স্যরি, সেতুমন্ত্রী

সারওয়ার-উল-ইসলাম
| আপডেট : ১৭ অক্টোবর ২০১৯, ১৬:৪২ | প্রকাশিত : ১৬ অক্টোবর ২০১৯, ১২:১১

‘ছাত্রলীগ অনেক ভালো কাজও করেছে। চাঁদের গায়েও খুঁত আছে। তবে গুটিকয়েক লোকের কারণে ছাত্রলীগের অর্জন ম্লান হয়ে যেতে পারে না।’

কথাগুলো বলেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। গত ৮ অক্টোবর ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথা বলেন।

একজন বিচক্ষণ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এবং একসময়ের ছাত্রলীগের জাঁদরেল নেতার মুখে এ কথাটি ঠিক বর্তমান প্রেক্ষাপটে কতটুকু অভিভাবকসুলভ হলো বা জুতসই হলো সে ব্যাপারে একটু প্রশ্ন থেকেই যায়।

প্রশ্নটা ইতিবাচক অর্থেই। তিনি একজন আওয়ামী লীগের অভিভাবক, সন্দেহ নেই। সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে খুবই ¯েœহ করেন। এবং বলা যায়, দলের ভালোমন্দ অনেক ব্যাপারেই তার ওপর ভরসাও করেন।

প্রশ্নটা এই অর্থে, ধরি ওবায়দুল কাদের একজন আদর্শবান পিতা। তার একটি মাত্র ছেলে। সমাজে ওই ছেলেটিকে সবাই ভালো বলেই জানেন। হঠাৎ ছেলেটি বখে গেল। একের পর এক অঘটন ঘটিয়েই যাচ্ছে। আদর্শবান পিতাকে ওই ছেলের জন্য নানা কথা শুনতে হচ্ছে সমাজ থেকে। এখন তিনি যদি ছেলের কোনো একটি অঘটন ঘটানোর পর বিচারের মুখোমুখি হয়ে বলেন ছেলের অনেক ভালো গুণ আছে। একটু না হয় খারাপ কাজ করেই ফেলেছে। চাঁদের গায়েও খুঁত আছে। তা হলে কি তিনি একজন আদর্শবান পিতার মতো কথাটা বললেন? প্রশ্নটা আসলেই এই অর্থেই।

এমন পিতার কথা শুনে বখে যাওয়া ছেলেটি আরও আশকারা পেয়ে যাবে। দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে আরও অঘটন ঘটিয়ে যাবে। কারণ তার পিতা সমাজের সামনে বলে দিয়েছেন তার ছেলের অনেক ভালো গুণ আছে। তার পিতার কথায় সে যে এখন খারাপ কাজ করে বেড়াচ্ছে, যা সমাজের চোখে গর্হিত কাজ, সেটাকে সে তখন হালাল হিসেবে ধরে নেবে। নিজেকে না শুধরিয়ে একের পর এক খারাপ কাজ করার অনুপ্রেরণাই পাবে।

আবার যদি এভাবে বিশ্লেষণ করিÑ ওবায়দুল কাদের সাহেবের দুটি ছেলে। একটি ভালো, অন্যটি খারাপ। খারাপ ছেলেটি একের পর এক খারাপ কাজ করেই চলেছে। সেই খারাপ ছেলের কারণে বিচারের ভরা মজলিশে বললেন, আমার বড় ছেলেটি ভালো, অনেক ভালো কাজ করেছে সমাজে। ছোট ছেলেটির খারাপ কাজের জন্য আমার পুরো পরিবারকে খারাপ বলা যাবে না, বা ছোট ছেলের জন্য আমার পরিবারের সমস্ত অর্জন ম্লান হতে পারে না।

তা হলে কি সেই কথা আদতে ধোপে টিকবে? টিকবে না, কারণÑ আপনি একজন আদর্শবান পিতা। আপনিও যদি বখে যাওয়া ছেলের মতো অঘটন ঘটিয়েই যেতেন সমাজে, তা হলে সেটা কিছুটা সহনীয় মনে হতো। কিন্তু হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রিয় সংগঠন ছাত্রলীগের একটি আদর্শ আছে। আছে ঐতিহ্যও।

এই ছাত্রলীগের নেতৃত্ব দিয়েছেন শেখ মুজিবুর রহমান। এই সংগঠনের নেতৃত্বে ছিলেন স্বনামধন্য ছাত্রনেতা তোফায়েল আহমেদ, পরবর্তী সময়ে আপনি ওবায়দুল কাদের। আপনাদের কারো কোনো কাজে ছাত্রলীগের কোনো প্রকার দুর্নাম তো হয়ইনি, বরং সুনাম কুড়িয়েছেন সাধারণ মানুষের কাছে। ছাত্রলীগের ঐতিহ্যের গায়ে একফোঁটা কলঙ্কের দাগ লাগতে দেননি।

ছাত্রলীগ করেছেন দলকে ভালোবেসে, দেশকে ভালোবেসে। দেশকে কিছু দেওয়ার জন্য। সেই ভালোবাসার জন্য ’৬৬ সালের ছয় দফা, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ’৭০-এর নির্বাচনে বিপুল বিজয় আওয়ামী লীগের। পরবর্তী সময়ে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ৯ মাস পর বিজয় অর্জন। সেই রাজনীতিতে নিজেদের কোনো চাওয়া-পাওয়া ছিল না। নিজেদের সম্পদের পাহাড় গড়ার স্বপ্ন ছিল না। রাজনীতি করার কারণে ক্ষমতার দাপটে মানুষকে তুচ্ছ করে দেখা হতো না। মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখে জেল-জুলুম সহ্য করেছেন শেখ মুজিবুর রহমান।

