পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পরিবেশ নষ্টে তিন কারণ

প্রকাশ | ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ০৯:৫৩ | আপডেট: ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ১২:৫৯

বোরহান উদ্দিন, ঢাকাটাইমস

জাহাঙ্গীরনগরসহ দেশের কয়েকটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন ইস্যুতে অস্থিরতা চলছে। এর মধ্যে জাহাঙ্গীরনগর, গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (বশেমুরবিপ্রবি) উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন চলমান রয়েছে। এছাড়া কদিন পরপরই নানা ইস্যুতে উপাচার্যের পদত্যাগ দাবি করে আন্দোলন তৈরি হয়।

এমতাবস্থায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক, বরেণ্য শিক্ষাবিদ ও কথাসাহিত্যিক অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম মূলত তিনটি কারণে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উপাচার্যের পক্ষে-বিপক্ষে, উন্নয়নের পক্ষে-বিপক্ষে আন্দোলন হয় বলে মনে করছেন।

খ্যাতনামা এ শিক্ষাবিদের মতে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে যে দলাদলি তার কারণে শিক্ষার্থীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাদের পাঠদান ঠিকভাবে হয় না। ফলে সামগ্রিকভাবে এ ক্ষতিটা গোটা জাতির ওপর গিয়েই পড়ে।

ঢাকা টাইমসকে সৈয়দ মনজুরুল বলেন, ‘প্রথমত সর্বজন শ্রদ্ধেয় নয়, সরকারের কাছে ধর্ণা দিয়ে অনেকে উপাচার্য হন। যে কারণে তাদের কাজ হয় সরকারকে খুশি রাখা। দ্বিতীয়ত- পড়ালেখার চেয়ে শিক্ষকরা রাজনৈতিক লেজুরবৃত্তি করে থাকেন। শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতিও বড় কারণ। তৃতীয়ত- ছাত্র-শিক্ষক, অভিভাবকসহ যেসব স্টেকহোল্ডার থাকেন তাদের মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশ তৈরি করতে না পারা।’

‘শুধু জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় নয়, দেশের অন্যান্য ছোট-বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রায়ই অস্থিরতা দেখা দেয়। এজন্য বেশ কিছু কারণ রয়েছে তার মধ্যে বড় কারণ হলো- উপাচার্য সর্বজনশ্রদ্ধেয় ব্যক্তি হওয়ার কথা। কিন্তু হচ্ছে উল্টোটা। সরকারের কাছে ধর্ণা দিয়ে উপাচার্য হচ্ছেন। যে কারণে কি সরকারের কাছে, মন্ত্রণালয় কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের কাছে তাদের সেই অর্থে সম্মান থাকে না। শুরু থেকেই তাদের চিন্তা থাকে সরকারকে খুশি করা যায়।’

বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার পাশাপাশি কথাসাহিত্যে অনন্যতার ছাপ রেখেছেন সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। তার সৃষ্টিকর্মের মধ্যে সমাজের নানা অসঙ্গতি উঠে এসেছে। তার মতে, এখন দেশে টাকাও বেশি হয়ে গেছে।

তিনি বলেন, ‘একনেকের এক বৈঠকে যে টাকার প্রকল্প পাশ হয় একসময় তা দেশের বাজেটও হত না। যে কারণে টাকার প্রতি লোভ পেয়ে বসেছে অনেকের মনে। এই যেমন বছরের ১১ মাস ঢাকায় থাকেন এমন ভিসির বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য হাজার হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ হয়। যে কারণে লুটপাটেরও একটা সুযোগ থাকে। কেউ কেউ সদ্ব্যবহার করে না।’

