সূচকে অগ্রগতি উন্নয়নের শুভ লক্ষণ

মোহাম্মদ জমির
 | প্রকাশিত : ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ১৫:৪৭
ফাইল ছবি

অর্থনৈতিক সূচকে কোনো রাষ্ট্র ক্রমাগত উন্নতি করলে অন্য রাষ্ট্রগুলো এর কারণ খুঁজে বের করার চেষ্টা করে। সেই রাষ্ট্রের সঙ্গে বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে কীভাবে যুক্ত হওয়া যায় তা বোঝার চেষ্টা করে। পারস্পরিক দ্বিপক্ষীয় খাতে বিনিয়োগ বা অংশীদারিত্বের উদ্দেশ্যেই মূলত উন্নয়ন খাতগুলো শনাক্ত করা হয়।

বহির্বিশে^র বিভিন্ন থিংক ট্যাঙ্কও অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রাখে। এটি স্বাভাবিক অংশীদাররা সামগ্রিক অর্থনৈতিক পরিকাঠামো পর্যবেক্ষণের পর ওই দেশে যৌথভাবে কাজ করার চিন্তা করবে। সামগ্রিক দিক অনুসন্ধানের পর বিনিয়োগের পাশাপাশি অস্ত্র বিক্রির পরিকল্পনা করবে। এই ধরনের চেষ্টা বিভিন্ন সম্ভাবনাময় খাতকে শনাক্তে সাহায্য করবে। বর্তমানে বিভিন্ন রাষ্ট্রের এই ধরনের পর্যবেক্ষণে রয়েছে বাংলাদেশ।

সম্প্রতি ওয়াশিংটনভিত্তিক থিংক ট্যাঙ্ক ‘হেরিটেজ ফাউন্ডেশন’ একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে ‘বাংলাদেশের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা’ সম্পর্কে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করা হয়। সংস্থাটির প্রকাশিত অর্থনৈতিক স্বাধীনতা সূচকে বিশে^ ১২৮তম থেকে ১২১তম স্থান দখল করেছে বাংলাদেশ। অর্থাৎ সূচকে সাত ধাপ উন্নতি হয়েছে। একই সঙ্গে অর্থনৈতিক প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে উঠতে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গঠনমূলক পর্যবেক্ষণ দিয়েছে। অতীতের তুলনায় ব্যবসার পরিবেশের উন্নত করেছে সরকার। কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে ধীরগতির কারণে সম্ভাবনাময় অর্থনৈতিক উন্নয়ন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

সূচকে এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের ৪৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ২৭তম। সংস্থাটির মতে, বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ পরিকাঠামোগত সমস্যা নিরসনে আঞ্চলিক সমশ্রেণিভুক্ত গোষ্ঠীর সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করলে ভালো করবে। তাছাড়া দুর্নীতির ব্যাপক বিস্তার, বিচারহীনতা, বৈদ্যুতিক খাতগুলোতে অপর্যাপ্ত বিদ্যুৎ সরবরাহ, ক্রমাগত অদক্ষ জনশক্তি বৃদ্ধির প্রতিও মনোযোগ আকর্ষণ করা হয়েছে।

এই প্রতিবেদনকে যে কেউ ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখতে পারে। অনেকটা গ্লাসে অর্ধেক পানিকে ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখার মতো। কিন্তু এই আত্মতুষ্টির কারণে সম্ভাবনাময় বিনিয়োগ থেকে বঞ্চিত হতে পারে বাংলাদেশ।

সম্প্রতি যুক্তরাজ্যের ব্রেক্সিট চুক্তির কারণে আরএমজি খাতগুলো চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবে। চ্যালেঞ্জগুলো বিশ্লেষণ করলে তা থেকে উত্তরণের পথ বের করা সম্ভব হবে। ইংল্যান্ডে চলতি আর্থিক বছরের অর্ধেক সময়ে মোট রপ্তানির ১৪.৪২ শতাংশের তুলনায় মাত্র ৩.১৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশটিতে তৃতীয় বৃহত্তম রপ্তানিকারক দেশ বাংলাদেশ। কিন্তু চুক্তি ছাড়া ব্রেক্সিট কার্যকর হলে দেশটিতে রপ্তানির হার হ্রাসের আশক্সক্ষা প্রকাশ করেছে আইএইচওভি।

বাংলাদেশ ২০১৮-১৯ অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বর মাসে ২.০৪ বিলিয়ন ডলার ইংল্যান্ডে রপ্তানি করেছে। এক বছর আগেই এ হার ছিল ১.৯৮ বিলিয়ন ডলার। তাছাড়া ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ইংল্যান্ডে রপ্তানির হার ১১.৭৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ৩.৯৯ ডলার হয়েছে। আগের বছর এ হার ছিল ৩.৫৭ বিলিয়ন ডলার।

ব্রেক্সিট চুক্তির কারণে যুক্তরাজ্যের অর্থনীতি শ্লথ হয়ে গেছে বলে দাবি করেছে পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ। ইংল্যান্ড অন্য দেশ থেকে আমদানি কমিয়ে দিয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে গেলে ব্যবসায়িক নীতি কী হবে তার পরিকল্পনা করছে দেশটি।

অর্থনৈতিক বিশ্লেষক মামুন রশিদ আরেকটি দিক নিখুঁতভাবে শনাক্ত করেছেন। ২০১৮ সালে শেয়ারবাজারের সামগ্রিক পরিস্থিতির কারণে শেয়ারবাজারে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীসহ প্রবাসী বাংলাদেশি নাগরিকরা বিনিয়োগে আকৃষ্ট হচ্ছেন না।

কয়েকটি বেসরকারি সংস্থার দাবি, সরকার শেয়ারবাজারে পৃথক নীতিসহ ইতিবাচক পদক্ষেপের সাহায্যে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ গ্রহণের চেষ্টা করছে। কিন্তু এখনো দৃশ্যমান পরিবর্তন ঘটেনি। ২০১৮ সালে শেয়ারবাজারে অধিকাংশ আইপিও অফার স্বীকৃত কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে আসেনি তা সত্য। বড় প্রতিষ্ঠানের তুলনায় ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠান থেকে শেয়ারবাজারে বেশি বিনিয়োগ হয়েছে। এই পরিস্থিতি বাজারে জনস্বার্থকে প্রভাবিত করবে। এই ধরনের প্রবণতা দেশের বাইরে টাকা পাঠাতে প্রণোদিত করবে। অথবা দেশে বিভিন্ন ব্যাংকে টাকা জমা রাখতে আরও চাপ দেবে।

এই ধরনের পরিস্থিতি ব্যাংকের তরলি অবস্থা উন্নতির পরিবর্তে টাকা জমা রাখার ওপর বেশি চাপ প্রয়োগ করবে।

বিশেষভাবে মার্কিন ডলারসহ বিনিময় হারের অস্থির ওঠা-নামার জন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমাকৃত টাকা থেকে মুনাফা সরিয়ে নিতে প্রভাবিত করবে বিনিয়োগকারীদের। ফলে অনেক বিদেশি বিনিয়োগকারী বাধ্য হবেন শেয়ার বিক্রি বন্ধ করতে।

২০১৮ সালের শেষার্ধে শেয়ারবাজারে যৌথ সরকার ব্যবস্থার পরিচালনায় উন্নীত হয়েছে। কিন্তু শেয়ারবাজার নিয়ে প্রত্যাশার শতভাগ পূরণ হয়নি। করপোরেট প্রতিষ্ঠান এবং পরিচালকদের কোম্পানির তুলনায় ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা তা পরিচালিত করছে। কয়েকটি উন্নত দেশসহ শ্রীলঙ্কা, ভারত, সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়াতে একই ঘটনা ঘটেছে।

শেয়ারবাজারে বিদেশি করপোরেট প্রতিষ্ঠানের অনুপস্থিতির পরিবর্তন ঘটাতে হবে। এ বিষয়টি আমাদের বোঝা উচিত। কারণ বিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি থেকে ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতিতে পৌঁছার জন্য এ পরিবর্তন গুরুত্বপূর্ণ।

আমরা আশা করি, আর্থিক খাত বিশেষভাবে ব্যাংকিং খাতের উন্নয়নে সরকার নিজেদের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করবে। আধুনিক বিশে^ ই-কমার্স যুগে প্রবেশ করতে হলে অতীতের আইনের সংস্কার প্রয়োজন। অধিক ডিজিটাল অর্থনীতি এবং ক্যাপিটাল ইসুয়েন্স কনফিগারেশনের গতি বৃদ্ধির জন্য পদক্ষেপ নিতে হবে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুর্নীতির বিস্তার রোধে জিরো টলারেন্স নীতি অবলম্বন করেছেন। তাছাড়া বহির্বিশে^ বাংলাদেশের সুনাম বিনষ্টের জন্য দায়ী বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে সরকারের পদক্ষেপের প্রতিফলন ঘটছে। যেমন বিভিন্ন পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁসের কারণে দেশে ও বহির্বিশে^ শিক্ষাব্যবস্থার মান সম্পর্কে প্রশ্নের সৃষ্টি মুখোমুখি করেছিল। সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপের মাধ্যমে প্রশ্ন ফাঁস বন্ধ করতে পেরেছে। এই ধরনের বিভিন্ন বিষয়ে পুনরায় আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে।

বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) নিরাপত্তা বাহিনীর সহায়তায় মৃতপ্রায় বুড়িগঙ্গা ও তুরাগ নদীর তীরে গড়ে ওঠা অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে অভিযান পরিচালনা করে। এ অভিযান টানা ৫২ দিনের বেশি পরিচালিত হয়। অবৈধভাবে কারখানা ও করাতকল তৈরির অভিযোগে কয়েকজনকে জেলে পাঠানো হয়েছে। এই উচ্ছেদ অভিযান ঢাকার স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে বিদ্যমান হতাশা দূর করে আশার আলো দেখিয়েছে। বিআইডব্লিউটিএ কর্তৃপক্ষ উচ্ছেদকৃত স্থানে বিনোদন কেন্দ্র গড়ে তোলার পরিকল্পনা করছে। সেখানে শিশুরা খেলাধুলা করবে।

তাছাড়া ব্যাপক অনুসন্ধানের পর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ১১টি খাতে দুর্নীতির ঘটনা শনাক্ত করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ইলেকট্রিক জিনিসপত্র ক্রয়ে টেন্ডার প্রক্রিয়া, বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার অনুমোদনের পূর্বে অনুসন্ধান করা। এসব বিষয় উন্মুক্ত প্রক্রিয়ায় হওয়া উচিত। যেন প্রত্যেকের জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত হয়। স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতি বন্ধে ২৫টি সুপারিশ করেছে দুদক। ইতিমধ্যে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রীর কাছে সুপারিশপত্র হস্তান্তর করা হয়েছে।

দেশের প্রান্তিক জনগণের মাঝে বিদ্যুৎ সুবিধা পৌঁছে দেওয়ার উদ্দেশে সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। ইতিমধ্যে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় দশ লাখ মানুষকে বিদ্যুৎ সুবিধায় আনতে একটি প্রকল্প পাস করা হয়েছে। ২০২০ সালের জুন মাসের মধ্যে বিদ্যুৎ বিভাগের তত্ত্বাবধানে ‘এক্সটেনশন অফরোরাল ইলেকট্রিফিকেশন প্রজেক্ট’ বাস্তবায়িত হবে। বিশ লাখ মানুষ বিদ্যুৎ সুবিধায় এলে গ্রামীণ জনগণের জীবনমান অনেক উন্নত হবে। তাছাড়া এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে বিভিন্ন খাত যেমনÑ শিক্ষা, স্বাস্থ্য, দক্ষ জনশক্তি তৈরি এবং ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা তৈরিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

উদাহরণস্বরূপ শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম এবং সিঙ্গাপুরের পরিস্থিতি স্মরণ করা জরুরি। যদি অদক্ষ জনশক্তিকে দক্ষ জনশক্তিতে পরিণত করা যায় তাহলে অন্যান্য দেশও জনশক্তি আমদানিতে আগ্রহী হবে। একই সঙ্গে দেশে ডিজিটাল প্রযুক্তির উন্নয়ন, বিদ্যুৎ সুবিধা নিশ্চিত এবং দক্ষ জনশক্তি থাকলে বিদেশি বিনিয়োগ আরও বৃদ্ধি পাবে। ফলে ক্রমবর্ধমান শিক্ষিত জনশক্তিকে সঠিকভাবে কাজে লাগানো যাবে।

গত কয়েক দশকে আমরা ব্যাপক প্রত্যাশা সৃষ্টি করতে পেরেছি। আমাদের দৃষ্টি আরও বহুদূর। দেশে ধারাবাহিকভাবে দারিদ্র্যের হার কমছে এবং জনগণের মাঝে পুষ্টির পরিমাণও বৃদ্ধি পাচ্ছে। মুদ্রাস্ফীতির হার নি¤œমুখী এবং ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা তৈরি হচ্ছে। বর্তমানে বেকারত্বের হার অনেক কম এবং আরএমজি খাতগুলো বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করছে। চলতি আর্থিক বছরের শেষে প্রবৃদ্ধি ৮.১৩ শতাংশে পৌঁছানোর আশা রয়েছে। পাশাপাশি মাথাপিছু আয় বেড়ে ১৯০৯ ডলার হবে। এসব সামগ্রিক উন্নয়ন একটি দেশের উন্নয়নের শুভ লক্ষণ।

অনুলিখন: রকিবুল হাসান রবিন

মোহাম্মদ জমির: সাবেক কূটনীতিক

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :