হরিহরের গোপন ভয়

অরুণ কুমার বিশ্বাস
 | প্রকাশিত : ১৩ অক্টোবর ২০১৯, ১৩:১৪

ছাপোষা মানুষ হরিহর। প্রায় যুগ পেরোল তিনি এই শহরে আছেন, অথচ এখনো শহুরে হয়ে উঠতে পারেননি। কেন পারেননি! কারণ তিনি কেতাদুরস্ত নন, তিনি ভীতু, গুছিয়ে মিছে বলতে পারেন না, অপমান হজম করতে অপারগ এবং তার পকেটে অঢেল পয়সা নেই। এই জামানায় টাকা না থাকলে তার কেমন অবস্থা হয় তা সকলের জানা। এই নিয়ে মেলা বকাবকির কোনো মানে নেই।

হরিহরের ভয় মূলত মানুষকে। তিনি গ্রাম থেকে উঠে আসা সাফদিলের একজন মানুষ। শহরে এসে দেখেন যে, এখানে কাউকে বিশ্বাস করাটাই বিপজ্জনক। তিনি পারতপক্ষে বাজার থেকে কিছু কেনেন না। প্রশ্ন উঠতে পারে, তাহলে তিনি কী খান। কেন, তিনি রেশন খান। আর কেনেন স্রেফে গিফেন গুডস। সোজা বাংলায় যাকে বলে ‘অচল মাল’। এই জিনিসে কেউ ভেজাল দেয় না, কারণ এর কাটতি কম।

হরিহর বস্তুত কম খান। এর মানে এই নয় যে, হরিহরের পাকস্থলী ছোটো বা হজমে প্রবলেম। তিনি না খেয়ে পারলে সবচে বেশি খুশি হতেন। তাহলে আর গুচ্ছের পচাবাসি ভেজাল জিনিস তাকে গিলতে হত না। কী খাবেন হরিহর? বিস্কুট! তাতে পচা ডিম, মজা ময়দা, তেলাপোকা টিকটিকির ডিম মেশানো ময়ান। ফুটপাতে দাঁড়িয়ে একটু ফুচকা খাবেন? আদতে তার জো নেই। পোকাপড়া ময়দায় পা দিয়ে মাড়িয়ে তবে ফুচকা বানানো নয়, ভাজা হয় পোড়া তেলে। খেলেই অম্বল, নয়তো দুদিনেই কিডনির দফা রফা।

হরিহরের ছোট্ট চাকরিজীবনে দু’দুবার পদোন্নতির সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল, কিন্তু তিনি তা নেননি। কী করে নেবেন! এ সংক্রান্ত কাগজপত্র যে তৈরি করে, শুরুতেই সে পানবিড়ির খরচা বাবদ কুড়ি হাজার চেয়েছিল। উপরঅলার কথা না হয় তোলা থাক। হাত গুটিয়ে বসে রইলেন হরিহর, তাই পদোন্নতিও তার হয়নি। সত্যি বলতে, উপরি ছাড়া এই দুর্দিনে কিছুই হয় না। বউয়ের ভালোবাসাও নয়।

হরিহর বোকাসোকা মামুলি মানুষ, ক্ষমতা কম। তার বন্ধুভাগ্য একেবারেই ভাল নয়। ইয়ারদোস্ত জোটাতে গেলে মেলা খরচা করতে হয়। শুধু মুখে কে কার কথা শোনে বলুন। তাও একজন ছিল বটে। রফিকুল। ছোটোখাটো একটা খাবারের দোকান ছিল তার। তো হল কি, হরিহর একদিন দেখে কুল কুল করে ঘামছে তার বন্ধু রফিকুল। কারণ কী? বলল, একজন তাকে মেলা টাকার লোভ দেখিয়েছে। কিন্তু তার হোটেলে মাল বেচতে হবে। মাল মানে মদ। বদের হাড্ডি লোকজন এসে খাবে। রাত্তির দুটো তিনটে অব্দি দোকান খোলা রাখতে হবে। তবেই মেলা মুনাফা। এ টাকা যে, সে গুনে শেষ করতে পারবে না।

