যারা ফেসবুক স্ট্যাটাস মানতে পারে না তারা দেশ চালাবে কিভাবে?

প্রকাশ | ০৮ অক্টোবর ২০১৯, ১০:৫৮

রাশেদা রওনক খান

খুব বিষণ্ণ লাগছে! ভাবতেই পারছিনা, মানতে তো নয়ই…. একজন শিক্ষার্থী কতোটা কষ্ট ও মেধার বিনিময়ে বুয়েটে পড়ার সুযোগ পায়…. একটি পরিবার কতোটা আহ্লাদিত হয়ে উঠে সন্তানের এই সাফল্যে। ‘আমার ছেলে/মেয়ে বুয়েটে পড়ে, এই কথা বলার মাঝে কি আনন্দ আছে, কি গর্ব আছে, কি ভালোবাসা আছে, তা কেবল সেই বাবা-মাই জানেন! আজ যেন সবাইকে স্তম্ভিত করে দিলো বুয়েট ছাত্র ফাহাদের মৃত্যু। পরিবারের কেউ বুয়েটে চান্স পাওয়া মানে সেই সদস্যের প্রতি পরিবারের সকলের ভালোবাসা অনেক গুণ বেড়ে যায়।

বুয়েটের একটা সুনাম ছিল সব সময়। এরকম একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে কলঙ্কিত করার কোন অধিকারই রাখেনা কোন ছাত্র, তা সে যে ছাত্র সংগঠনেরই হউক। আমাদের সময় কিংবা তারও আগে বুয়েট মানেই দেশের সেরাদের স্থান হতো! আজ দেখলাম, সেখানে খুনিদেরও স্থান হয়! ছাত্র রাজনীতি আসলে কি? ছাত্র রাজনীতির মঞ্চটা আসলে কোথায়? এই মঞ্চে কি কেবল বড় ভাই-বেরাদরদের সুতো দিয়ে বাধা পুতুল নাচের মতো নেচে যাওয়াই কাজ, নাকি ছাত্রদের নিজস্ব ব্যাক্তিত্বের, নিজস্ব মূল্যবোধের বহিঃপ্রকাশ ঘটানোরও দায়িত্ব রয়েছে?

রাজনীতি মানে এতোটা নির্মমতা, এতোটা বর্বরতা, এতোটা অসহিষ্ণুতা, এতোটাই সহিংসতা? তাও আবার এই উত্তরআধুনিক সময়ে এসে যে সময়ে আসলে পরিবারের সদস্যদের জন্যও আমরা সময় বরাদ্দ রাখতে হিমশিম খাচ্ছি? সেখানে কে কার বিরুদ্ধে কি নিয়ে কি বলল, লিখল তা নিয়ে আরেকজন সহপাঠীকে মেরে ফেলা? কি অস্থির উন্মাদনায় ভরপুর আজ আমাদের এই যুব সমাজ! সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আমাদের ভেতরে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা যেমন বাড়িয়ে তুলছে, তেমনি রাজনৈতিক মতবিরোধ এতোটা প্রকট করে তুলছে যে ছাত্রদের কেউ কেউ অন্ধ হয়ে যাচ্ছে? যারা অন্যের মত কে নিতে পারেনা, তারা আবার ছাত্র রাজনীতি করে কিভাবে? ছাত্র রাজনীতি হচ্ছে সকল দলের সহাবস্থানের জায়গা, সেখানে সকল দলের শিক্ষার্থীরা অংশগ্রহণ করবে, এটাই স্বাভাবিক।

জাতীয় রাজনীতির লেজুড়বৃত্তিই এই সংকট তৈরির মূল কারণ। বুয়েটের অনেকেই উন্নত দেশে পড়তে আসেন, তারা নিশ্চয়ই দেখেন এসব দেশে ছাত্র রাজনীতি মানে কি, ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে জাতীয় রাজনীতির পার্থক্য কোথায়, এসব এখন আমাদের ভাবতেই হবে। নয়তো সামনের দিন আরও অশুভ ও ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে।

ভাবতেই ভয় লাগছে, আমাদের অসহিষ্ণুতার পর্যায় কোথায় নেমে গেছে যে, একটা ফেসবুক স্ট্যাটাস এর জন্য মেরেই ফেলা হল! এসব ছেলেরা দেশ নিয়ে কি স্বপ্ন দেখে তবে, কি করবে তাদের জীবনে? যে ছেলেরা একটা ফেসবুক স্ট্যাটাসকে মেনে নিতে পারেনা, সেসব ছেলেরা দেশ পরিচালনা করবে কিভাবে? আমরা তবে কাদের পড়াই, কাদের নিয়ে স্বপ্ন দেখি, কাদের হাতে ভবিষ্যৎ?

তাহলে এই যে ক্যাসিনো ব্যবসা নিয়ে ধরা হয়েছে, তাদের সঙ্গে এদের তফাৎ কোথায়? নিশ্চয়ই ক্যাসিনো ব্যবসা নিয়ে আলোচনায় খুনিগুলো কত বড় বড় স্ট্যাটাস দিয়েছে বুয়েটের হলে বসে… আজ তাদের সাথে এদের তফাৎ কোথায়? বাবা মা কি ছেলেকে বুয়েটে পাঠিয়েছে খুনি হয়ে উঠবার জন্য? যদি আবরার ফাহাদ অন্য মতাদর্শের হয়েও থাকে, তাকে এভাবে পিটিয়ে মারার নির্দেশ কে দিয়েছে? এসব ছেলেরা বুয়েটে কি পড়ালেখা করতে ভর্তি হয়েছে, নাকি অন্য মতাদর্শের ছাত্রদের খুঁজে খুঁজে পেটানোর জন্য বাবা মা পাঠিয়েছে? যে যেই মতাদর্শ দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েই রাজনীতি করুক না কেন, সেই রাজনীতি কি দায়িত্ব দিয়েছে অন্য মতাদর্শের শিক্ষার্থীদের হত্যা করার? একজন বুয়েটের ছাত্র হিসেবে, একজন দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে কেউ কোন আদেশ দিলেই একজন মানবে কেন? একজন না হয় মারতে চেয়েছে, আরও যারা ছিল, তারা কেন বাধা দিলো না? তাহলে কি আমাদের ভেতরে ‘আমি’ বলে কিছু নেই, নিজের ব্যক্তিত্ব, নিজের দায়িত্ব, নিজের মূল্যবোধ, নিজের পারিবারিক আদর্শ কিছুই থাকেনা রাজনীতি করলে? রাজনীতির মাঠে এই ক্লাইন্টালিজম হতে যদি বুয়েটের ছেলেরা বের না হতে পারে, তাহলে অন্য সাধারণদের দোষ কোথায়?

একটি দেশের নাগরিক হিসেবে প্রত্যেকের অধিকার আছে তার মতামত ব্যক্ত করার, পছন্দ না হলে তর্ক -বিতর্ক হতে পারে, তাই বলে খুন করতে হবে? কেন? এই খুনের দায় কি এখন কোন বড় ভাই নেবে? বিচারের কাঠগড়ায় তো এখন কেউ সাথী হবেনা…রাজনীতি করার আগে তাই আমাদের আসলে রাজনীতি কি তা পড়তে ও জানতে হবে| বিদেশের ছাত্ররাজনীতি নিয়ে ভাবতে হবে সংশ্লিষ্ট সকলকে। আমি ছাত্র রাজনীতির পক্ষে কিন্তু যে রাজনীতি ছাত্রদের খুন করতে শেখায়, অবশ্যই তার বিপক্ষে। আমেরিকায় আমি যে বিশবিবিদ্যালয়ে পড়ি, সেই অভিজ্ঞতা হতে বলি, বাংলাদেশ ছাড়া সকল দেশেই ছাত্র রাজনীতি মানে অনেক তীক্ষ্ণবুদ্ধি সম্পন্ন, মানবিক, প্রচণ্ড পরিশ্রমী কিছু মেধাবী ছাত্রের রাজনৈতিক প্লাটফরম, যেখানে সকল দল মতের সম্মিলন ঘটে, তর্কবিতর্ক হয়, আবার একসাথে ডিনার করে| সবচেয়ে বড় কথা, একটি ছাত্রকল্যাণমুখী প্লাটফরম, যেখানে কেবল মাত্র শিক্ষার্থীদের সুযোগ সুবিধা, তাদের দাবি দাওয়া প্রসঙ্গে প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনার সুযোগ তৈরি হয়, এমনকি সাবেক ও বর্তমান রাষ্ট্র প্রধানদের সাথে সাধারণ ছাত্র ছাত্রীদের আলোচনার সুযোগ করে দেয় এই প্লাটফরম।

আমার পাঠকালীন সময়ে দেখেছি সাধারণ শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলতে হলরুমে এসেছিলেন সাবেক রাষ্ট্রপতি বিল ক্লিনটন, হিলারি ক্লিনটন, মিশেল ওবামা, কলিন পাওয়েল, কন্ডোলিসা রাইসসহ আরও অনেকেই। এই সব দেশে জাতীয় রাজনীতির লেজুড় বৃত্তি কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। সময় এসেছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রাজনীতির ধরন ধারণ পাল্টানোর। নয়তো এই ধরনের সহিংসতা অদূর ভবিষ্যতে আরও দেখতে থাকবো…..

লেখক: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়