ওমর ফারুক আউট!

প্রকাশ | ১১ অক্টোবর ২০১৯, ১৭:৪২ | আপডেট: ১১ অক্টোবর ২০১৯, ২৩:০৯

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকাটাইমস

প্রেসিডিয়াম বৈঠকে যুবলীগের চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরীর অনুপস্থিতির ঘটনায় সংগঠনে তার অবস্থান নিয়ে গুঞ্জন শুরু হয়েছে। অনেকে বলছেন, যুবলীগের রাজনীতি থেকে ছিটকে পড়েছেন গত সাত বছর ধরে চেয়ারম্যান পদে থাকা ওমর ফারুক। আগামী ২৩ নভেম্বর অনুষ্ঠেয় সম্মেলনে সভাপতিত্ব করতে পারেন ভারপ্রাপ্ত কেউ। 

গত ২০ সেপ্টেম্বর উত্তরায় স্থানীয় ওয়ার্ড যুবলীগের কাউন্সিলে সর্বশেষ অংশ নিয়েছিলেন ৭১ বছর বয়সী ওমর ফারুক চৌধুরী। তার ব্যাংক হিসাব তলব ও বিদেশ যাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়ার পর থেকে তিনি সবকিছু এড়িয়ে চলছেন। এমনকি যান না ধানমন্ডিতে নিজের প্রতিষ্ঠিত যুব জাগরণ কেন্দ্রেও। সংগঠনের নেতাকর্মীরা তার দেখা পাচ্ছেন না। তাকে মুঠোফোনেও পাচ্ছেন না তারা। বিশেষ করে তার ব্যাংক হিসাব তলব ও বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা আসার পর ওমর ফারুক চৌধুরী প্রকাশ্যে আসছেন না তেমন একটা।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসনাও ওমর ফারুক চৌধুরী ও তার নেতাদের উপেক্ষা করছেন বলে জানান একজন নেতা। আওয়ামী লীগের রেওয়াজ অনুযায়ী দলীয় সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কোনো দেশে সফরে যাওয়ার উদ্দেশে গণভবন থেকে বের হওয়ার সময় দলের কেন্দ্রীয় নেতা, সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের নেতাকর্মীরা তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বিদায় জানান। বিদেশ থেকে ফেরার সময়ও গণভবনে নেতারা উপস্থিত থেকে তাকে স্বাগত জানান। এ সময় প্রধানমন্ত্রী তাদের সঙ্গে কুশলা বিনিময় করেন। 

গত ৭ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী ভারত সফর থেকে ফেরার দিনে গণভবনে উপস্থিত ছিলেন ওমর ফারুক চৌধুরী। কিন্তু  যুবলীগের নেতারা যে পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন, প্রধানমন্ত্রী সেদিকে তাকাননি বলে জানান সেখানে উপস্থিত একাধিক নেতা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে আওয়ামী লীগের এক নেতা ঢাকা টাইমসকে বলেন, পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে যুবলীগের আসন্ন সম্মেলনেও উপস্থিত থাকতে পারবেন না ওমর ফারুক চৌধুরী। ভারপ্রাপ্ত কেউ হয়তো সম্মেলনের সভাপতিত্ব করবেন। 

এদিকে এই আশঙ্কা মাথায় রেখে আজ শুক্রবার যুবলীগের প্রেসিডিয়াম বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, চেয়ারম্যান ওমর ফারুক কাউন্সিলে অনুপস্থিত থাকলে কে সভাপত্বি করবেন তা জানতে দলের সভাপতির কাছে যাবেন প্রেসিডিয়ামের  নেতারা।

বৈঠকে যুবলীগ চেয়ারম্যান কেন উপস্থিত ছিলেন না এই বিষয়ে কোনো কথা বলেননি যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক হারুনুর রশীদ। কয়েকজন সাংবাদিক তাকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি কোনো মন্তব্য করেননি। বলেন, ‘নামাজের (জুমা) সময় হয়ে গেছে, আমাকে মসজিদে যেতে হবে।’ 
চেয়ারম্যানের অনুপস্থিতি সম্পর্কে যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য শহীদ সেরনিয়াবাত সাংবাদিকদের জানান, ব্যস্ততার কারণে বৈঠকে আসতে পারেননি চেয়ারম্যান। 

তবে ভিন্ন কথা বলছেন সংগঠনটির আরেক প্রেসিডিয়াম সদস্য শেখ আতিয়ার রহমান দিপু। তার ভাষ্য, ‘চেয়ারম্যান কেন আসেননি সে বিষয়টি আমার জানা নেই। হয়তো অসুস্থতার কারণে তিনি আসেননি।’ 

পরে যুবলীগের কয়েকজন প্রেসিডিয়াম সদস্য জানান, চেয়ারম্যান নিজেই বৈঠক ডেকেছিলেন, কিন্তু তিনি কী কারণে উপস্থিত থাকতে পারেননি এই বিষয়ে বলতে পারবেন না তারা।
২৩ নভেম্বর অনুষ্ঠেয় সম্মেলনে সভাপতিত্ব কে করবেন জানতে চাইলে অধ্যাপক এ বি এম আমজাদ হোসেন বলেন, ‘এর দায়দায়িত্ব সম্পূর্ণ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। উনি যেভাবে বলবেন সেভাবেই হবে। আজকে সাধারণ সম্পাদক সভাপতিত্ব করেছেন। চেয়ারম্যানের মতো একটি বড় পোস্টের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী যে সিদ্ধান্ত দেবেন আমরা তা-ই করব।’

সম্প্রতি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে ক্রীড়া ক্লাবগুলোতে অবৈধ ক্যাসিনো পরিচালনায় যুবলীগের বেশ কয়েকজন নেতার সম্পৃক্ততার বিষয় উঠে আসে। আর এইসব ঘটনার প্রেক্ষিতে তোপের মুখে পড়েন আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন যুবলীগের চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরী।

গত ১৮ সেপ্টেম্বর ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানে ঢাকা দক্ষিণ যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ গ্রেপ্তারের পর ওমর ফারুক চৌধুরী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে কড়া প্রতিক্রিয়া দেখান। তারা এত দিন ‘আঙুল চুষছিল’ কি না প্রশ্ন তোলেন। এমনকি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিচারও দাবি করেন তিনি। তবে এক দিনের মধ্যেই তার সুর নরম হয়ে যায়। তিনি চলমান অভিযানকে স্বাগত জানান। 

এরপর যুবলীগের আরও কয়েকজন আটক হওয়ার পর তার ব্যাংক হিসাব তলব করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এরপর  তার বিদেশে সফরে এসেছে নিষেধাজ্ঞা। এরপরই আড়ালে চলে যান যুবলীগের দোর্দণ্ড প্রতাপশালী চেয়ারম্যান। 

গত বুধবার সকালে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে যুবলীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে প্রেসিডিয়ামের বৈঠকের ঢাকেছিল সংগঠনটি। কিন্তু হঠাঃ বাতিল করা হয় বৈঠক। কী কারণে বৈঠক বাতিল করা হয়েছিল তা নিশ্চিত করেনি সংগঠনটি। 

ওই দিনই আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে দলটির চার সংগঠনের সম্মেলনের তারিখ ঘোষণা করা হয়। যুবলীগের সম্মেলনের তারিখ পড়ে আগামী ২৩ নভেম্বর। 

সম্মেলনের তারিখ ঘোষণার দুই দিন পর আজ সংগঠনের চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরীকে ছাড়াই সংঠনটির কার্যালয়ে জরুরি প্রেসিডিয়াম বৈঠক হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক হারুনুর রশিদ। আর এই বৈঠকে যুবলীগের দফতর সম্পাদক পদ থেকে কাজী আনিসুর রহমান আনিসকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নেয় সংগঠনটি।
মাসখানেক আগে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা দলের এক বৈঠকে সহযোগী সংগঠন যুবলীগের নেতাদের নানা কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করেন। এরপর যুবলীগ নেতাদের ৬০টি জুয়ার আখড়া বা ক্যাসিনো চালানোর খবর আসে কয়েকটি গণমাধ্যমে। পরে এসব স্থানে অভিযানে নামে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। গ্রেপ্তার করা হয় যুবলীগের বেশ কয়েকজন নেতাকে। তাদের মধ্যে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি ইসমাইল হোসেন সম্রাটও আছেন।

অভিযানের মধ্যেই যুবলীগের চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরীর সব ধরনের ব্যাংক হিসাব ও লেনদেনের বিবরণী তলব করে বাংলাদেশ ব্যাংক। পরে তার দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়।

ক্যাসিনো অভিযানের প্রথমেই যুবলীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদকে গ্রেফতার করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। খালেদকে গ্রেপ্তারের ঘটনায় সেদিন রাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করেন যুবলীগের চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরী। তিনি সেদিন বলেছেন, ‘৬০টি ক্যাসিনো আছে; আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আপনারা কি এতদিন আঙুল চুষছিলেন? যে ৬০ জায়গায় এই ক্যাসিনো, সেই ৬০ জায়গার থানাকে অ্যারেস্ট করা হোক। সেই ৬০ থানার যে র‌্যাব ছিল, তাদের অ্যারেস্ট করা হোক।’

খালেদকে গ্রেফতারের দুই দিন পর তাকে যুবলীগ থেকে বহিস্কার করা হয়। আর ওই দিন গত ২০ সেপ্টেম্বর উত্তরায় সংগঠনের একটি ওয়ার্ড কমিটির সম্মেলনে বেশ বড় গলায় কথা বলেন যুবলীগ চেয়ারম্যান ওমর ফারুক। তিনি বলেছেন, যাকে গ্রেপ্তার করা হবে তাকেই সংগঠন থেকে বহিস্কার করা হবে।

এর পরদিন গত ২১ সেপ্টেম্বর রাজধানীর নিকেতনের নিজ কার্যালয় থেকে আরেক যুবলীগ নেতা জি কে শামীমকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। শামীম গ্রেপ্তার হওয়ার পর যুবলীগ সভাপতি ওমর ফারুক চৌধুরী দাবি করেছেন, জিকে শামীম যুবলীগের কেউ নন। সে যুবলীগের নাম ভাঙিয়েছে। 

এরপর যুবলীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাটকে গ্রেপ্তারের পর ওমর ফারুকের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। এর পরদিন একটি বেসরকারি টেলিভিশনকে দেওয়া সংক্ষিপ্ত টেলিসাক্ষাৎকারে যুবলীগ চেয়ারম্যান জানান, দেশ ছেড়ে পালাবেন না তিনি। এর তিন দিন পর গত ৩ অক্টোবর ওমর ফারুকের ব্যাংক হিসাব তলব করা হয়। 

(ঢাকাটাইমস/১১অক্টোবর/এনআই/জেবি/মোআ)