‘নিজের মাটিতে দাঁড়ালে কোনো ভয়কে ভয় মনে হয় না’

অঞ্জন রায়
| আপডেট : ১৬ অক্টোবর ২০১৯, ০৯:৫৫ | প্রকাশিত : ১৬ অক্টোবর ২০১৯, ০৯:৪৭

আমার জন্ম গত শতকে। গত শতাব্দী ছিলো মানুষের মুক্তির শতাব্দী। সেই শতকেই পৃথিবীর ইতিহাস পাল্টে দিয়েছেন অনেক মহামানব। বঙ্গবন্ধু, লেনিন, চেয়ারম্যান মাও, আংকেল হো, চে গোয়েভারা ছিলেন আমার জন্মের শতকের মহানায়ক। এই শতকেই গান গেয়েছেন পল রোবসন, পিট সিগার, জোন বায়েজ, বব ডিলান, কবীর সুমন। রবিশংকর বাজিয়েছেন রাসিয়া রাগ। আমজাদ আলী খান সুচিত্রা মিত্র খেলা করেছেন সুর নিয়ে। নতুন বৌঠানকে নিয়ে গত শতকেই ভানু কবি লিখেছেন-গান, পদ্য। কাবেরী নদীর জলে বালিকাকে খুঁজেছেন নজরুল। রামকিংকর, পূর্ণদাশের শতক। পাবলো পিকাসোর গোয়ার্নকার শতক। চার্লস চ্যাপলিনের গ্রেট ডিক্টেটারের শতক। পল সয়মন, ঋত্বিক ঘটক, জিমি হেনড্রিকের শতক।

চারু মজুমদার, আজিজুল হকের শতক। রুশ বিপ্লব, ভাষা আন্দোলনের শতক। শিবরাম চক্রবর্তী, বিনয় মজুমদারের শতক। ক্ষুদিরাম বসু, তাহের, লোরকা, বেন্জামিন মালোয়েস, ভিক্তর জারা হাসতে হাসতে মরেছেন গত শতকেই। আমার শতকেই ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরুদ্ধে মানুষ রুখে দাড়িয়েছে। সাব্রা শাতিলার স্বজনের জন্য আমরা স্লোগান দিয়েছি। বার্লিন দেয়াল গড়েছে- ভেঙেছে। হিপি আন্দোলন, বন্দুকের নলে ফুল গুঁজে প্রতিবাদের শতক। গ্লাসনস্ত আর পেরস্ত্রাইকার ঝড়ে রঙ বদল করা গিরগিটিদের চেনার শতক।

আমার সৌভাগ্য আমি যে শতকে জন্মেছি- সেই শতকেই জন্ম নিয়েছে আমার স্বদেশ। আমরা পারিবারিকভাবেই সেই জন্মের দাম দিয়েছি। মুক্তিযুদ্ধে খুন হয়েছেন জেঠু, বাবাকে শৈশব কৈশরে দেখেছি জেলখানার শিক আর নেটের ওপারে দিয়ে। ৭৫ পরবর্তীকালে মাকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে- দু ভাইবোন বড় হয়েছি একটা ডিম সুতো দিয়ে কাটা দুটো টুকরো খেয়ে। শৈশব কৈশরজুড়ে দেখেছি আমার মায়ের বেঁচে থাকার লড়াই।

পাকিস্তান আমলে বাবা যখন জেলখানায় তখন আমাদের বড় দাদা গৌতম মারা গিয়েছিলো শিশু কলেরাতে। মায়ের কাছে ২৫টা টাকা ছিলো না কোলের সন্তানকে বাঁচানোর একটা ইনজেকশান কেনার জন্য। প্রথম সন্তানের লাশটিও দেখার অনুমতি পাননি পাকিস্তানের জেলে আটক প্রসাদ রায়। আমরা বড় হয়েছি- সুকুমার রায় আর রুশদেশের সাহিত্যের সাথে সাথে- পাগলা দাশু, ইকথিয়েন্ডারের সাথে চলে গেছি মেঠোপথে বা সাগর তলে।

৪৬ বছর অনেক সময়। অনেক পেয়েছি একটা জীবনে। এটুকু অন্তত সন্তানের চোখের দিকে তাকিয়ে বলতে পারবো- তোদের জন্য লড়াইটা করেছি সব অন্ধকার আর সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে। হুমকি দেখে ঘুরে দৌড় না দিয়ে রুখেছি। তাহরীর থেকে রেড শার্ট দেখেছি। শাহবাগ থেকে #হোকপ্রতিবাদ অথবা নন্দীগ্রামের লড়াইটাকে স্পর্শ করেছি।

মফস্বল থেকে উঠে এসে কাজ করেছি দেশের সংবাদপত্রের ইতিহাস পাল্টে দেয়া আজকের কাগজে। কাজ করতে পেরেছি দেশের প্রধানতম স্যাটেলাইট চ্যানেল একুশে টেলিভিশনে- সেখানে যখন মতের মিল হয়নি বলে মাথাটা উঁচু করেই বেরিয়ে এসেছি। খারাপ সময়টাতে আশ্রয় দিয়েছেন গাজী গোলাম দস্তগীর বীর প্রতীক। তার জিটিভিতে কথা বলতে দিয়েছেন অবাধ স্বাধীনতা। সেখানে দু বছর কাটিয়ে আবারও ফিরেছিলাম পুরোনো ঘরে- একুশেতে, সেখানে থেকে আবারো জিটিভিতে এখন। বাংলাভাষার প্রধান কাগজ আনন্দবাজার পত্রিকা পরিবারের সাথে সংযুক্ত রয়েছি।

মাঝে গত দু’তিন বছরে সহ্য করেছি অনেক মানসিক চাপ। খুচরো থেকে ধাড়ি জঙ্গিদের কেন যেন আমাকে বড্ড পছন্দ। পত্র থেকে ক্ষুদেবার্তা বারবার তাদের হুমকিটা মাঝে নৈমত্তিক হয়ে উঠেছিল। গোলাম আজম ছেলের প্রকাশ্য ঘোষণাও দেখলাম। দেখলাম নিজের মাটিতে দাঁড়িয়ে থাকলে কোনো ভয়কে আর ভয় মনে হয় না। সে কারণেই একজীবনে অনেক কিছুর মালিকানা হারালেও নিজের গলা আর জিভের মালিকানাটা নিজের কাছেই আছে। মুক্তবাজারে সব বেচে দিলেও মগজটুকু নিজেরই আছে এখনো। সে কারণেই- আদিবাসীদের বেদনা, ট্রান্স জেন্ডারের কষ্টে চোখ ভিজে যায়। রক্তাক্ত হই অভিজিৎ রায়, মোহাম্মদ আখলাখ, কান্দিল বালোচ, দীপনের হত্যায়।

সোশ্যাল মিডিয়াটা আমার কাছে সবার সাথে কথা বলার প্রধানতম খোলা জানালা- সেই জানালাতে মুখ রেখে আজ জন্মদিনের একদিন আগে জানাই সবার প্রতি নতজানু শ্রদ্ধা। একটা জীবনে যে ভালোবাসা সবাই দিয়েছেন, সেই সম্পদে বলিয়ান হয়ে আজ নিজেকেই নিজে বলতে পারি- না পাল্টে যে কটা দিন বাঁচো, এভাবেই বেঁচে যাও। শুধু মনে রেখ- জীবন একটাই, সেটা অন্তত জীবনের মতো করে খরচ করতে হবে।

লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও টিভি উপস্থাপক।

সংবাদটি শেয়ার করুন

ফেসবুক কর্নার বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :