বলেশ্বরের জেলে পল্লী

ঘর ভাঙে ঝড়ে, ত্রাণে বাঁচে প্রাণ

কাজী রফিক, বরগুনা থেকে ফিরে
| আপডেট : ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ১৪:৩৪ | প্রকাশিত : ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ০৮:২০

বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার বলেশ্বর নদী তীরের পঞ্চাশ হাজারের বেশি মানুষের জীবিকা নদীনির্ভর। নদী থেকে মাছ ধরেই তাদের সংসার চলে। নদীর পদ্মা সøুইস এলাকার বেড়িবাঁধকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে এই বিশাল জনপদ। গ্রাম মূলত ফসল উৎপাদনকেন্দ্রিক হলেও এখানে বসবাসকারীদের সবাই জেলে।

নদী ক্ষণে ক্ষণে রূপ বদলায়। তবে কতটা রূপ বদলাতে পারে সেই নদী, তা নদী পারের মানুষ ছাড়া কেউ ভালো বলতে পারবে না। নদীর উদারতা যেমন আছে, তেমনি রয়েছে ভয়ানক চেহারা। যার প্রমাণ পাওয়া যায় এই বেড়িবাঁধ এলাকায়।

বাঁধের কাজ মূলত নদীর হাত থেকে উপকূলকে রক্ষা করা। তবে এখানে এই বাঁধই আগলে রেখেছে ৫০ হাজারের বেশি মানুষকে। বাঁধের দুই পাশে বসবাস করছেন এই জেলেরা। অলিখিতভাবে গড়ে উঠেছে বিশাল এক জেলেপল্লী।

জেলেপল্লী ঘুরে দেখা যায়, নদী থেকে মাছ ধরে সংসার চালানো এই মানুষের সম্বল বলতে আছে কেবল একখানা নৌকা। কারও বা সেটাও নেই। অন্যের নৌকা ভাড়া নিয়ে মাছ ধরেন।

জেলেরা জানান, ভরা মৌসুমে এই বলেশ্বর থাকে মাছে পরিপূর্ণ। সে সময় মাসের প্রায় পুরোটা সময় নদীতেই কাটে এখানকার জেলেদের। কেবল নারীদের ঘরে রেখে বাবা-দাদা-ভাইয়ের সঙ্গে নদীতে চলে যায় ঘরের কনিষ্ঠ সদস্যটিও।

মৌসুমে নদী থেকে যে বিপুল পরিমাণ মাছ ধরা পড়ে, তা দিয়ে এই জেলে পরিবারগুলোর ভাগ্য পাল্টে যেতে পারত। কিন্তু প্রকৃতি তাদের সহায় হয় না কখনোই। মৌসুমে নদীতে মাছ থাকার পাশাপাশি ভয়ানক রূপও ধারণ করে এই বলেশ্বর। তখন ঝড়-বন্যায় বারবার ভেঙে পড়ে জেলেদের ঘরগুলো।

তাই প্রতিবছরই তাদের তৈরি করতে হয় মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকু। ফলে জমানো টাকায় জমি কেনা, সেখানে ঘর, গোয়াল আর ফসলের মাঠ করার যে স্বপ্ন তা কেবল স্বপ্নই রয়ে যায় এই জেলেদের।

পদ্মা সøুইস এলাকার জেলে মো. মনির হোসেন বলেন, ‘শখ-ইচ্ছা তো মানুষের থাকেই। আমগোও আছে। কিন্তু কিছু করার নাই। বইন্যা (বন্যা), তুফান আইলে আটকায় কেমনে?’

