জুয়া ঠেকাতে বাধা দুর্বল আইন

বোরহান উদ্দিন
 | প্রকাশিত : ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ১১:১৪
ফাইল ছবি

জুয়াবিরোধী একটি আইন থাকলেও রাজধানীর বিভিন্ন ক্লাবে জুয়ার আসরে গত এক সপ্তাহের অভিযানে আটক দুই শতাধিক ব্যক্তির কারও বিরুদ্ধেই ওই আইনে ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। দেড় শ বছরের পরোনো জুয়ার আইনটি দুর্বল হওয়ায় আটককৃতদের বিরুদ্ধে অন্য ধারায় মামলা দেয়া হচ্ছে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তা বলছেন, ‘দুর্বল’ আইনের কারণেই আটকদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ নেই। আর জুয়াবিরোধী আইন যুগোপযোগী করার পক্ষে মত দিয়েছেন সাবেক আইনমন্ত্রী। তবে সরকার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিলে বিদ্যমান আইনটি যুগোপযোগী কিংবা নতুন আইন করা কঠিন কিছু নয় বলে অভিমত আইনের শিক্ষকের।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশে পাবলিক গ্যাম্বলিং অ্যাক্ট, ১৮৬৭ নামের যে আইনটি রয়েছে সেটি রাজধানীতে প্রয়োগ করার সুযোগ নেই। এর সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, ‘ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকা ছাড়া সমগ্র বাংলাদেশে ইহা প্রযোজ্য হইবে’। অন্যদিকে ঢাকা মহানগর পুলিশ অধ্যাদেশ, ১৯৭৬ এর ৯২ ধারায় প্রকাশ্যে জুয়া খেলার জন্য মাত্র ১০০ টাকা জরিমানা করার বিধান রয়েছে।

সাম্প্রতিক সময়ে আলোচিত ‘ক্যাসিনো’ বা জুয়ার আসরের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে বিরুদ্ধে এই আইনে মামলা হয়নি। আইনটি দুর্বল হওয়ায় এই অভিযান থেমে গেলে আবারও গোপনে ক্যাসিনোর ব্যবসা শুরু হতে পারে বলে শঙ্কা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী কর্মকর্তাদের। বিদ্যমান আইনে আসামিদের কম সাজা ও দ্রুত মুক্তির ব্যবস্থা থাকায় অভিযানে গ্রেপ্তারদের এখন মানি লন্ডারিং, অস্ত্র বা মাদক আইনে মামলা দেয়া হচ্ছে।

১৯৭২ সালের সংবিধানে জুয়া বন্ধের বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়ার জন্য রাষ্ট্রকে নির্দেশনা দেয়া আছে। এই দীর্ঘ পরিক্রমায় পরবর্তীতে আর এ নিয়ে নতুন কোনো আইন হয়নি। তাই এখনো কার্যকর রয়ে গেছে সেই পুরোনো আইন। অন্যদিকে জুয়ার নিয়ে যে আইনটি আছে সেখানে ক্যাসিনো বিষয়ে বলা নেই। তাই ক্যাসিনোর বিরুদ্ধে অভিযান চালালেও এই আইনটি কার্যকরের সুযোগ নেই।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক মো. হাফিজুর রহমান ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘নতুন করে আইন করতে হলে অবশ্যই ক্যাসিনোর বিষয়টি স্পষ্ট করতে হবে। অন্যথায় অপরাধীরা ফাঁক দিয়ে বের হয়ে যাবে।’

জুয়ার আসর থেকে গ্রেপ্তার হলেও অন্য ধারার মামলা দেয়ার বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলছে, জুয়া ও ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) অধ্যাদেশও বেশ পুরোনো ও দুর্বল। তাই অপরাধীরা যাতে শাস্তি থেকে মুক্তি না পায় সেজন্যই অন্য ধারায় মামলা দেয়া হচ্ছে।

ক্যাসিনোর বিরুদ্ধে অভিযান শুরু হয় গত বুধবার। র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) ফকিরাপুলের ইয়ংমেনস ক্লাবে প্রথম অভিযান চালায়। সেখান থেকে নগদ টাকা, মাদক ও ক্যাসিনোর সরঞ্জাম জব্দ করা হয়। ক্লাবটিতে জুয়া-ক্যাসিনো চালানোয় ক্লাবের কর্ণধার যুবলীগ ঢাকা মহানগর দক্ষিণের নেতা খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াকে তার গুলশানের বাসা থেকে অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার করা হয়।

ওইদিন মতিঝিলে ওয়ান্ডারার্স ক্লাব ও গুলিস্তানে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্লাবেও অভিযান চালায় র‌্যাব। এই দুই ক্লাব থেকেও জুয়া-ক্যাসিনোর বিপুল সরঞ্জাম, টাকা জব্দ করা হয়। প্রথম দিনের অভিযানে প্রায় দুই শতাধিক নারী-পুরুষকে আটক করা হয়। এদের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয় ভ্রাম্যমাণ আদালত।

অন্যদিকে যুবলীগ নেতা খালেদের বিরুদ্ধে অস্ত্র, মাদক ও মুদ্রাপাচার আইনে মামলা হয়েছে। এরপরে র‌্যাব অভিযান চালায় কলাবাগান ও ধানমন্ডি ক্লাবে। এ ছাড়া বনানীর একটি বারেও অভিযান চালিয়ে তা সিলগালা করে দেয়া হয়। এ ছাড়া পুলিশের পক্ষ থেকেও চারটি ক্লাব ও ছয়টি বারে অভিযান চালানো হয় যেখান থেকে ক্যাসিনোর সরঞ্জাম, মাদক উদ্ধার করা হয়। কলাবাগান ক্লাবের সভাপতি ও কৃষক লীগ নেতা সফিকুল ইসলাম ফিরোজের বিরুদ্ধে অস্ত্র ও মাদক আইনে দুটি মামলা করে র‌্যাব।

সবশেষ গত মঙ্গলবার আওয়ামী লীগের দুই নেতা ও তাদের কর্মচারী, বন্ধুর বাসায় অভিযান চালিয়ে সাড়ে পাঁচ কোটি টাকা, আট কেজি স্বর্ণ ও অস্ত্র উদ্ধার করা হয়। র‌্যাব বলছে, ক্যাসিনোর টাকা এই বাসাগুলোতে রাখা হতো। অন্যদিকে চট্টগ্রামেও ক্লাবগুলোতে অভিযান চালিয়ে ক্যাসিনোর সরঞ্জাম জব্দ করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হাফিজুর রহমান বলেন, ‘সেই অর্থে জুয়া-সংক্রান্ত কোনো আইন দেশে নেই। যা আছে সেটার নাজুক অবস্থা। এ অবস্থায় ৭২-এর সংবিধানে জুয়া নিষিদ্ধের ব্যাপারে বলা আছে। তাই জুয়া ঠেকাতে কার্যকরী ও কঠোর আইন প্রয়োজন। কারণ এটা সামাজিক অস্থিরতা তৈরি করছে ভীষণভাবে। এজন্য দরকার রাষ্ট্রের নীতিগত সিদ্ধান্ত যে, আপনি জুয়া, ক্যাসিনো, পতিতাবৃত্তি রাখবেন কি না।’

‘এখন যদি আপনি এসবের বৈধতা দেন তাহলে তো সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হবে। কারণ সংবিধান তো এসব বন্ধের জন্য বলেছে। আর যদি বৈধতা না দিয়ে কঠোর হাতে দমন করতে চান তাহলে দ্রুত নতুন আইন করতে হবে। যেখানে কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা রাখতে হবে।’

আওয়ামী লীগের গত মেয়াদের আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদও বলছেন, দ্রুত ক্যাসিনো বা জুয়া বন্ধে নতুন করে কঠোর আইন করতে হবে। সরকার সেই বিষয়ে পদক্ষেপ নেবে বলে প্রত্যাশা এই আইনজীবীর।

ঢাকা টাইমসকে তিনি বলেন, ‘দেশের জুয়ার আইন পুরনো। সাজা খুব কম। তাই এই ধারায় মামলা দিলে লাভ হবে না। যে কারণে এর থেকে শক্ত এমন আইনে মামলা হচ্ছে।’

‘আর ক্যাসিনোর বিষয়টি তো অনেকটা নতুন। আমরা অনেকে চিনতামও না। তাই এসব বন্ধে চলমান আইনটি দ্রুত সংশোধন করে একটি কঠোর আইন প্রণয়ন করা প্রয়োজন। যেখানে সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে থাকবে যাবজ্জীবন কারদন্ডের বিধান। আশা করি সরকার এ ব্যাপারে চিন্তাভাবনা করবে।’

ক্লাবগুলোতে ক্যাসিনোর লাইসেন্স দেয়ার চিন্তাভাবনা হলে সেটা যুক্তিসঙ্গত হবে না বলেও মনে করেন সাবেক এই মন্ত্রী।

সংবাদটি শেয়ার করুন

জাতীয় বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :