‘বাবার চোখে তাকালেই সমুদ্রের বিশালতা দেখা যায়’

প্রকাশ | ১০ অক্টোবর ২০১৯, ১১:০৯

সালমা রহমান

খাবার টেবিলে বসে মার দিকে তাকিয়ে চোখে ইশারা করলাম আমার কথাটা বাবাকে বলতে। মা ভয়ে ভয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে বললো ‘ইয়াহইয়া’ ১০ হাজার টাকা চেয়েছিল। ওর বন্ধুবান্ধবরা মিলে কয়েকদিনের জন্য কক্সবাজার যাবে সেজন্য...।

বাবা আমার দিকে তাকিয়ে বলল

কবে যাবি?

আমি বললাম, এই তো পাঁচ দিন পর যাব

বাবা নিচের দিকে তাকিয়ে খেতে খেতে বলল- তাহলে এক কাজ কর তিন দিন দোকানে একটু সময় দে। আমি তিন দিনের জন্য এক জায়গায় যাব। এসে তোকে টাকাটা দেই।

আমি খুশিতে হাসতে হাসতে বললাম ঠিক আছে বাবা।

পরদিন সকালে দোকানে গেলাম। আমাদের ছোটখাটো একটা কাপড়ের দোকান আছে। মাঝে মাঝে আমি দোকানে আসলেও কখনো দোকানে বসা হয়নি। আজকেই প্রথম দোকানে বসলাম। দোকানে দুইটা কর্মচারী আছে ওরা সব আমায় বুঝিয়ে দিচ্ছে। আমার কাজ হলো কোন কাপড়ে কত টাকা লাভ হয়েছে সেটা লিখে রাখা আর মাঝে মাঝে কাস্টমারদের কাপড় দেখানো।

একটা কাস্টমারকে ২০টার মত শার্ট দেখানোর পর কাস্টমারটা বলল, না ভাই পছন্দ হয়নি।

আমি অবাক হয়ে বললাম, এতগুলোর মাঝেও পছন্দ হয়নি?

উনি বললেন, না

মুখটা গোমড়া করে যখন শার্টগুলো যখন ঠিক করছিলাম তখন কর্মচারী ছেলেটা হেসে বলল- ভাইয়া, মুখ গোমড়া করে থাকলে হবে না। সব সময় মিষ্টি হেসে কাস্টমারের সাথে কথা বলতে হবে।

কিছুক্ষণ পর একটা ছেলে এসে বলল, কিছু নতুন ডিজাইনের প্যান্ট দেখাতে। আমি দোকানের কিছু ভালো মডেলের প্যান্ট দেখালাম। একটা প্যান্ট পছন্দ করল। প্যান্টের কিনা মূল্য ছিল ১২০০ টাকা। আমি ছেলেটার কাছে চাইলাম ১৫০০ টাকা। ছেলেটা প্যান্টটা উল্টেপাল্টে আবার দেখে বলল, ৩০০ টাকা দেবেন?

কথাটা শুনে মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল। দাঁতের সাথে দাঁত চেপে নিজের রাগটা কন্ট্রোল করে মুখে মিষ্টি হাসি এনে বললাম না ভাইয়া, এত কম দামে হবে না।

কিছুক্ষণ পর এক মহিলা এসে এক ঘণ্টা ধরে দোকানের সমস্ত কাপড়চোপড় উল্টে পাল্টে দেখে দুটা কাপড় পছন্দ করে বলল, আমার স্বামী তিন দিন পর বেতন পাবে তখন এই দুইটা কাপড় নিব।

রাগে সারটা শরীর কাঁপছিল। তারপরও কিছু বলতে পারছিলাম না। কারণ কাস্টমার বলে কথা। নিজের রাগ বুকের ভেতর জমাট রেখে মুচকি হেসে বললাম, আন্টি যেদিন আংকেল বেতন পাবে সেদিন আংকেলকে নিয়ে না হয় আসবেন।

এক ছেলে মনে হয় তার গার্লফ্রেন্ডকে সাথে নিয়ে দোকানে এসেছে। কর্মচারী ছেলেগুলো যে কাপড়গুলোই দেখায় সেগুলো দেখেই বলে আরও ভালোমানের কাপড় দেখাতে। অবশেষে কর্মচারী ছেলেটা বলল, এর চেয়ে ভালোমানের কাপড় আমাদের দোকানে নেই।

ছেলেটা মুখে বিরক্তির ভাব এনে বলল, দূর যা। শুধু শুধু এমন একটা ফকিন্নি দোকানে সময় নষ্ট করলাম।

না আর সহ্য করা যায় না। ছেলেটাকে বললাম, ভাই আপনি বড়লোকের পোলা তাহলে বসুন্ধরা শপিং মল, যমুনা ফিউচার পার্ক এইগুলো বাদ দিয়ে শুধু শুধু কেন এইসব সাধারণ শপিংমলে ঘোরাঘুরি করছেন?

আমাদের যখন কথা কাটাকাটি হচ্ছিলো তখন কর্মচারী ছেলেটা ওই ছেলেও কাছে মাফ চেয়ে আমাকে বলল, ভাইয়া এমন করলে তো ব্যবসা হবে না। প্রতিদিন কত মানুষের কত রকম কথা শুনতে হবে। আপনি আজ প্রথম এসেছেন তাই কিছু জানেন না।

দিন শেষে হিসাব করে দেখি সব খরচ বাদ দিয়ে লাভ হয়েছে ৮২০ টাকা।

আমি তিন দিন দোকান দেখাশুনা করি। এই তিন দিনে আয় হয় ৪০২০ টাকা। আর এই তিন দিনে যে পরিমাণ কষ্ট হয়েছে মনে হয় না আমি আমার জীবনে এত কষ্ট করেছি।

রাতে নিজের রুমে বসে যখন ফোন টিপছি তখন বাবা এসে বলল, এই নে তোর ১০ হাজার টাকা।

আমি বাবার দিকে তাকিয়ে বললাম, কিসের ১০ হাজার টাকা?

বাবা অবাক হয়ে বলল, তুই না কক্সবাজার যাবি বন্ধুদের সাথে?

আমি বাবার চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম, বাবা আমি আগে বুঝতাম না টাকা ইনকাম করতে কতটা কষ্ট হয় তাই তোমার কাছে এতকিছু আবদার করতাম। আমি এই তিন দিনে খুব ভালো করেই বুঝতে পেরেছি টাকা ইনকাম করার কষ্টটা। যে আমি তিন দিনে পাঁচ হাজার টাকায় ইনকাম করতে পারলাম না সেই আমি কিনা দুই দিনের জন্য ১০ হাজার টাকা কিভাবে আবদার করি। এত টাকা খরচ করা আমাদের মত নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্য অপচয় বাদে কিছুই না।

আমার কথা শুনে বাবা কিছুটা রেগে গিয়ে বলল, তোকে এত পণ্ডিতগিরি করতে হবে না। বন্ধুরা সবাই যাচ্ছে তুইও যা। সমুদ্রের বিশালতা দেখলে তোর খুব ভালো লাগবে।

আমি বাবার হাত ধরে বললাম, বিশালতা দেখতে সমুদ্রে যেতে হয় না। বাবার চোখের দিকে তাকালেই বিশালতা দেখা যায়। যে বাবারা হাজার কষ্টের পরেও সন্তানের মুখে হাসি ফোটায়। খাবার টেবিলে বসে যখন খাচ্ছি তখন বাবাকে বললাম, বাবা, দোকানে দুইজন কর্মচারী রাখার কোনো দরকার নেই। আজ থেকে আমি দোকানে বসব।

বাবা আমার কথার কোনো উত্তর দিলো না। শুধু মাকে বলল, তারকারিতে এত ঝাল দিয়েছ কেন? ঝালে চোখেমুখে পানি চলে এসেছে।

আমি জানি তারকারিতে ঝাল হয়নি। বাবা চোখের পানি লুকানোর জন্য মিথ্যা কথা বলছে।

# সংগৃহীত পোস্টটি সাইমন কালেকশনের স্বত্তাধিকারি সালমা রহমানের ফেসবুক থেকে নেওয়া।