তাদের ঠিকানা এখন বৃদ্ধাশ্রম

জহির রায়হান, ঢাকাটাইমস
 | প্রকাশিত : ০১ অক্টোবর ২০১৯, ০৮:১৩

হাড়-মাংস পানি করে সন্তানের জন্ম দেন মা। একা মা দুই হাতে তার সব সন্তানকে লালন করেন। কোনও সন্তানের প্রতিই কমতি পড়ে না মায়ের স্নেহ-ভালোবাসার। কিন্তু বয়সকালে সেই সন্তানের কাছেই মা হয়ে পড়ছেন অচ্ছুত, বোঝা। দেশে পরিবারবিচ্ছিন্ন এমন মায়ের সংখ্যা বাড়ছে। তার সঙ্গে বাড়ছে বয়ষ্ক বাবারও সংখ্যাও। তাদের জন্য বাণিজ্যিকভাবে গড়ে উঠছে বৃদ্ধাশ্রম। কিন্তু বৃদ্ধাশ্রমে কেমন আছেন সেসব বাবা-মায়েরা? রাজধানীর কয়েকটি বৃদ্ধাশ্রম ঘুরে দেখা গেছে তাদের করুণ কাহিনি।

আওয়ামী লীগ টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় এসে প্রবীণদের সুরক্ষায় একটি প্রকল্প গ্রহণ করে। পল্লী নিবাস নামের ওই প্রকল্পটি চলতি বছরে একনেকে পাস হয়। এছাড়া মা-বাবাকে অবহেলা করলে সাজার কথাও বলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যানুযায়ী, বর্তমানে দেশে মোট জনসংখ্যার ৭ থেকে ৮ শতাংশ প্রবীণ। ২০৫০ সালে বাংলাদেশে প্রবীণের সংখ্যা দাঁড়াবে প্রায় ২০ লাখ অর্থাৎ ওই সময়কার মোট জনসংখ্যার ২২ থেকে ২৩ শতাংশ থাকবে প্রবীণ। আর বাংলাদেশে মানুষের আয়ু যে হারে বাড়ছে তা অব্যাহত থাকলে আগামী ৩২ বছর পর দেশের প্রতি পাঁচজনে একজন থাকবেন প্রবীণ।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে পরিবারবিচ্ছিন্নতা বাড়ছে। বিশেষ করে উচ্চ-মধ্যবিত্তদের মধ্যে এই প্রবণতা বেশি। বৃদ্ধ বয়সে এসে অনেককে পরিবারছাড়া হতে হচ্ছে। বাধ্য হয়ে ঠিকানা হিসেবে বেছে নিতে হচ্ছে বৃদ্ধাশ্রম। এই বাস্তবতায় প্রবীণ নিবাস বা বৃদ্ধাশ্রমের সংখ্যাও বাড়ছে। অনেকে বাণিজ্যিকভাবে বৃদ্ধাশ্রম খুলছেন। এ বৃদ্ধাশ্রমগুলো থেকে আয়ে কর অব্যাহতিও দেওয়া হয়েছে। প্রবীণরা যেন পরম মমতায় একটু ভালো থাকেন সেটাই সবার প্রত্যাশা।

কিন্তু বাস্তবতা হলো বৃদ্ধাশ্রমে ভালো নেই বৃদ্ধ মায়েরা। একদিকে স্বজন-পরিজনহীন একাকী জীবন, অন্যদিকে বৃদ্ধাশ্রমের নানা সমস্যা। অসুখবিসুখে সেবা করার তেমন কেউ নেই। শারীরিক কষ্ট যতটা না পীড়া দেয়, মনের গহিন কোণে লুকানো কষ্ট পীড়া দেয় আরো বেশি। সন্তানরা তাদের সন্তানদের নিয়েই ব্যস্ত, বৃদ্ধ মায়ের বৃদ্ধাশ্রমের খরচটা বহন করেন, কিন্তু দেখা করতেও আসেন কম। সন্তানরা কি বোঝেন, পৃথিবীতে মায়ের কাছে সন্তানের মুখের চেয়ে প্রতীক্ষিত মুখ আর একটিও নেই? বুক হাহাকার করা শূন্য এ বুকে ফিরে যায় কত সন্তান?

রাজধানীর বৃদ্ধাশ্রমে কেমন আছেন মায়েরা? বেশ কয়েকটি বৃদ্ধাশ্রম ঘুরে শোনা গেছে করুণ কাহিনিই শুধু। বৃদ্ধ মায়ের চোখের জলে আর্দ্র হয়ে ওঠে হৃদয়। আগারগাঁওয়ের প্রবীণ হিতৈষী নিবাসের একটি কক্ষে পাঁচ বছর ধরে রয়েছেন ৬৯ বছর বয়সী নাজমা জাহান। অল্প দূরেই মিরপুরে বসবাস করের তার দুই ছেলে, দুই মেয়ে। কিন্তু সন্তানদের কারো বাড়িতেই ঠাঁই হয়নি এই মায়ের।

তিনি বলেন, ‘স্বামী হারানোর পর তিন মাস-তিন মাস করে ছেলেদের বাসায় থাকতাম। কিন্তু ছোট ছেলে বউ নিয়ে শ্বশুরবাড়ি চলে যাওয়ার পর বড় ছেলে তার একার পক্ষে আমাকে সারা বছর বাড়িতে রাখা সম্ভব নয় বলে জানিয়ে দেয়। এরপর বৃদ্ধাশ্রমে রেখে গেছে।’

তিনি জানান, ছেলেরা প্রতি মাসেই বৃদ্ধাশ্রমের খরচ পাঠিয়ে দায়িত্ব শেষ করে। আর মেয়েরা মাঝেমধ্যে এসে খোঁজখবর নিয়ে যায়। এছাড়া নিবাসে খাওয়াদাওয়ার মান খুব খারাপ বলেও জানান এই বৃদ্ধ মা।

নাজমা জাহানের মতো প্রবীণ নিবাসে প্রায় প্রতিদিনই বাড়ছে বয়সী নারীদের সংখ্যা। এখানে বর্তমানে ৪০ জনের মতো এমন নারী রয়েছেন। এছাড়া খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে গাজীপুরের কয়েকটি বৃদ্ধাশ্রম, সাভার বৃদ্ধাশ্রম এবং সমাজসেবা অধিদপ্তরের বৃদ্ধাশ্রমেও বাড়ছে বয়সী মায়েদের সংখ্যা।

রাজধানীর উত্তরখানের মৈনারটেক এলাকায় অসহায় ও দুস্থ নারীদের জন্য রয়েছে আরেকটি বৃদ্ধাশ্রম। এখন ২৫ জন নারী বাস করছেন এখানে। শ্যামলীতে একটি বাড়ি তিন ও চারতলা ভাড়া করে চালানো হয় অরুণিমা নামের একটি বৃদ্ধাশ্রম। এমন বৃদ্ধাশ্রমের সংখ্যাও দিন দিন বাড়ছে রাজধানীতে।

সমাজে প্রবীনদের প্রতি ধ্যান ধারণার পরিবর্তন জরুরী বলে মনে করছেন প্রখ্যাত ভাষাবিজ্ঞানী ও ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিটের (আইএমএল) পরিচালক ড. শিশির ভট্টাচার্য।

তিনি বলেন, ‘একটা সময় ছিল, ঢাকা শহরেও যৌথ পরিবার ছিল। নগরায়ণের কারণে যৌথ পরিবারগুলো ভেঙে যাচ্ছে। একক পরিবারে মা-বাবা আর সন্তানের প্রাধান্যই বেশি দেখা যায়। নানা-নানি কিংবা দাদা-দাদিসহ পরিবারে বয়োজ্যেষ্ঠদের প্রাধান্য আর দেখা যায় না। অথচ আগে পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠরা প্রধান হর্তাকর্তা ছিলেন। একটি পরিবারকে অটুট বন্ধনে বেঁধে রাখতে তাদের অভিজ্ঞতা পরিবারের সবার চলার পাথেয় হিসেবে কাজ করে।’

‘এখন যৌথ পরিবারে ভাঙনের সুর, বৃদ্ধাশ্রম বেড়ে যাওয়া, মানুষের শেষ সময়ের আশ্রয় এখন বৃদ্ধাশ্রম হওয়ার ক্ষেত্রে, মানসিকতার পরিবর্তন অনেক বড় ভূমিকা পালন করে।’

মা-বাবার ভরণপোষণ নিয়ে সন্তানের দুশ্চিন্তা থাকলে সেটাকে মানসিক বৈকল্য উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমাদের মনের ইচ্ছা-সহনশীলতা, শ্রদ্ধা ধরে রাখতে পারলে আমাদের বাবা ও দশভুজা মায়েদের জীবনের শেষ সময়টাকে এভাবে নিঃসঙ্গ করে দিত না।’

প্রবীণদের জন্য একটি ব্যতিক্রমী প্লাটফর্ম ‘প্রবীণ অধিকার মঞ্চ বাংলাদেশ’। সংগঠনটির সভপতি বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘প্রবীনদের নিঃসঙ্গতা সব চেয়ে বড় সমস্যা। প্রায় সবার ক্ষেত্রে এটা দেখা যায়। পরিবারে অন্য সদস্যরা তাদের অবহেলার চোখে দেখে। তারা তাদের মনের কথা বলার জন্য সঙ্গি পায় না। অসুস্থ হলে ভালো সেবা পান না।’

তিনি বলেন, ‘প্রবীণরা পরিবারের সদস্যদের ছাড়া থাকুক এটা আমরা চাই না। আমরা চাই প্রবীণরা যেন তার পরিবারের সঙ্গে থাকে। এ জন্য আমরা পরিবারের অন্য সদস্যদের বোঝাই। তারা যেন তাদের সঙ্গেই প্রবীণদের রাখে। তাদের সঠিক যত্ন নেন। পরিবারের সদস্যদের এ ব্যপারে কাউন্সেলিং করি। কারণ সবাইকে একদিন প্রবীণ হতেই হবে।’

পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউণ্ডেশনের (পিকেএসএফ) চেয়ারম্যান কাজী খলীকুজ্জমান বলেন, পিকেএসএফের মাধ্যমে প্রবীণদের জন্য কাজ করা হয়। আমাদের সমৃদ্ধ কর্মসূচী আছে ২২৫ টি উপজেলায়। প্রবীণদের জন্য সরকার ভাতা দেয়। যেসব প্রবীণরা সরকারী ভাতা পায় না কর্মসূচীরভূক্ত উপজেলায় ৫০০ টাকা করে মাসিক ভাতা দিয়ে থাকি।’

(ঢাকাটাইমস/০১অক্টোবর/প্রতিনিধি/ডিএম)

সংবাদটি শেয়ার করুন

ফিচার বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

ফিচার এর সর্বশেষ

কিডনি রোগ বাড়ছে শিশুদেরও! যেসব লক্ষণ দেখলেই সতর্কতা জরুরি

সস্তার পেয়ারার গুণে বশে থাকে ডায়াবেটিস-উচ্চ রক্তচাপসহ নানা জটিল রোগ

যে পাঁচ সমস্যায় আক্রান্তরা গুড় খাওয়ার আগে একবার ভাবুন, নইলে...

সাজেদুর রহমান শাফায়েতের স্বপ্ন পৃথিবী ঘুরে দেখা

খাওয়ার পরপরই চা পান উপকার না ক্ষতি? কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা

জ্বরের মধ্যে যে পাঁচ খাবার খেলেই বিপদ! জানুন, সাবধান হোন

গরমে হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ে ডায়াবেটিস রোগীদের! সুস্থ থাকবেন যেভাবে

মুখে দুর্গন্ধের কারণে হা করতেও অস্বস্তি লাগে? সমাধান কী জানুন

লিভার ভালো রাখে লাউ! ওজন এবং উচ্চ রক্তচাপও থাকে নিয়ন্ত্রণে

কিডনি ভালো রাখে আমের পাতা! উচ্চ রক্তচাপও থাকে নিয়ন্ত্রণে

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :