প্রধানমন্ত্রীর শুদ্ধি অভিযান

বিতর্কিত ও অনুপ্রবেশকারীরা দলে দূষণ ছড়াচ্ছে!

নজরুল ইসলাম
| আপডেট : ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ১১:৩৮ | প্রকাশিত : ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ০৮:২৪

দলে অনুপ্রবেশকারীদের নিয়ে অনেক আগে থেকেই সরব আওয়ামী লীগ। দলের শীর্ষ নেতৃত্ব থেকে শুরু করে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা এ নিয়ে বিভিন্ন সময় কথা বলেছেন। ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য দলছুটরা ক্ষমতাসীন দল, অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলোতে ঢুকে পড়েছে, এমন অভিযোগ ছিল দীর্ঘদিন ধরে।

প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা অনুপ্রবেশকারীদের তালিকা করার নির্দেশ দিয়েছেন দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের। তারা দলে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে, এমন তথ্যও ছিল তার কাছে। দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও একই সুরে কথা বলেছেন বিভিন্ন সময়। অনুপ্রবেশকারীদের ‘কাউয়া’ বলে আখ্যা দিয়েছিলেন দলে গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা এই নেতা।

টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ। প্রায় ১১ বছর রাষ্ট্র পরিচালনায় থাকায় অন্য সংগঠনের দলছুটরা ব্যক্তিগত স্বার্থ, ব্যবসা-বাণিজ্যে সুবিধা পাওয়া, প্রতিপক্ষের মামলা-হামলা থেকে রক্ষা পাওয়াসহ নানা কারণে অন্য দল ছেড়ে যোগ দিয়েছে আওয়ামী লীগ বা সহযোগী সংগঠনগুলোতে। কখনো একা, কখনো দলবলে এসব যোগদান হয়েছে। সরকারের গত মেয়াদের শেষ দিকে এই হার ছিল চোখে পড়ার মতো। তখন যে কাউকে দলে ভেড়াতে কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে সতর্ক থাকার নির্দেশনা ছিল। তবে এরপরও মামলার আসামি, বিএনপি-জামায়াতের রাজনীতিতে সক্রিয়দের কেউ কেউ ঢুকে পড়েছেন স্বাধীনতার নেতৃত্ব দেওয়া দলটিতে।

আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা এসব অনুপ্রবেশকারীর কারণে দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণেœর আশঙ্কা করছিলেন সব সময়। গত ১৮ সেপ্টেম্বর ঢাকার মতিঝিল, গুলিস্তানে ক্লাবগুলোতে অভিযান পরিচালনার পর প্রকাশ্যে আসে ক্যাসিনোর নামে জুয়ার সা¤্রাজ্য। আওয়ামী যুবলীগের গুরুত্বপূর্ণ নেতারা এর সঙ্গে জড়িত, এমন খবর বেরিয়ে আসায় নড়েচড়ে বসেন সংশ্লিষ্টরা। তার এক দিন বাদে যুবলীগের আগের নেতা জি কে শামীমের নিকেতনের কার্যালয়ে অভিযান চালিয়ে অবৈধ অস্ত্র, প্রায় দুই কোটি নগদ টাকা এবং ১৬৫ কোটি টাকার এফডিআরের প্রমাণপত্র উদ্ধারের পর অনুপ্রবেশকারীদের অপকর্মের অভিযোগ বড় হয়ে সামনে আসে। এই দুজনই আগে ভিন্ন প্ল্যাটফর্মে রাজনীতি করেছেন বলে খবর আসছে। তাই প্রশ্ন উঠছে, অনুপ্রবেশকারীরাই কি দলে দূষণ ছড়াচ্ছে?

শামীম গ্রেপ্তার হওয়ার পর এক প্রতিক্রিয়ায় যুবলীগের শীর্ষ নেতা বলেছেন, শামীম যুবলীগের কেউ নন। নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগের নেতা। পরে নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগ বিষয়টি অস্বীকার করলে প্রকাশ্যে আসে, এই শামীম একসময় বিএনপির নেতা মির্জা আব্বাসের ঘনিষ্ঠ ছিলেন। জড়িত ছিলেন যুবদল ও বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে। এর আগে গুলশান থেকে গ্রেপ্তার হন যুবলীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া। বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, তিনি একসময় ফ্রিডম পার্টির রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন। ছিলেন যুবদলের পদধারী নেতাও। ক্ষমতার পালাবদলের পর সুযোগ বুঝে তারা ঢুকে পড়েন যুবলীগের রাজনীতিতে। ভেতরে ভেতরে পসার ঘটিয়েছেন অপরাধের সা¤্রাজ্য। গড়েছেন বিপুল অবৈধ সম্পদ।

এই পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা বলছেন, দলের সভাপতি কঠোর ভাষায় বলে দিয়েছেন, তিনি দলে শুদ্ধি অভিযান অব্যাহত রাখবেন। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া যাবে, তাদের দলীয় পদ থেকে বহিষ্কারের পাশাপাশি আইনগতভাবে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

অনুপ্রবেশকারীদের নিয়ে আরও আগে থেকেই সংশয়ে ছিল আওয়ামী লীগ। দলীয় নীতিনির্ধারণী ফোরামেও এ নিয়ে আলোচনা হয়েছে বিস্তর। মাসখানেক আগে আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ও তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশকারীদের ধীরে ধীরে বের করে দিতে হবে। আমরা পরপর তিনবার রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকার কারণে সংগঠনের মধ্যে অনুপ্রবেশকারী ঢুকেছে। অনেক সুবিধাবাদীরাও সংগঠনের মধ্যে ঢুকে পড়েছে।’

অনুপ্রবেশকারীদের মধ্যে বিএনপি, জামায়াত ছাড়াও চরমপন্থী বলে খ্যাত সংগঠনের নেতারাও ঢুকে পড়েছেন বলে খবর বেরিয়েছে বিভিন্ন সময়।

জানতে চাইলে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘গত ১০ বছর ক্ষমতায় থাকার কারণে বিভিন্ন দল থেকে কিছু অনুপ্রবেশকারী আওয়ামী লীগে প্রবেশ করেছে। এরা নানা ধরনের বিতর্কিত কর্মকা-ের মাধ্যমে দলের ভাবমূর্তি নষ্ট করার চেষ্টা করছে, এরা অনুপ্রবেশকারী। এদের বিরুদ্ধে কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে দল থেকে। অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। দলীয় পদ থেকেও বহিষ্কার করা হচ্ছে।’

আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতিম-লীর সদস্য নূহ-উল-আলম লেনিন মনে করেন, আওয়ামী লীগের মতো বড় দলে অনেকেই এসে আশ্রয় নেওয়ার চেষ্টা করতে পারেন। তবে এ ব্যাপারে সবাইকে সজাগ থাকতে হবে।

বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে লেনিন বলেন, ‘অনুপ্রবেশকারীদের নানা বিতর্কিত কাজ নিয়ে অনেক আগ থেকে কথা হচ্ছে। দলীয় প্রধানও বিষয়টি অবগত আছেন। তার নির্দেশেই ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।’

২০১৪ সালের নির্বাচনের পর দ্বিতীয় মেয়াদে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে বিভিন্ন দলের রাজনৈতিক নেতাদের সরকারি দলে যোগদান আরও বেড়ে যায়। এই সময়ের মধ্যে অনুপ্রবেশকারীদের অনেকেই ভালো পদ-পদবিও ভাগিয়ে নেন।

গত শনিবার আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে দলের নাম ব্যবহার করে অপকর্মকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি দেন দলীয় সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

ছাত্রলীগের শোভন-রাব্বানীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার পর বুধবার অস্ত্রসহ যুবলীগের ঢাকা দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। এরপর শুক্রবার বিকালে আটক করা হয় যুবলীগের কেন্দ্রীয় সমবায় সম্পাদক জি কে শামীমকে।

বিভিন্ন গণমাধ্যমে তথ্য এসেছে, ফ্রিডম মানিক ও ফ্রিডম রাসুর হাত ধরে উত্থান হয় অস্ত্রসহ র‌্যাবের হাতে আটক যুবলীগ নেতা খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়ার। ফ্রিডম পার্টির কর্মী খালেদ ছিলেন বিএনপির নেতা মির্জা আব্বাসের ঘনিষ্ঠ সহযোগী। আর সেই খালেদ ২০১২ সালে যুবলীগের মহানগরী কমিটিতে নাম লেখান।

