উপার্জনের রাস্তা হয়ে উঠেছে। বিশ্বাসে আঘাত করে সেই পর্যটন শিল্পের কোনো ক্ষতি গ্রামবাসীরা করতে চান না। তাই এমনটা হতেই পারে যে, চুরি-ডাকাতি বা অন্যান্য অপরাধ তারা নিজেদের মধ্যেই চেপে যান। পুলিশে আর অভিযোগ জানান না।

ইউনাইটেড কমর্শিয়াল (ইউকো) ব্যাঙ্ক গ্রামের রীতি মেনে দরজা লাগায়নি ঠিকই, তবে প্রতিদিন ব্যাঙ্ক বন্ধ হওয়ার আগে সমস্ত নগদ টাকা তারা নাকি পাশের গ্রামের শাখায় স্থানান্তরিত করে দেয়।

ঢাকা টাইমস/১৮সেপ্টেম্বর/একে