অভিযানের প্রভাব ডলার বাজারে

প্রকাশ | ০৪ অক্টোবর ২০১৯, ০৮:০৬

রহমান আজিজ

সাম্প্রতিক সময়ে ক্যাসিনোসহ বিভিন্ন অবৈধ কার্যক্রমের বিরুদ্ধে অভিযান শুরুর পর দেশে ডলারের চাহিদা অনেক বেড়ে গেছে। এর প্রভাব পড়েছে ডলার মার্কেটে। বিশেষ করে কার্ব মার্কেটে হু হু করে বাড়ছে ডলারের দাম। সে তুলনায় সরবরাহ কম বলে জানান মানি এক্সচেঞ্জাররা।

কার্ব মার্কেটে ডলারের এই মূল্যবৃদ্ধি হুন্ডির প্রবণতা বাড়াচ্ছে, যা প্রকারান্তরে রেমিট্যান্স প্রবাহে প্রভাব ফেলবে বলছেন অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, অবৈধ অর্থ অজর্নকারীরা টাকাকে ডলার করে বিদেশে পাচার করছে। এতে করে দেশে ডলারের চাহিদা প্রতিদিন বাড়ছে। ফলে প্রবাসী আয় (রেমিট্যান্স) ব্যাংককিং চ্যানেলে না এসে হুন্ডিতে আসার আশঙ্কা করছেন তারা। তাই ডলার কেনাবেচার ওপর নজরদারির কথা বলছেন বিশেষজ্ঞরা।

গতকাল কয়েকটি ব্যাংক, মানিচেঞ্জার এবং কার্ব মার্কেটে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ১০-১৫ দিন ধরে ডলারের চাহিদা কয়েক গুণ বেড়েছে। ঢাকার বাজারে কোথাও প্রতি ডলার ৮৭.১০ টাকা, কোথাও ৮৭ আবার কোথাও ৮৬.৯০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। চট্টগ্রামে প্রতি ডলার বিক্রি হচ্ছে ৮৭.৬০ থেকে ৮৮ টাকা পর্যন্ত।

বাংলাদেশ ব্যাংক নির্ধারিত আন্তঃব্যাংক ডলার লেনদেনের রেট ৮৪.৫০ টাকা। সেখানে স্প্রেড ১ থেকে ১.৫০ টাকা বেশি নিয়ে মানিচেঞ্জার বা কার্ব মার্কেট বেচলে দাম পড়ে ৮৫.৫০ টাকা বা সর্বোচ্চ ৮৬ টাকা। কিন্তু কার্ব মার্কেটে বর্তমানে ৮৭.১০ থেকে ৮৮ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে ডলার।

প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযানে সম্প্রতি বিভিন্ন ব্যক্তির বাসা ও অফিস থেকে দেশি-বিদেশি বিপুল নগদ অর্থ, স্বর্ণ, মদ জব্দ করেছে র‌্যাব। অভিযান আরও চলবে বলে জানিয়েছে সরকার ও সংশ্লিষ্ট বাহিনী।

এই অভিযান থেকে বাঁচতে সন্দেহভাজনরা কেউ কেউ বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন, কেউবা অর্থ পাচারের চেষ্টা করছেন, আবার কেউ ভার কমাতে অবৈধ টাকাকে ডলারে রূপান্তরের চেষ্টা করছেন বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে।

অনলাইন ক্যাসিনোর গডফাদার সেলিম প্রধানকে মঙ্গলবার বিদেশে পালানোর সময় শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের বিমান থেকে আটক করা হয়। এর আগে আটক জি কে শামীম, খালেদ মাহমুদ বিদেশে পালাতে গিয়েও বিমানবন্দর থেকে ফিরে আসেন। ওয়ান্ডরার্স ক্লাবের পরিচালক গেন্ডারিয়ার এনামুল হক পালিয়েছেন থাইল্যান্ড, যার তিন বাসা থেকে পাঁচ কোটি টাকা ও আট কেজি স্বর্ণ জব্দ করে র‌্যাব।

ক্যাসিনো ও দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের প্রভাব ডলারের কার্ব মার্কেটে পড়েছে বলে সন্দেহ করছেন বিশেষজ্ঞরা।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘আপাতদৃষ্টিতে ডলার মার্কেটে ক্যাসিনোর প্রভাব পড়েছে বলে ধরা যায়। বিদেশ টাকা পাচার বেড়ে গেছে। ডলারের চাহিদা আগেও ছিল, কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে অনেক বেড়েছে।’

একই সঙ্গে তিনি বেলন, ‘আন্তঃব্যাংক লেনদেনে ডলারের স্প্রেড ১ থেকে দেড় টাকার বেশি হওয়া উচিত নয়। তাহলে হুন্ডি বাড়বে। প্রবাসীরা বেশি লাভে ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে রেমিট্যান্স পাঠাবে। এতে করে রেমিট্যান্সের গতি কমে যাবে।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের সেপ্টেম্বর মাসে রেমিট্যান্স এসেছে ১৪৬ কোটি ৮৪ লাখ মার্কিন ডলার, যা এর আগের মাসের চেয়ে ১ কোটি ৪৪ লাখ মার্কিন ডলার বা ১২২ কোটি টাকা কম। আগস্ট মাসে রেমিট্যান্স এসেছিল ১৪৮ কোটি ২৮ লাখ মার্কিন ডলার।

আহসান এইচ মনসুর আরও বলেন, ‘সাধারণত অবৈধ অর্থ দেশে থাকে না, সেটি বিদেশে চলে যায়। বর্তমানে যেহেতু অভিযান চলছে, তাই যারা অভিযানের তালিকায় নেই তারাও নগদ টাকা ডলার করে বিদেশে পাচারের চেষ্টা করবে। এতে করে টাকা পাচারের হার বাড়ার আশঙ্কা করা যায়।’

এখন সিঙ্গাপুরি ডলারের চাহিদা বেশি বলে জানান কার্ব মার্কেটের এক বিক্রেতা। প্রতিদিনই ১০-২০ পয়সা করে বাড়ছে এই মুদ্রা। গতকাল কার্ব মার্কেটে সিঙ্গাপুরি ডলার বিক্রি হয় ৬৩.৬০ থেকে ৬৩.৮০ টাকা। তিন দিন আগেও এর দাম ছিল ৬২ টাকা।

অগ্রণী ব্যাংকের ডলার-সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা জানান, ডলারের চাহিদা আগেও ছিল। বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণমূলক তৎপরতার কারণে ডলারের দাম ৮৪.৫০ টাকায় স্থির রয়েছে প্রায় ৬ মাস ধরে। কিন্তু গত এক সপ্তাহ ধরে এর চাহিদা কয়েক গুণ বেড়ে গেছে।

হঠাৎ করে নগদ ডলারের চাহিদা বাড়ার কারণে দাম বেড়েছে বলে জানান মানিচেঞ্জার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি মোস্তফা খান। ঢাকা টাইমসকে তিনি বলেন, ‘তবে চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ কম। দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযানের কারণে অনেকে নগদ ডলার কিনে থাকতে পারেন, আবার হুন্ডি বেড়ে যাওয়াও এর কারণ হতে পারে। আবার দেশের বাইরে থেকে যে নগদ ডলার আসে, তার সরবরাহ ব্যাপক কমে গেছে।’ এসব মিলিয়ে ডলারের দর বাড়তির দিকে বলে মনে করেন তিনি।

ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি মীর নাসির হোসেন মনে করেন এ ব্যাপারে সরকারের নজরদারি বাড়ানো উচিত। তিনি বলেন, ডলারের দাম বেড়ে গেলে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন আমদানিকারকরা। একই সঙ্গে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে মূল্যস্ফীতিতে। এটি মোকাবিলায় বাংলাদেশ ব্যাংককে আরও ডলার ছেড়ে ভারসাম্য আনতে হয়।