এদিকে বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় থাকাকালে শামীম ছিলেন ঢাকা মহানগর যুবদলের সহ-সম্পাদক এবং বিএনপির কেন্দ্রীয় প্রভাবশালী নেতা ও সাবেক গণপূর্ত মন্ত্রী মির্জা আব্বাসের ঘনিষ্ঠ।

রাজধানীর সবুজবাগ, বাসাবো, মতিঝিলসহ বিভিন্ন এলাকায় জি কে শামীম প্রভাবশালী ঠিকাদার হিসেবে পরিচিত। গণপূর্ত ভবনের বেশির ভাগ ঠিকাদারি কাজ জি কে শামীম নিয়ন্ত্রণ করেন।

তবে এই শামীমের রাজনৈতিক পরিচয় নিয়ে তৈরি হয়েছে ধোঁয়াশা। গতকাল শুক্রবার শামীমকে গুলশানের নিকেতনের বাসা থেকে র‌্যাব আটকের পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় যুবলীগের চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরী জানান, জি কে শামীম যুবলীগের কেউ নন। শামীমের সঙ্গে যুবলীগের কোনো সম্পর্ক নেই। তিনি নারায়ণগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি।

যুবলীগের পক্ষ থেকে শামীমকে নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি পরিচয় দেওয়া হলেও নারায়ণগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগ বলছে ভিন্ন কথা। তারা জানায়, জি কে শামীম তাদের কমিটির কেউ নন।

এদিকে গতকাল আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে দলের উপ-দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া সাংবাদিকদের জানান, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সংরক্ষিত তথ্য অনুযায়ী নারায়ণগঞ্জ জেলা বা মহানগর আওয়ামী লীগের তালিকায় জি কে শামীম নামের কোনো ব্যক্তির অস্তিত্ব নেই বলে জানিয়েছে। বিপ্লব বড়ুয়া ওই কমিটির একটি অনুলিপি দেখিয়ে বলেন, এখানে জি কে শামীম নামের কোনো ব্যক্তির নাম নেই। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সঙ্গে তার কোনো ধরনের সংশ্লিষ্টতা নেই।

দলীয় একাধিক সূত্রে জানা গেছে, বিতর্কিত নেতা এবং দলের অনুপ্রবেশকারীদের তালিকা করা হয়েছে। ধীরে ধীরে সবার বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ নিয়ে দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের মধ্যে আতঙ্ক আছে। তবে এটি দলের মধ্যে সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য ইতিবাচক বলে মনে করেন দলের শীর্ষ নেতারা।

(ঢাকাটাইমস/২২সেপ্টেম্বর/এইচএফ/মোআ)

সংবাদটি শেয়ার করুন

রাজনীতি বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

রাজনীতি এর সর্বশেষ

দেশ গরমে পুড়ছে, সরকার মিথ্যা উন্নয়নের বাঁশি বাজাচ্ছে: এবি পার্টি

বিএনপি নেতাকর্মীদের জামিন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানোর প্রতিবাদ সালাম-মজনুর

নেতাকর্মীদের মুক্তির দাবিতে রাজধানীতে রিজভীর নেতৃত্বে মিছিল

মন্দিরে আগুন ও দুই শ্রমিক পিটিয়ে হত্যায় বিএনপির উদ্বেগ, তদন্ত কমিটি গঠন

প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছায় এদেশে আইনের প্রয়োগ হয়: রিজভী

দেশি-বিদেশি চক্র নির্বাচিত সরকারকে হটানোর চক্রান্ত করছে: ওবায়দুল কাদের

প্রতিমা পোড়ানোর মিথ্যা অভিযোগে হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের শাস্তি দিতে হবে: ছাত্রশিবির সভাপতি

আল্লামা ইকবালের ৮৫তম মৃত্যুবার্ষিকীতে মুসলিম লীগের আলোচনা সভা

সীমান্তে বাংলাদেশি হত্যার প্রতিবাদ জানাল রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন

ভারতীয় পণ্য বর্জন চলবে: ফারুক

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :