শিকলবন্দি দাদনের আকুতি

‘ভাই আমারে খুইল্যা দ্যান’

সাগর হোসেন তামিম, মাদারীপুর
 | প্রকাশিত : ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ০৮:২৭

স্ত্রী সন্তান নিয়ে ভালোই সংসার জীবন পার করছিলেন দাদন হাওলাদার। এক ছেলে ও দুই মেয়েকে নিয়ে জীবনের হাল টেনে চলছিলেন তিনি। কিন্তু পরপর তিনটি বিয়ে করেও নিঃসন্তান ছোট ভাই ভাই খবিরের কা-ে তছনছ হয়ে যায় দাদনের সংসার। বড় ভাইয়ের স্ত্রী নিয়ে পালিয়ে যায় খবির। মায়ের সঙ্গে চলে যায় দাদনের সন্তানেরাও। এরপরই জীবনের সংঘাত শুরু দাদনের। এক বছর ধরে দাদনকে শিকলে বন্দি করে রেখেছেন মা-বাবা। বন্দি দশাতে কাউকে দেখতে পেলেই চল্লিশোর্ধ দাদনের আকুতি ‘ভাই আমারে খুইল্যা দ্যান।’

মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলার লক্ষ্মীপুর ইউনিয়নের জায়গীর গ্রামে দাদনের বাড়ি। স্ত্রী-সন্তান হারানোর বেদনার মধ্যেই তাকে মানসিক ভারসাম্যহীনের অজুহাত দেখিয়ে ঘরের খুঁটির সঙ্গে বেঁধে রেখেছে বাবা-মা।

সরেজমিনে দেখা যায়, কেউ কাছে গেলেই স্বাভাবিক জীবন-যাপনে ফিরে যাওয়ার আকুতি ঝরে দাদনের কণ্ঠে। কিন্তু পরিবারের লোকজন বলছেন, সরকারী সহযোগিতা পেলে উন্নত চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ করা যাবে দাদনকে। যদিও দাদনের কথাবার্তা শুনে তাকে মানসকি ভাবে অসুস্থ বলে মনে করার সুযোগ নেই।

দাদন হাওলাার বলেন, ‘আমাকে ছেড়ে দেন। আমি হাটে-বাজারে যাবো, ঘুরে ফিরে জীবন কাটাবো। শিকল পরা অবস্থায় আমার থাকতে ভালো লাগে না। আপনাদের পায়ে ধরি আমাকে ছেড়ে দেন। না হলে আমি মরে যাবো। এভাবে আমি বাঁচবো না। ডিসি, এসপি স্যারকে আমার কথা বলেন।’

দাদনের এই পরিণতির পেছনে রয়েছে মর্মান্তিক ঘটনা। স্থানীয়রা বলছেন, ছোট থেকেই দাদন হাওলাদার একটু সহজ সরল প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। অন্যের জমি বর্গা চাষ করতেন। কখনো আবার অন্যের ক্ষেতে-খামারে শ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন। মাঝে মাঝে বিভিন্ন এলাকায় আচার বিক্রি করেও জীবিকা নির্বাহ করতেন।

এভাবে আয়-উপার্জন করে স্ত্রী মোকসেদা বেগম, এক ছেলে ইয়ামিন (৪) ও বড় মেয়ে জান্নাত (১২), ছোট মেয়ে মিমি (৮) কে নিয়ে কোনরকম দিন অতিবাহিত করতেন। ছোট ভাই খবির হাওলাদার (৩২) বড় ভাই দাদনের পরিবারের সঙ্গে থাকতেন।

খবির বিয়ে করেছিলেন তিনবার। প্রথম বিয়ের কয়েক বছর পার হলেও কোনও সন্তান না হওয়ায় প্রথম স্ত্রী তাকে ছেড়ে অন্যত্র চলে যায়। এর কিছু দিন পরে খবির দ্বিতীয় বিয়ে করেন। সেই স্ত্রীও কিছুদিন পরে চলে যায়। দেড় বছর পূর্বে তৃতীয় বিয়ে করেন খবির। তৃতীয় বিয়ের কয়েক মাস পরেই বড়ভাই দাদনের স্ত্রী ও ছেলে-মেয়েকে নিয়ে পালিয়ে ঢাকা চলে যান খবির। এরপরই দাদনের জীবনে দুর্যোগ নেমে আসে।

দাদনের মা সুফিয়া বেগমের ভাষ্য, সহজ-সরল দাদন ছেলে-মেয়ে ও স্ত্রীকে হারিয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ে। কাজ কর্মে মন নেই, খাওয়া-দাওয়া নেই, ঘুম নেই। যেদিকে মন চায় সেদিক চলে যান, কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করলে এলোমেলো উত্তর দেন। মাঝে মধ্যে মানুষকেও মারধর করতেন, শরীরে কোনও পোশাক রাখে না। এভাবে কিছু দিনের মধ্যে হয়ে যান মানসিক ভারসাম্যহীন।

এ অবস্থায় বৃদ্ধ বাবা কোনও উপায়ান্তর না পেয়ে বাধ্য হয়ে দাদনকে ছোট একটি ঘরের মধ্যে পায়ে লোহার শিকল দিয়ে সব সময় বেধে রাখেন। এক বছরের বেশি সময় বৃদ্ধ বাবা-মা তাকে কবিরাজি চিকিৎসা, বিভিন্ন ফকির ও হুজুর দিয়ে জিন তাড়ানোর চিকিৎসা করেছেন। কিন্তু তাতে ভারসাম্যহীন দাদনের কোনও উন্নতি হয়নি।

স্থানীয়রা ইউপি মেম্বার আব্দুল করিম বেপারী জানান, দাদনকে পাবনা নিয়ে মানসিক ডাক্তার দিয়ে ভালোভাবে চিকিৎসা করতে পারলে দাদন সুস্থ্য হয়ে জীবন যাপন করতে পারবেন। বৃদ্ধ বাবা-মা’র পক্ষে তাকে নিয়ে পাবনায় গিয়ে চিকিৎসা করানো খুব দুরহ বিষয়। সরকার যদি দাদনকে চিকিৎসা করাতো তা হলে দাদন পুনরায় সুস্থ্য জীবন যাপন করতে পারতেন।

দাদনের চাচা নূর মোহাম্মদ হাওলাদার বলেন, ‘গত বছরের কোরবানির পর ওর আপন ভাই খবির দাদনের স্ত্রী, ছেলে-মেয়েকে নিয়ে যাওয়ার পর থেকেই মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে। প্রথমে আমরা শিকল দিয়ে বেঁধে রাখতাম না। তখন দেখলাম গ্রামের বিভিন্ন দিকে এলোমেলো ছুটে যেত আবার কখনো মানুষকে মারধর করতো, শরীরে পোশাক রাখতো না।’

‘ওর আচরনে বাধ্য হয়ে এখন শিকল দিয়ে বেঁধে রাখছি। দাদনের চিকিৎসা করানোর মত টাকা বাবার কাছে নেই। ওর বাবাও বৃদ্ধ মানুষ। এখন সরকারিভাবে যদি চিকিৎসা করানো যায় তা হলে সুস্থ্য হয়ে যাবে।’

দাদনের পিতা আব্দুল জব্বার হাওলাদার বলেন, ‘আমরা গরীব মানুষ নিজেরা ঠিকভাবে খেতে পারি না। টাকার অভাবে ছেলেটাকে চিকিৎসা করাতে পারি না। আমি ও আমার স্ত্রী দুজনেই বৃদ্ধ মানুষ, কোথাও নিয়ে চিকিৎসা করাবো, কার কাছে নিয়ে যাবো তাও জানি না। আমি আপনাদের মাধ্যমে সরকারের কাছে আবেদন জানাই সরকার যেন আমার ছেলের চিকিৎসা করাই।’

এব্যাপারে লক্ষ্মীপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কাজী তোফাজ্জেল হোসেন বলেন, ‘শিকল দিয়ে বেঁধে রাখার বিষয়টি দুঃখজনক। যেহেতু বেশি দিন হয়নি সেক্ষেত্রে পাবনার সরকারি মানসিক হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা করলে আমার মনে হয় ঐ যুবকের মানসিক রোগ ভালো হবে। এ ক্ষেত্রে আমার যদি কোন সহযোগিতার প্রয়োজন হয় তা হলে আমি সেটা করবো।’

কালকিনি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আ‌মিনুল ইসলাম ব‌লেন, ‘আমি বিষয়টি জানতাম না, আপনাদের মাধ্যমে জানলাম। তার পরিবার যদি অর্থের অভাবে চিকিৎসা করতে না পারে সে ক্ষেত্রে আমাদের কাছে সহযোগিতা চাইলে আমরা সহযোগিতা করবো। জোরপূর্বক যদি কেউ শিকল দিয়ে বেঁধে রাখে তা হলে আইনগত ব্যবস্থা নিব।’

মাদারীপুর জেলা প্রশাসক মো. ওয়াহিদুল ইসলাম বিষয়টিকে নিষ্ঠুর আচারণ হিসেবে দেখছেন। তিনি প্রশাসনের পক্ষ থেকে দাদনের পরিবারকে সহযোগিতার আশ্বাস দেন।

(ঢাকাটাইমস/২৫সেপ্টেম্বর/প্রতিনিধি/ডিএম)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বাংলাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :