যমুনায় স্কুল বিলীন, ছাউনিতে পাঠদান

প্রকাশ | ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ১০:৫২

সাইমুম সাব্বির শোভন, জামালপুর

বাজারের একটি ছাউনিতে চলছে পাঠদান। নেই ব্ল্যাকবোর্ড, চক-ডাস্টার কিংবা ঘরের বেড়া। মাঠ নেই, নেই টিউবওয়েল ও স্যানিটেশন ব্যবস্থা। সাইনবোর্ডহীন একটি রুমে গাদাগাদি করে শিক্ষার্থীদের পড়াচ্ছেন আট শিক্ষক। এমন চিত্র জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জের চিকাজানি ইউনিয়নের খোলাবাড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের।

সপ্তাহে দুই দিন হাটবার। হাটবারে একটি বা দুটি ক্লাস হওয়ার পর স্কুল ছুটি হয়। ২৪৩ জন শিক্ষার্থীর জন্য রয়েছে মাত্র ১৫টি বেঞ্চ।

সরেজমিন দেখা গেছে, যমুনা নদীর তীরের উপর খোলাবাড়ি বাজারের মাছ ও সবজি বিক্রির জন্য নির্ধারিত শেডঘরে ১৫টি বেঞ্চে গাদাগাদি করে বসা ছাত্রছাত্রীদের পড়াচ্ছেন শিক্ষকরা। শেড ঘরটির চারপাশ খোলা। নেই বেড়া। চারদিক থেকে বালুমাখা বাতাস উড়ে আসছে। প্রথম শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত ক্লাস চলে একটি মাত্র রুমেই। প্রতিটি ক্লাসের জন্য রয়েছে তিনটি করে বেঞ্চ।

এক ক্লাসের শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীদের কথাবার্তায় নষ্ট হচ্ছে অন্য ক্লাসের ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষকদের মনযোগ। ক্লাস চলার সময়ে সৃষ্টি হওয়া শব্দদূষণে লেখাপড়া দূরের কথা এখানে টিকে থাকাই দায়। কোনো ক্লাসেই ব্ল্যাকবোর্ড ও চক-ডাস্টার নেই। শিক্ষকদের পড়া বুঝাতে হয় হাতে বই উঁচু করে ধরে রেখে। অংক ক্লাসে কোনো শিক্ষার্থীর খাতায় অংক কষে সেই অংক একহাতে উঁচু করে ধরে বুঝাতে হয় ছাত্রছাত্রীদের। স্যানিটেশন ব্যবস্থা না থাকায় শিক্ষকদের ল্যাট্রিনের কাজ সারতে হয় বাজারের পাশের কোনো বাড়িতে, ছাত্ররা যায় নদীর তীরে।

ছাত্রীরা আশপাশের কোনো বাড়িতে গেলেও পায়খানা নিয়মিত ব্যবহার করতে দেয় না কেউ। ছাত্রছাত্রীদের পানি পান করতে হয় আশপাশের কোনো খাবারের হোটেল থেকে। বাজারে পর্যাপ্ত জায়গা না থাকায় এবং আশপাশে কোনো খেলাধুলার মাঠ না থাকায় টিফিন পিরিয়ডে ছাত্রছাত্রীরা ঘোরাফেরা করে এদিক-সেদিক। কেউ কেউ বাড়ি চলে যায় আর বিদ্যালয়ে ফিরে আসে না।

দুই শিফটে চলা এ বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ২৪৩ জন। প্রতিদিন গড়ে উপস্থিত থাকে দেড় ১৫০ জন। এদের জন্য বেঞ্চ রয়েছে মাত্র ১৫টি। প্রাক-প্রাথমিক, প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে প্রথমম শিফট চলে সকাল সাড়ে নয়টা থেকে ১২টা পর্যন্ত এবং তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণি সাড়ে ১২টা থেকে সোয়া ৪টা পর্যন্ত।