বিলাসিতা কিংবা শখ, এমন কিছুই নেই তাদের। যা আছে, তা হলো কেবল বেঁচে থাকার যুদ্ধ। সে চিত্র বেশি স্পষ্ট হয় ভাদ্র, আশ্বিন মাসে। মৌসুম শেষে অর্ধাহারে কাটে এখানকার জেলেদের সংসার। কারণ এই সময়টা থাকে মাছ ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞা। নৌকা বা জাল নিয়ে নদীতে নামতে গেলেই ধরা পড়তে হবে কোস্টগার্ডের হাতে। তাই তীরে বসে নিষেধাজ্ঞা শেষ হওয়ার দিন গোনেন তারা।

আগামী ৯ অক্টোবর থেকে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত মোট ২২ দিন মাছ ধরা বন্ধ। কারণ এ সময় ইলিশের ডিম পাড়ার মৌসুম। বছরের এই সময়ে নদীতে যেতে পারেন না জেলেরা। তবে সরকারের পক্ষ থেকে এসময় ত্রাণের ব্যবস্থা করা হয় তাদের জন্য। কিন্তু জেলেদের থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, এই ত্রাণ তাদের জন্য যথেষ্ট নয়। আর মোট জেলের তুলনায় নিবন্ধিত জেলের সংখ্যা অনেক কম। তাই অনেকেই থেকে যান ত্রাণ সুবিধার বাইরে।

কবির হোসেন নামের এক জেলে বলেন, ‘অবরোধের সময় রিলিফ (ত্রাণ) দেয়। কিন্তু অ...দিয়া কিছু হয় না। মানুষ কি কম? ঘরকিস্তি (ঘরপ্রতি) চাউল দেয়, মানুষ তো গোনে না। একেক ঘরে তো পাঁচজন, ছয়জনও আছে। আর কার্ডই বা দেছে কয় জনরে? বেশির ভাগই তো কার্ড ছাড়া।’

স্থানীয়দের থেকে জানা যায়, অর্ধশত বছরেরও বেশি সময় আগে এখানে গড়ে ওঠে জেলেপল্লীটি। বসবাস শুরু করেন নদীর সঙ্গে যুদ্ধ করে জীবিকা আহরণকারী জেলেরা। দিনদিন বেড়ে ওঠে জনগোষ্ঠী। পাথরঘাটা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হুমায়ুন কবিরের থেকে পাওয়া তথ্য মতে, এখানে বসবাসকারী নিবন্ধিত জেলের সংখ্যা প্রায় দেড় হাজার। তবে বাস্তবে এই সংখ্যা কয়েকগুণ। স্থানীয়রা জানায়, নিবন্ধন দেওয়া হয়েছে ঘরপ্রতি একেকজনকে। তাদের মতে, এখানে বসবাসকারীর সংখ্যা পঞ্চাশ হাজারের বেশি।

নদীতে যাওয়া-আসার মাঝেও নানা কর্মযজ্ঞ

নদীতে মাছ ধরতে যাওয়ার আগে ও পরে নানা কর্মযজ্ঞ এই জেলেপল্লীতে। নদীতে যাওয়ার আগে নৌকাটি ঠিকঠাক আছে কি না, মাঝ নদী বা সমুদ্রে যাওয়ার এবং ফিরে আসার মতো জ্বালানির ব্যবস্থা করা (কখনো কখনো জ্বালানি কিনতে অন্যের থেকে টাকা ধার নিতে হয়। ফিরে এসে মাছ বিক্রি করে সেই ধার পরিশোধ করেন), মাছ ধরার জাল, মাছ রাখার ব্যবস্থা, বরফ, খাবারসহ প্রয়োজনীয় নানা কিছুর জোগাড় করতে হয়। তারপরই মাছের সন্ধানে নদীতে যান জেলেরা। কাজের ফুরসতে একটু পড়াশোনা করার ইচ্ছায় জেলে পরিবারের যে সদস্যরা স্কুল-কলেজে পড়ে, তাদের বেশির ভাগই বই নিয়েই নদীতে যায়।

দুই থেকে সাতদিন, কেউ কেউ নদীতে থাকে দশ থেকে বারোদিনও। তারপর ফিরে আসে মাছ নিয়ে, পরিবারের জন্য আহারের বন্দোবস্ত করে। তীরে ফিরেই মাছ বিক্রির পালা। কখনও বা নদীতেই পাইকারের কাছে মাছ বিক্রি করে ফেরেন।

মাছ বিক্রির পরও কাজ শেষ হয় না। তীরে ফিরে আসার পর শুরু হয় জাল গোছানো। কয়েক দিন মাছ ধরার পর জালের বিভিন্ন জায়গা ছিঁড়ে-ফেটে যায়। ফিরে এসে সেটাও মেরামত করতে হয় তাদের।

এই কাজের মধ্যেই রয়েছে তাদের আড্ডা, আনন্দ। কয়েকজন জেলের জাল মেরামত করার সময় দেখা যায়, তারা কাজের পাশাপাশি আড্ডা দিচ্ছেন। হাতে কাজ চলছে অন্যদিকে হাসি, আড্ডা আর মশকরা করছেন সবাই মিলে। তবে এই আড্ডা হয় বয়স হিসাব করে। এক বয়সের কয়েকজন জেলে একত্রে নিজ নিজ জাল নিয়ে বসেন। মূলত মাঝ বয়সী এবং প্রবীণরাই জাল মেরামতের কাজ করেন।

নদী-সমুদ্রে শত্রু, তীরে ফিরে বন্ধু

মাছ ধরতে যাওয়া এবং আসার মধ্যে রয়েছে কয়েকটি বড় আতঙ্ক। এর মধ্যে একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ আর অন্যটি জলদস্যু। মাঝ নদীতে ঝড়ের কবলে পড়লে হয়তো সাঁতার কেটে ফিরে আসতে পারেন এই জেলেরা। কিন্তু কয়েক দিনের পরিশ্রম মুহূর্তে জলে ভেসে যায়। তাই নদী বা সমুদ্রে যাওয়ার আগেই প্রবীণদের থেকে আবহাওয়ার খোঁজখবর নিয়ে নদীপথে পাড়ি জমান জেলেরা। এখানকার প্রবীণরা আকাশের দিকে তাকিয়ে, বাতাসের গতিপথ দেখে আবহাওয়ার বিষয়ে মোটামুটি পরিষ্কার ধারণা দিতে পারেন।

জলদস্যুদের নিয়েই যত ভয় জেলেদের

মাছ ধরে নিয়ে আসার পথে জলদস্যুর কবলে পড়লে কয়েকদিনের পরিশ্রম চলে যায় ডাকাতদের হাতে। তবে পরিস্থিতি সামাল দিতে এখানে বেশ সক্রিয় অবস্থানে থাকে কোস্টগার্ড সদস্যরা।

নদী-সমুদ্রে জলদস্যুরা জেলেদের শত্রু হলেও তীরে ফিরে সবাই বন্ধু। স্থানীয় সূত্র জানায়, এই জেলেপল্লী এমন একটি জায়গা, যেখানে মাঝি-মাল্লা আর জেলেদের পাশাপাশি বসবাস করেন জলদস্যুরাও। কে বা কারা এই জলদস্যু তা স্থানীয়রা জানেন। জেলে আর জলদস্যুদের মধ্যে নদী-সমুদ্রে বিরোধ থাকলেও তার কোনো ছোপ নেই ডাঙায়। এখানে তারা এক দোকানে বসেই চা খান, আড্ডা দেন।

নাগরিক সুবিধা নামমাত্র

বিশাল এই জনগোষ্ঠীর জন্য এখানে সুযোগ-সুবিধা আছে নামমাত্র। বেড়িবাঁধ এলাকা থেকে আশপাশের এলাকায় যেতে যে রাস্তা ব্যবহার করতে হয় তার অবস্থা বেশ নাজুক। তিন বছরেরও বেশি সময় আগে পদ্মা সøুইস থেকে পাথরঘাটা পর্যন্ত রাস্তার কাজ শুরু করা হয়েছিল। দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে কাজ হয়েছে ত্রিশ শতাংশেরও কম।

স্থানীয়দের অভিযোগ, তারা নাগরিক সুবিধার কিছুই পাচ্ছেন না। এমনকি তাদের জন্য পর্যাপ্ত রাস্তাঘাট, বিদ্যুৎ সুবিধা, হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হচ্ছে না। ফলে ভোগান্তিতে জীবন কেটে যাচ্ছে তাদের।

সড়কের নাজেহাল পরিস্থিতির শিকার হচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। কারণ পদ্মা সøুইস এলাকায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা একটি। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার দেওয়া তথ্য মতে, পুরো বেড়িবাঁধ এলাকার জন্য চারটি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে। কিন্তু স্থানীয়রা বলছেন, এই প্রাথমিক বিদ্যালয় এখানকার জনগোষ্ঠীর জন্য যথেষ্ট নয়। আর উচ্চ বিদ্যালয় নেই বাঁধ এলাকার চার কিলোমিটারের মধ্যে। ফলে চার কিলোমিটারের বেশি পথ পাড়ি দিয়ে স্কুলে যেতে হয় জেলে পরিবারের সন্তানদের। আর প্রতিদিন তারা এই দীর্ঘ পথ পাড়ি দিচ্ছে পায়ে হেঁটে।

সপ্তম শ্রেণি পড়–য়া সুমনা আক্তার বলে, ‘আশপাশে হাইস্কুল নেই। আছে দূরে, কিলো চাইর (চার কিলোমিটার) হইব। আমরা সব ওইখানেই পড়ি।’

সড়কের যাচ্ছেতাই অবস্থার কারণে সেখানে চলাচল করছে শুধুমাত্র মোটরসাইকেল। পদ্মা সøুইস থেকে উচ্চ বিদ্যালয় পর্যন্ত মোটরসাইকেলে যেতে ভাড়া গুনতে হয় ৫০ টাকা, যা এখানকার মানুষের একদিনের সংসার খরচের প্রায় সমান। তাই বাধ্য হয়ে পায়ে হেঁটেই স্কুলে যেতে হয় এখানকার শিক্ষার্থীদের।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির জানান, তিন বছর আগে কাজ শুরু করলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মাঝপথে কাজ বন্ধ করে রেখেছে। বিষয়টি নিয়ে স্থানীয় সরকার বরাবর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কালো তালিকাভুক্তকরণ এবং পুনরায় কাজ শুরুর আবেদন জানিয়েছেন।

চার কিলোমিটারের মধ্যে উচ্চ বিদ্যালয় হলেও কলেজের দূরত্ব প্রায় ১১ কিলোমিটার। তাই এখানকার কেবল ছেলেরাই কলেজ পড়ার সুযোগ পায়। তবে নিয়মিত কলেজে যাওয়া হয় না তাদেরও।

কলেজ ছাত্র মাসুম বলে, ‘কলেজে তো মাঝেমধ্যে যাই। পরীক্ষা দেই। আমরা তো বেশির ভাগই নদীতে থাকি। কলেজে যামু কেমনে!’

সংকট স্বাস্থ্যকেন্দ্রেরও। স্থানীয়রা জানান, পুরো এলাকার জন্য একটি মাত্র ক্লিনিক রয়েছে। হাসপাতালের দূরত্ব অনেক। তাই বড় ধরনের কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে কিংবা বড় রোগের সমাধান পেতে ছুটে যেতে হয় বহুদূর।

স্থানীয় বাসিন্দা শাহজাহান বলেন, ‘একটা ক্লিনিক আছে, তাতে হয় না। আমগো এই এলাকার জন্য সরকার একটা হাসপাতাল করলেই পারে। এইডা দরকার, এইডা তো কাউরে বুঝানোর কিছু নাই। সবাই বুঝে।’

বৃষ্টির পানিই ভরসা

গ্রামে পানির সংস্থান নদী, খাল এবং গভীর নলকূপ। কিন্তু এখানে সে চিত্রও বিরল। পদ্মা সøুইসসহ বাঁধ এলাকার মানুষ পানির জন্য নির্ভর করেন প্রকৃতির ওপর। তারা বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টির পানি জমিয়ে রাখেন। আর সারা বছর সেই পানি দিয়েই তাদের তৃষ্ণা মেটান।

পান করার জন্য বৃষ্টির পানির ব্যবহার করলেও অন্যান্য কাজের জন্য তাদের ভরসা বলেশ্বর নদী। নদীর পানির জন্য খুব একটা দূরেও যেতে হয় না তাদের। কারণ জোয়ারের সময় নদীর পানি বাড়ে। সেই পানি চলে আসে ঘরের কাছাকাছি পর্যন্ত।

(ঢাকাটাইমস/২৫সেপ্টেম্বর/কারই/ডিএম)

সংবাদটি শেয়ার করুন

ফিচার বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

ফিচার এর সর্বশেষ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :