বুয়েট ছাত্রাবাসে ভীতির রাজনীতি

প্রকাশ | ০৯ অক্টোবর ২০১৯, ০৮:২২ | আপডেট: ০৯ অক্টোবর ২০১৯, ০৯:৩৩

সৈয়দ ঋয়াদ

দেশের সবচেয়ে মেধাবীদের বিদ্যাপীঠ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সাধারণ শিক্ষার্থীরা সাংগঠনিক তথা ছাত্ররাজনীতি আর র‌্যাগিংয়ের কাছে জিম্মি। নানা সময়ে র‌্যাগিংয়ের নামে প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রদের ওপর চালানো হয় বর্বরোচিত অত্যাচার। আর সব সময় সাংগঠনিক রাজনীতির আতঙ্কে থাকে সব শিক্ষার্থী। আবরার হত্যায় এসব প্রবণতার দায় দেখছেন বুয়েটের শিক্ষার্থীরা।

আবরার হত্যার ঘটনায় বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদের প্রতিক্রিয়া ও ঢাকাটাইমসের সঙ্গে তাদের আলাপে উঠে আসে ক্যাম্পাস ও হলে সাংগঠনিক রাজনীতির ভয়াবহতার কথা।

ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাসের সূত্রে গত রবিবার দিবাগত রাতে তড়িৎ কৌশল (ইইই) বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যা করেন বুয়েট ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা। এ ঘটনায় স্তব্ধ-ক্ষুব্ধ সারা দেশ।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ বলছে এখানে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ। যুগের পর যুগ, বছরের পর বছর ওই অধ্যাদেশ উপেক্ষা করছে বুয়েট প্রশাসন ও ছাত্রসংগঠনগুলো। সরকারও এ নিয়ে কোনো গা করেনি।

গতকাল বুয়েটের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সাংগঠনিক তথা ছাত্ররাজনীতি পছন্দ নয় সাধারণ শিক্ষার্থীদের। কিন্তু জবরদস্তি করে তাদের রাজনীতিতে সংশ্লিষ্ট করেন এখানকার ছাত্রনেতারা।

ম্যাকানিক্যাল বিভাগের ১৭ ব্যাচের শিক্ষার্থী উমাইর আল কোনোমতেই এ ধরনের রাজনীতি মেনে নিতে রাজি নন। ঢাকা টাইমসকে তিনি বলেন, ‘পুরো বিশ্ববিদ্যালয়কে নামধারী কিছু ছাত্র জিম্মি করে রেখেছে। আমাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তারা জোর করে নানা জায়গায় নিয়ে যায়। কথা না শুনলে হল থেকে বের করে দেয়। আমরা এখানে পড়তে এসেছি না মিছিল-মিটিং করতে এসেছি, তা বুঝতে মাঝেমধ্যে কষ্ট হয়।’ উমাইর মনে করেন এখনই বিশ্ববিদ্যালয়ে হল দখলের রাজনীতি নিষিদ্ধ করা উচিত।

এই বুয়েটেই এর আগে ছাত্ররাজনীতির বলি হন সাবেকুন নাহার সনি ও আরিফ রায়হান দীপ।

আবরার হত্যাকাণ্ডের পর এখন প্রশ্ন উঠছে- অধ্যাদেশে নিষিদ্ধ করার পরও কীভাবে বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি বহাল আছে, কীভাবে ছাত্রসংগঠন বুয়েটে কমিটি গঠন ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে?

আবরার ফাহাদের হত্যাকাণ্ড তাই বুয়েটে কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয় বলে মনে করেন কম্পিউটার বিজ্ঞান (সিএসই) বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র জুনায়েদ করিম। আবরারের মৃত্যু বুয়েটের হলগুলোতে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা ছাত্ররাজনীতির নামে সাধারণ ছাত্রদের নিপীড়ন ও নির্যাতনের উদাহরণ।

জুনায়েদ করিম বলেন, ‘র‌্যাগিংয়ের নামে নেতাদের রুমে সাধারণ ছাত্রদের ডেকে নিয়ে কান ফাটিয়ে দেয়া, হাত ভেঙে দেওয়া হলগুলোতে নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থাকা নেতাদের এসব নিপীড়নের কথা কর্তৃপক্ষের কাছে বলতে পারে না কেউ।’ এই ভীতিকর অব্স্থা থেকে মুক্তির জন্য বুয়েট ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করার দাবি জানান জুনায়েদ।

আবরার হত্যাকাণ্ডে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা উত্তাল বুয়েট শান্ত করতে যে সাত দফা দাবি জানিয়েছেন, তাতে খুনিদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করা এবং ক্যাম্পাসে সাংগঠনিক রাজনীতি বন্ধের দাবি রয়েছে।

এই দাবি বুয়েটের সাধারণ শিক্ষার্থীরা সম্মিলিতভাবে নিয়েছেন বলে জানান শের-এ বাংলা হলের এক ছাত্র। সমিরের (ছদ্মনাম) মতে, ক্যাম্পাসে রাজনীতির কারণে অনেক  শিক্ষার্থীর জীবন নষ্ট হওয়ার নজির ভূরি ভূরি। ক্ষমতার লোভ, অর্থের লোভ, নিজেকে বড় নেতা প্রতিপন্ন করার লোভে কিছু শিক্ষার্থী বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনের লেজুড় হচ্ছে। আর তাদের নির্মমতার বলি হয় সাধারণ শিক্ষার্থীরা। তাদের সর্বশেষ শিকার আমাদের বন্ধু আবরার।’

সাংগঠনিক ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধসহ সাত দফা দাবির পূর্ণ বাস্তবায়ন, আবরার হত্যার বিচার বাস্তবায়ন না হলে বুয়েট অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ থাকবে বলে জানান এই শিক্ষার্থী।

ক্যাম্পাসে অপরাজনীতির কারণে বুয়েট থেকে বহু শিক্ষার্থী ঝরে যায় (ড্রপ আউট) এবং বহু ছাত্রকে হল ছাড়তে হয় বলে তথ্য মিলেছে শিক্ষার্থীদের বক্তব্যে। তারা জানান, এসবের খবর আসে না কোনো মাধ্যমে। কোণঠাসা সাধারণ শিক্ষার্থীরা নীরবে মুখ বুজে সয়ে যান এসব। আবরারকে ছাত্রলীগের নেতাদের নিপীড়ন থেকে বাঁচানোর সাহস তাই কারও মেলে না।’

আবরার হত্যায় ফুঁসে ওঠা বুয়েটে চলমান আন্দোলনে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন ঐশী। একবিংশ শতাব্দীতে এসে ক্যাম্পাসে হল দখলের রাজনীতির প্রয়োজনীয়তা দেখেন না তিনি।

ঐশী বলেন, ‘যুগের পর যুগ রাজনীতির নামে বুয়েটে জীবনের বিনিময়ে মূল্য দিয়েছে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। এর দায় কি প্রশাসন বা সরকার নেবে? তাহলে কেন ক্যাম্পাসে আধিপত্য বিস্তারের রাজনীতি?’

ক্যাম্পাস রাজনীতির কদর্যতার বর্ণনা দিতে গিয়ে ঐশী বলেন, ‘এরা প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীকে ভয় দেখিয়ে নিজের দলের কর্মী বানাতে চায়। না হলে তার ওপর চলে নানা হয়রানি। এমনই এক সাংগঠনিক শক্তির কাছে বলি হতে হলো পরিবারে অনেক স্বপ্ন নিয়ে বুয়েটে পড়তে আসা আবরারকে।’

আধিপত্য বিস্তারের যে রাজনীতি কায়েম হয়ে আসছে ক্যাম্পাসে, তার সমূলে উৎপাটন চান সাধারণ শিক্ষার্থীরা। তারা চান, আর কোনো নতুন আবরারের লাশ যেন বুয়েট ক্যাম্পাসকে রক্তাক্ত না করে।

(ঢাকাটাইমস/৯অক্টোবর/মোআ)