চিকাজানি ইউনিয়নের চর বাহাদুরাবাদ, চিকাজানি, খোলাবাড়ি, চর ডাকাতিয়া, চর মাগুরের হাট গ্রাম ছাড়াও গাইবান্ধা জেলার ফুলছড়ি থানার এন্ডেরবাড়ি ইউনিয়নের তিনটি গ্রাম হরিচন্ডী, পাগলার চর ও তিনধোপা থেকেও এ বিদ্যালয়ে আসে ছাত্রছাত্রীরা। যমুনা নদী পার হয়ে আসে প্রায় ৫০ জন শিক্ষার্থী। এন্ডেরবাড়ি ইউনিয়ন চিকাজানি ইউনিয়নের পাশের ইউনিয়ন হওয়ায় একমাত্র এই খোলাবাড়ি প্রাথমিক বিদ্যালয়য়ে পড়তে আসে তারা।

এবারের বন্যায় ১৭ জুলাই নদীতে বিলীন হয়ে যায় খোলাবাড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি। বিদ্যালয়ের চৌহদ্দি ছেড়েও বাজারের কাছাকাছি চলে আসে যমুনা নদীর ভাঙন। বেশ কিছুদিন বিদ্যালয়টি বন্ধ থাকলে বাজারের শেডঘরে ছাত্রছাত্রীদের পড়ার ব্যবস্থা করে দেয় এলাকাবাসী। ঈদের বন্ধের পর ২০ আগস্ট থেকে এখানেই চালু রয়েছে বিদ্যালয়টির পাঠদান কার্যক্রম।

প্রধান শিক্ষক মরিয়ম কাউছার বলেন, ‘আমি এই বিদ্যালয়ে যোগদান করি ১৮ সালের ৪ অক্টোবর। এবারের বন্যায় বিদ্যালয়ের স্থাপনাসহ সবকিছু নদীগর্ভে বিলীন হলে বাজারের শেডঘরে পাঠদান অব্যাহত রেখেছি। বিদ্যালয়টি পুনঃস্থাপনের জন্য এখনো কোনো জায়গা পাওয়া যায়নি। গত ৫ সেপ্টেম্বর এ বিষয়ে এলাকাবাসী ও ম্যানেজিং কমিটির সদস্যদের নিয়ে একটি সভা করেছি। সভায় আশানুরূপ কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।’

ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি চিকাজানি ইউনিয়নের ২ নং ওয়ার্ডের মেম্বার আ. মান্নান বলেন, ‘বিদ্যালয়ের জায়গা নিয়ে শিক্ষা প্রশাসনসহ সবার সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে। জায়গা পাওয়া গেলেই বিদ্যালয়টি শেডঘর থেকে স্থানান্তর করা যাবে’।

জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আমিরুল ইসলাম এ বিষয়ে বলেন, ‘আমি এ মাসেই যোগদান করেছি। খোঁজ নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি ভাসমান অবস্থায় থাকলেও স্থায়ী কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেনি কেউ। না ম্যানেজিং কমিটি, না উপজেলা শিক্ষা প্রশাসন কিংবা উপজেলা প্রশাসন।

উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আফতাব উদ্দিনের মোবাইল বন্ধ থাকায় তার সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা গোলাম মোস্তফাকে বিদ্যালয়টির পুনঃস্থাপনের বিষয়ে মোবাইলে জানানো হলে তিনি বলেন, ‘শিক্ষা অফিস এখন পর্যন্ত আমাকে কোনো পত্র দেয়নি- তাই বিদ্যালয়টি পুনঃস্থাপনের পদক্ষেপ নেয়া যায়নি। এখনো নদী ভাঙন চলছে। বিদ্যালয়ের জমি বরাদ্দ কীভাবে করব, বুঝে উঠে পারছি না।’

ঢাকাটাইমস/২৭সেপ্টেম্বর/প্রতিনিধি/এমআর