টাকার লোভে রফিক তাই করলো। কড়কড়ে টাকা এলো হাতে। হরিহরের সঙ্গে তার সম্পর্ক ঘুচলো। ওরা তখন দুগ্রহের মানুষ। ক্লাসে মেলে না। রফিক একসময় মালের কারবার ছেড়ে ক্যাসিনো ধরলো। দেদার টাকা এলো হাতে। টাকার গরমে সে ধরাকে সরাজ্ঞান করলো। তারপর? লক্ষ্মী বিচঞ্চলা। টাকাকড়ি একখানে বেশিক্ষণ থকে না। জুয়াড়ি রফিক একসময় হারতে শুরু করে। যা কামিয়েছিল সব গেল। শেষমেশ বউ বন্ধক রেখে রফিক জান বাঁচালো। এখন সে পথের ফকির। হরিহর তাই মানুষের উপার আর আস্থা রাখতে পারে না। মানুষ বেইমান, ইতর ও লোভী।

ছোটোখাটো দেখতে হরিহরের একজন লেখকের সঙ্গে বিশেষ সম্বন্ধ ছিল। খুব নাকি ভালো লেখেন। হরিহরের বিশেষ পড়া হয় না, কারণ তার চোখের দ্যুতি অল্প। ডাক্তার চোখের উপর জোর ঢালতে নিষেধ করেছেন। সে যাক, লেখক দেশকে খুব ভালোবাসেন। তার লেখায় একাত্তরের গৌরবগাথা উপচেপড়ে। মানুষ, মানবতা এসব নিয়ে তার মেলা উচ্ছ্বাস। হরিহর সেদিন পত্রিকা মারফত জানতে পারলো সব নাকি ভুয়া। তিনি মোটেও ভালো লেখক নন। পুরোটাই কাটপিস। দেশকেও তিনি ভালোবাসেন না। মেয়েকে বিদেশ পাঠিয়ে দেশের টাকা সেই মাধ্যমে পাচার করছেন। তিনি লেখক নামের কলঙ্ক। তিনি একজন সুবিধাবাদী। হরিহর তাই এখন লেখক দেখলে এড়িয়ে চলেন। এদের রীতিমতো ভয় পান।

হরিহরের একটা মাত্র বউ। তার আবার গ্যাসের সমস্যা। ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলেন। চেম্বারে কী ভিড়! তিল ধারণের ঠাঁই নেই। ডাক্তারসাব রাত একটাঅব্দি শখানেক রোগী দেখেন। নাড়ি টেপার তার সময় নাই, তিনি শুধু পলকমাত্র রোগীর দিকে তাকান আর খসখস করে কী যেন লেখেন। তাতে না সারে রোগ, না যায় ব্যথা। হরিহরের শুধু কিছু অর্থক্ষয় হয়, ডাক্তারবাবুর মেলা কামাই। তিনি বিশ্বের নানান দেশে প্রমোদতরী কিনছেন, বুড়ো বয়সে ঘুরবেন বলে। হরিহর তাকেও ভয় পান। কত বড় ডাক্তার! তার কত টাকা! অথচ সঠিক চিকিৎসা দেবার সময়টুকুও তার নেই। ভুল করে হরিহরের বউকে তিনি মেরেও ফেলতে পারেন!

স্বপ্ন ছিল ইঞ্জিনিয়ার হবেন হরিহর। ভাগ্যিস হননি। ভালো করেছেন। সেদিন তার গ্রামে একটা দুর্ঘটনা হল। রোড অ্যাকসিডেন্ট। দুজন স্পট ডেড, তিনজনের ঠ্যাঙ আর একজনের কোমর ভেঙেছে। কেউ বলে, আল্লাহর মাল আল্লায় নিছে। কিন্তু হরিহর খোঁজ নিয়ে জানলেন, রাস্তার অবস্থা খুব খারাপ ছিল। এ বাবদ বরাদ্দের বেশির ভাগ টাকা প্রকৌশলী আর ঠিকাদার মিলে কৌশলে হাতিয়েছে। দাদাদেরও কিছু দিতে হয়েছে। তাতের রাস্তার কাজ মোটে হয়নি। দুদিন যেতে না যেতেই রাস্তায় বড় বড় গর্ত যেন নরকঙ্কাল। ফলে অঘটন ঘটলো। হরিহর তাই আর মানুষকে বিশ্বাস করেন না। বিদ্বান সব লোকেরা এখন আমজনতার প্রাণ নিয়ে খেলছে। যে যেভাবে পারছে লুটছে। এরচে বরং বাঘ-ভালুক ভালো। ওরা খিদে না পেলে খায় না। অকারণ কারো ক্ষতি করে না।

হরিহর খুব একটা পত্রিকা পড়ে না। খবর পড়লে তার প্রেশার বাড়ে, ভয়ে আতঙ্কে প্রাণবায়ু বেরিয়ে যাবার জোগাড়। সেদিন কে যেন বলল, রক্ষক এখন ভক্ষকের ভূমিকায়। স্বামীর বিরুদ্ধে নির্যাতনের বিচার চাইতে গিয়ে সম্ভ্রম হারালো বেচারি স্ত্রী। শুনে অব্দি হরিহরের হার্ট বর্ষার কইমাছের মতোন সমানে লাফাচ্ছে। এও কি হতে পারে! উর্দির অপমান! চরিত্রের সনদ যে দিচ্ছে, ইতোমধ্যেই সে ধর্ষণ মামলায় জেল খেটে এসেছে। মানুষ আর মানুষ নাই। মানুষকে বড্ড ভয় পান হরিহর।

প্রতিবেশী লোকটা সেদিন প্রায় কেঁদেই ফেললেন। তিনি ব্যাংকে গেছেন জমানো টাকা তুলবেন বলে। আসছে হপ্তায় তার মেয়ের বিয়ে। কিন্তু ক্যাশের ছোকরা বলল, পরে আসুন। টাকা নেই। নেই মানে। আমার টাকা গেল কই! তেতে ওঠেন ভদ্রলোক। তাতে দাঁত কেলায় ক্যাশিয়ার। বলে, মায়ের ভোগে গেছে বলতে পারেন। ঠিক তার দুদিনের মাথায় পত্রিকার শিরোনাম, অমুক ব্যাংক দেউলিয়া ঘোষিত হয়েছে। তমুক ব্যাংকে তারল্য সংকট ইত্যাদি। রাগে দুখে সুইসাইড এ্যাটেম্পট করেন হরিহরের প্রতিবেশী। ভয়ে কেঁপে ওঠেন হরিহর। ভেবে পান না, এ কোন দেশে আছেন তিনি!

গল্পের পেছনেও গল্প থাকে। ভদ্রলোকের মেয়েটার ভালো চাকরি, উচ্চশিক্ষিত, দেখতেও কিছু অসুন্দর নয়। অথচ বরপক্ষ যৌতুক চেয়েছে। আচ্ছা আপনারাই বলুন, হাত বাড়িয়ে যৌতুক নেয়া আর ভিক্ষার মাঝে তফাৎ কী! এমন শিক্ষিত ছেলে দিয়ে আমরা কী করিব! এরা তো কোরবানির গরু।

হরিহরের সবশেষ ভয়ের কারণ আরও মারাত্মক। তার শালার ছেলেটা খুব মেধাবী। প্রচুর জ্ঞান গরিমা তার। খুব ইচ্ছে তাকে ইঞ্জিনিয়ার বানাবেন। হরিহর বুদ্ধি দিলেন বুয়েটে ভর্তি হতে। চান্স পেলে ওখানেই যেন ভর্তি হয়। দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ। বেশ কথা। ছেলে ভর্তিপরীক্ষার জন্য খুব কষ্টক্লেশ করে পড়ছে। হঠাৎ টিভি খুলে হরিহর দেখলেন, সেই বুয়েটেরই কিছু দানবের মারের চোটে একটা ছেলের প্রাণ গেছে। টানা ছয়ঘণ্টা তাকে পেটানো হয়েছে। ফলে স্পটডেড। যারা মেরেছে তারা সবাই মেধাবী, জাতির বিজয়মুকুট। তাদের পাশ দিয়ে হাঁটলে জ্ঞানের গন্ধ (দুর্গন্ধ!) পাওয়া যায়। অথচ তারা খুনি। তারা নির্মম।

ভয়ে শিউরে ওঠেন হরিহর। ভাবতে পারেন না, মানুষ কী করে এমন নৃশংস হয়! ওরা যে গোখরোর চেয়েও বিষাক্ত। এমন মেধা দিয়ে জাতির কী হবে। কাঁপা কাঁপা হাতে আত্মীয়কে ফোন করেন হরিহর, ভুলেও তুমি ওকাজ করো না ভায়া। বুয়েট বাদ দাও, ওটা এখন টর্চারসেল, খুনির আখরা। ওদের মেধা হয়তো আছে, কিন্তু ওরা এখনো মনুষ্যত্ব শেখেনি। ছেলেকে আগে মানবিকতা শেখাও। মেধা অনেক পাবে, কিন্তু মানুষ যদি মননশীল না হয় তাহলে তা কারো কল্যাণে আসে না।

হরিহর ভাবেন, ভাবতেই থাকেন। কবে আমাদের এ-দেশ বাসযোগ্য হবে! আমরা কবে স্বস্তিমতো একটু নিঃশ্বাস নিতে পারবো। কবে?

লেখক: গল্পকার

সংবাদটি শেয়ার করুন

ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :