৭২ বছর পর নৌপথে ঢাকা-কলকাতা ভ্রমণ

প্রকাশ | ০২ অক্টোবর ২০১৯, ১০:৩৮

ফরিদ আহম্মদ বাঙ্গালী
এমভি মধুমতি কলকাতার উদ্দেশে ছেড়ে যায়

নৌপথে ঢাকা-কলকাতা-ঢাকা যাতায়াত! অবাক হওয়ারই কথা। তবে এটি ৭২ বছর পূর্বের ইতিহাস। ব্রিটিশ শাসনামলে আসাম থেকে ঢাকা-চাঁদপুর-বরিশাল হয়ে কলকাতা নদীপথে চলত স্টিমার। সময় লাগত ১০ দিন। দেশভাগের পর এই সার্ভিস বন্ধ হয়ে যায়।

১৯৪৭ সালে ব্রিটিশরা চলে যাওয়ার সময় এই উপমহাদেশকে ধর্মের ভিত্তিতে দুই ভাগ করে দিয়ে গেছে। ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল ঘটনা বটে। একই ভাষা, একই সংস্কৃতি, একই চিন্তা-ভাবনার মানুষ অথচ ভিসা পাসপোর্টের বেড়াজালে আটকে গেল উপমহাদেশের অত্যন্ত অভিজাত ও গুরুত্বপূর্ণ ঢাকা-কলকাতা এই দুই শহর।

৭২ বছরে অনেক ঘটনা ঘটে গেছে। ইতিমধ্যে দুই দেশের মানুষজন প্লেনে, ট্রেনে বা বাসে চড়েই ঢাকা-কলকাতা যাওয়া আসা করছে। প্রতিবছর এই তিনটি পথেই মোট ১৫ লাখ যাত্রী ঢাকা-কলকাতা যাওয়া আসা করে। এদিকে নৌপথে পণ্য পরিবহন চালু থাকলেও সাধারণ যাত্রীদের একে অন্যের দেশে নৌপথে চলাচলের সুযোগ ছিল না।

নৌপথে ভ্রমণের সেই সুযোগটা এনে দিয়েছে বাংলাদেশ এবং ভারত সরকার। এর অংশ হিসেবে ‘এমভি মধুমতি’ নামের জাহাজটি চলতি বছর ২৯ মার্চ ঢাকা থেকে ছেড়ে যায় কলকাতা বন্দরের উদ্দেশে। আমি বড়ই সৌভাগ্যবান যে দেশের বাইরে আমার জীবনের প্রথম ভ্রমণ, ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে সেই প্রমোদতরীতে করে। ঢাকা-কলকাতার ঐতিহাসিক সেই ৬৪ ঘণ্টার জাহাজ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা আমি ও আমার সহযাত্রীদের মনে গেঁথে থাকবে বহুকাল।

ব্রিটিশ শাসনামলে উভয় বাংলার মধ্যে নৌপথে মানুষ ও পণ্যের ছিল অবাধ যাতায়াত। দেশভাগের পর তৎকালীন পাকিস্তান শাসনামলে দুই দেশের মধ্যে জলপথে পণ্য পরিবহন হলেও বন্ধ হয়ে গেছে যাত্রী পরিবহন। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর ১৯৭১ সালে দুই দেশের মধ্যে নৌপ্রোটকল স্বাক্ষরিত হয়। কিন্তু ১৯৮০ সালের ৪ অক্টোবর দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এরপর থেকে নৌপ্রোটকলটি বাণিজ্য চুক্তির অংশ হিসেবে পরিচালিত হয়ে আসছে। অতঃপর ২০১৫ সালের ১৬ নভেম্বর বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে যাত্রী ও ক্রুজসার্ভিস চালুর জন্য সমঝোতা স্মারক সই হয়। ২০১৮ সালের ২৫ অক্টোবর এই বিষয়ে স্ট্যান্ডার্ড অপারেটর প্রসিডিউর (এসওপি) সই করার মাধ্যমে স্মারক ও এসওপি অনুযায়ী বাংলাদেশি ক্রুজশিপ এমভি মধুমতি ২৯ মার্চ ঢাকা হতে কলকাতার উদ্দেশে আনুষ্ঠানিকভাবে রওয়ানা করে। অন্যদিকে, ভারতের ক্রুজশিপ আরভি বেঙ্গল গঙ্গা কলকাতা হতে একই দিন রওয়ানা করেছিল ঢাকার পথে। মূলত শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর  বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বিভিন্ন পথে যোগাযোগ ব্যবস্থা ব্যাপক বিস্তৃতি লাভ করে। ১৯৯৯ সালে চালু হয় ঢাকা-কলকাতা আন্তঃদেশীয় বাস সার্ভিস। ২০০৮ সালে আন্তঃদেশীয় যাত্রীবাহী ট্রেন ‘মৈত্রী এক্সপ্রেস’ চলাচল শুরু করে। ২০১৭ সালে চালু হয়েছে খুলনা-কলকাতার মধ্যে ‘বন্ধন এক্সপ্রেস’।

বর্তমানে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সপ্তাহে প্রায় ১০০টি ফ্লাইট চলাচল করছে, যা নয়াদিল্লি, কলকাতা, মুম্বাই, চেন্নাইকে ঢাকা এবং চট্টগ্রামের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করেছে। এমভি মধুমতির যাত্রী ধারণক্ষমতা ৭৫০ জন। জাহাজে আছে ৬০টি কেবিন। যার মধ্যে চারটি ভিআইপি কেবিন। দোতলার মধ্যখানে আছে বেশ বড়ো লবি। ডেক এবং তিনতলায় আছে বিশাল খোলা স্পেস। বিশাল এ জাহাজে আমরা ছিলাম মাত্র ১৩৮ জন। এরমধ্যে যাত্রী ছিলাম ৮০ জন। ছিলেন জাতীয় সংসদ সদস্য, সাংবাদিক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ। পাগলা থেকে যাত্রা শুরুর পর গান, আড্ডা, গল্পের মধ্যদিয়ে চাঁদপুর হয়ে গভীর রাতে বরিশাল লঞ্চঘাট আর কীর্তনখোলার রাতের সৌন্দর্য ছিল উপভোগ্য। গাবখান চ্যানেল হয়ে আমরা যখন মোড়েলগঞ্জে পৌঁছলাম তখন সকাল সাড়ে ১০টা কিংবা ১১টা। সেখানে প্রায় আধা ঘণ্টার যাত্রাবিরতি।

ছোট-বড় নদী পেরিয়ে ১২ নটিকেল মাইল বেগে ছুটে চলেছে জাহাজ মংলা বন্দরের পার্শ্বদিয়ে রামপাল হয়ে ঘষিয়াখালী চ্যানেল ধরে। শিবসা নদী হয়ে জাহাজ প্রবেশ করল রয়েল বেঙ্গল টাইগার এর রাজ্য সুন্দরবনের ভেতরে। ঘন সবুজ বন দেখতে দেখতেই সন্ধ্যা ৬টায় পৌঁছে গেলাম আংটিহারা সেখবাড়িয়া নদীতে। এটি সাতক্ষীরা জেলায় অবস্থিত একেবারে সীমান্ত জনপদ শ্যামনগর উপজেলায়। নোঙর ফেলল মধুমতি। ৩০ মার্চ রাত ৯টার মধ্যেই শেষ হলো আমাদের বাংলাদেশ ইমিগ্রেশনের কাজ। প্রায় ১২ ঘণ্টার যাত্রাবিরতি শেষে ভোর ৬টায় আবারও যাত্রা শুরু। যাত্রাবিরতির কারণ হিসেবে জানা যায় সুন্দরবনের ভিতর আঁকাবাঁকা সরু নদী আমাদের নাবিকদের জন্য একেবারে নতুন পথ।

দুই.

রায়মঙ্গল সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত একটি দীর্ঘ নদী। যার সম্পর্ক একেবারে বঙ্গোপসাগরের সঙ্গে। এর একটি অংশ বাংলাদেশে, আরেকটি ভারতে। আংটিহারা থেকে যাত্রা করে প্রায় চার ঘণ্টার পানিপথ পাড়ি দিয়ে আমরা ভারতীয় অংশের নামখানা-হেমনগরে পৌঁছলাম ৩১ মার্চ প্রায় সকাল ১১টার দিকে।  বাংলাদেশ আর ভারতের নদী সীমান্তে শুধু একটি বয়া। সেখানে নেই কাঁটাতারের বেড়া, একই নদী, একই পানি, আছে জোয়ার ভাটা। মাঝনদীতেই নোঙর ফেলল মধুমতি। আমাদের অদূরেই নোঙর ফেলেছিল কলকাতা থেকে ছেড়ে আসা এমভি বেঙ্গল গঙ্গা। সেটিও মধুমতিকে ক্রস করে একই সময় বাংলাদেশে প্রবেশ করলো। কলকাতার কাস্টমস অফিসার ও বিএসএফএর অফিসাররা হাসিমুখে আমাদের বরণ করে নিলেন। প্রায় ছয় ঘণ্টা লাগল কাস্টমসের কাজ শেষ হতে।

বিকাল ৫টার কিছু পর ভারতীয় পতাকাবাহী দুটি ছোটো জাহাজ এমভি দরকেশ্বর ও এমভি কোয়েলএসকর্ট করে পাঁচ নটিকেল মাইল ধীরগতিতে নিয়ে যায় কলকাতার পথে। বাংলাদেশের সুন্দরবন শেষে শুরু হয় কলকাতার সুন্দরবনের অংশ। সেটি পুরোটাই অতিক্রম করতে হয়েছে । বলা যায় বাংলাদেশের প্রায় ছয় হাজার বর্গমাইল আর ভারতের প্রায় চার হাজার বর্গমাইল মিলে প্রায় ১০ হাজার বর্গমাইলের সুন্দরবন এপাশ থেকে ওপাশ পুরোটাই অতিক্রম করতে হয়েছে। ৩১ মার্চ বিকাল ৫টা থেকে একটানা চলে এমভি মধুমতি। ১ এপ্রিল দুপুর সাড়ে ১২টায় পৌঁছে কলকাতা ইনল্যান্ড পোর্টে। তারপর স্বল্পসময়ের মধ্যেই সম্পন্ন হয় ইমিগ্রেশন। আর এর মধ্য দিয়ে শেষ হয় আমাদের ৬৪ ঘণ্টার অসাধারণ এক জাহাজ যাত্রা।

 আমাদের ভ্রমণটি ছিল পরীক্ষামূলক। পথটি ছিল অচেনা। বিরতি দিতে হয়েছে প্রায় ২০ ঘণ্টা। ভবিষৎতে ৩৮-৪০ ঘণ্টার বেশি লাগবে না ঢাকা থেকে কলকাতা পৌঁছতে। নৌপরিবহন মন্ত্রনালয় সূত্রে জানা যায়, আটটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এই পথে জাহাজ চালাতে আবেদন করেছে। পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে এখনও সিদ্ধান্ত হয়নি।

নদীমাতৃক বাংলার দুই অংশের এই যোগাযোগ এখন থেকে নিয়মিত হোক। বাংলাদেশ নদীবিধৌত ব-দ্বীপ। বাংলার প্রকৃতি অবলোকন করতে হলে, সুন্দরবনের অপার সৌন্দর্য উপভোগ করতে হলে এপথে নৌভ্রমণের বিকল্প নেই। মধুমতি আর গঙ্গা নামের দুইটি ক্রুজশিপ উভয় বাংলার সৌন্দর্যপিপাসু মানুষের জন্য সেই সৌন্দর্য আস্বাদনের সবচেয়ে বড় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।

লেখক: কলামিস্ট