‘ভালো পড়াশোনার বদলে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে ব্যস্ত থাকতে শিক্ষকদের একাংশ পছন্দ করেন। সরকারি কোনো অনুষ্ঠান হলে সেখানে উপস্থিত থেকে নিজেকে হাজিরের চেষ্টা করেন। শিক্ষকদের দলাদলি ভয়ংকর আকার ধারণ করেছে সবখানে। বিশেষ করে ডিন নির্বাচনের নামে শিক্ষকরা একেকভাগে ভাগ হয়ে যাচ্ছেন। এটা তুলে দিলে কি সমস্যা বুঝি না। এছাড়া শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতির বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ।’

তিনি আরও বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেকগুলো স্টেকহোল্ডার আছে। যেমন- ছাত্র, শিক্ষক, অভিভাবক এবং স্থানীয় লোকজন। একটা সময় বিশেষ করে ছাত্রশিবিরের ছেলেরা চট্টগ্রাম, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সহ অনেক জায়গায় যে ধরনের তাণ্ডব চালিয়েছে যে কারণে এখনো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আশপাশের স্থানীয়দের মধ্যে আস্থাহীনতা রয়েছে। আর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এদের সবার মাঝে সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশ তৈরি করতে পারেনি। আর শিক্ষকরা সাদা, নীল এমন অনেক প্যানেলে ভাগ হয়ে যায় তখন পরিস্থিতি ভালো থাকবে কেমন করে?

তিনি বলেন, ‘বলা হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নে মহাপরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়েছে। আসলে পরিকল্পনা হচ্ছে ঠিকই কিন্তু আটকে আছে টাকায়।’

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন প্রকল্প নিয়ে ক্যাম্পাসের পরিস্থিতির দিকে ইঙ্গিত করে বলেন, ‘ভবন নির্মাণের জন্য গাছ কেন কাটতে হবে? উন্নয়ন পরিকল্পনা করার আগে সবাইকে নিয়ে উন্মুক্ত আলোচনা করা যায়। সবার মতামতের ভিত্তিতে কাজ করলে এমন পরিস্থিতি তো হয় না। কিন্তু উল্টো এসব কাজে রাজনৈতিক সংগঠনের নেতাকর্মীরা হস্তক্ষেপ করেন।’

সম্প্রতি গোপালগঞ্জ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে সাময়িক বহিষ্কার হওয়া শিক্ষার্থীর সঙ্গে সেখানকার উপাচার্যের ফোনালাপের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, ‘আমি প্রথমে অডিওটি শুনে বিশ্বাস করতে পারিনি। একজন উপাচার্য এই ভাষায় কথা বলেন কিভাবে? এটা তো পুলিশের দারোগার ভাষা। আবার বলছেন, বাবার মত শাসন করেছেন। তাহলে এটা কোন বাবা? পাষণ্ড বাবা। অনেক বাবা তো মেয়েকে পেটায়। অল্প বয়সে বিয়ে দিয়ে দেয়।’

তিনি বলেন, ‘ছাত্র-শিক্ষকদের রাজনীতির জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষতি হচ্ছে। পাঠদান ব্যাহত হচ্ছে। শিক্ষার মান কমছে। ডাকসু নির্বাচনের জন্য বন্ধ থাকে ক্লাস, কোটা আন্দোলনের সময় বন্ধ থাকে ক্লাস। এটা তো কথা হতে পারে না। রাজনৈতিক চাপে ছাত্র ভর্তি বেশি করতে হচ্ছে। এসব কারণে উপাচার্য যারাই হন তাদের সতর্ক থাকতে হয়, সরকারকে খুশি রাখতে হয়।’

আর এমন উদ্ভূত পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের উপায় বাতলাতে গিয়ে এই শিক্ষাবিদ বলেন, ‘শিক্ষকদের দলাদলি এটা ভালো নয়। বন্ধ করতে হবে। দলীয় রাজনীতির লেজুড়বৃত্তি বন্ধ করতে হবে। শিক্ষার্থী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে উন্নয়ন হোক।’

ঢাকাটাইমস/২০সেপ্টেম্বর/বিইউ/ডিএম/এমআর