আর আজকের ছাত্রলীগ কারা করে? তাদের পারিবারিক পরিচয় কি? কিছুই জানা হয় না অনেক সময়। অভিযোগ রয়েছে, নানা রকমের তদবির করে পদ বাগিয়ে নেওয়া হয়। কখনো কখনো অর্থনৈতিক লেনদেনের মাধ্যমেও পদ কেনাবেচা হয়। আর সে কারণেই পদ পেয়ে একেকজন মরিয়া হয়ে ওঠে টাকা কামানোর জন্য। কিসের সংগঠন, কিসের কি? ছাত্রদের অধিকার আদায়ের চেয়ে সচিবালয়ে বা মন্ত্রীপাড়ায় ঘোরাঘুরি করে ঠিকাদারি কাজ বাগিয়ে নিতেই ব্যস্ত সময় পার করে। আর এ কারণেই অল্প বয়সেই একেকজন ছাত্রলীগ নেতা কোটি কোটি টাকার পাহাড় গড়ে বসে। তাদের দেখে পরবর্তী সময়ে নিচের সারির নেতারাও লোভে পড়ে যায় সভাপতি বা সাধারণ সম্পাদক হওয়ার। কারণ ওখানে যেতে পারলেই কোটি কোটি টাকা, গাড়ি-বাড়ি সব পাওয়া সম্ভব।

গত দশ বছরের ছাত্রলীগের ইতিহাসের দিকে একটু তাকাই, দেখি কি কি অর্জন করেছে তারা।

২০১০ সালে ছাত্রলীগের দুইপক্ষের সংঘর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু বকর সিদ্দিক মারা যায়। একই বছরে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র জুবায়ের আহমেদ মারা যায়। ২০০৯ থেকে ২০১৪ সালÑ এই সময়ে নিজেদের কোন্দেলে মারা যায় ৩৯ জন। অন্য সংগঠনের মারা যায় ১৫ জন।

২০০৯ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ ছাত্রলীগের একাংশের সাধারণ সম্পাদক আবুল কালাম আসাদ ওরফে রাজীবকে হত্যা করে লাশ বহুতল ভবন থেকে ফেলে দেওয়া হয়। ২০১০ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের কর্মী নাসরুল্লাহ নাসিমকে নিজেদের সংগঠনের কর্মীরা মারধর করে বহুতল ভবন থেকে ছুঁড়ে ফেলে হত্যা করে। ২০১২ সালে ছাত্রলীগ নেতার চাপাতির কোপে মারা যায় পুরান ঢাকার দর্জি বিশ্বজিৎ দাশ। দেশব্যাপী বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করে সেই হত্যাকা-।

গত কিছুদিন আগে চাঁদাবাজি আর নির্মাণ কাজ থেকে কমিশন দাবিসহ নানা অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ছাত্রলীগের সভাপতি আর সাধারণ সম্পাদককে দল থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।

সবশেষ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবরার ফাহাদকে হত্যার ঘটনায় দেশব্যাপী ছাত্রলীগ সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মনে ক্ষোভের আগুন জ্বলছে। যারা আওয়ামী লীগকে পছন্দ করেন, যারা বঙ্গবন্ধু আর শেখ হাসিনাকে পছন্দ করেন তারাও ক্ষোভে ফুঁসে উঠছেন। এটা কীভাবে সম্ভব? যেখানে স্বাধীন মতকে পছন্দ করতেন বঙ্গবন্ধু। যেখানে স্বাধীন মতকে পছন্দ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেখানে ছাত্রলীগের ভেতরে এমন কি দেশপ্রেম জেগে উঠলো যে, ভিন্নমত পোষণ করায় হত্যা করেই ফেলতে হবে একজন আবরার ফাহাদকে।

যে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় গড়ে উঠেছিল আওয়ামী লীগ, যারা লেখকদের মুক্তচিন্তা বা মুক্তমতকে শ্রদ্ধা করে। পাশাপাশি প্রতিক্রিয়াশীলরা হুমায়ুন আজাদকে চাপাতি দিয়ে হত্যা চেষ্টা চালায়, যা কি না দেশব্যাপী ছিঃ ছিঃ পড়ে গিয়েছিল। সেই প্রতিক্রিয়াশীলদের চেয়েও খারাপ নজির স্থাপন করলো বুয়েটের ছাত্রলীগের নেতৃবৃন্দ।

কি দাপট তাদের! রুম থেকে ডেকে নিয়ে ক্রিকেটের স্ট্যাম্প দিয়ে দুই দফা পিটিয়ে আবরারকে মেরেই ফেললো! তারপর চ্যাংদোলা করে তিনতলা থেকে দোতলায়, পরে ক্যান্টিনে লাশ ফেলে রাখলো। ভাবা যায় এরা ছাত্রলীগের নেতৃবৃন্দ! এরা সমাজের সভ্য বাবা-মায়ের সন্তান। এবং ট্যালেন্ট ছাত্র এরা, অনেক পড়াশোনা করেই তবে এখানে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেয়েছে। তাদের কাজ এটা কিছুতেই বিশ্বাস করা যায় না। রীতিমতো কষ্ট হয় বিশ্বাস করতে। যে ছাত্রলীগের জন্য বঙ্গবন্ধু খেটেছেন জেল। শুধু মানুষের কথা ভেবে, মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য রাজনীতি করেছেন বঙ্গবন্ধু। সেই বঙ্গবন্ধুর প্রাণের সংগঠনের হালের নেতৃবৃন্দের কি করুণ অধঃপতন!

মাননীয় মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, দুঃখিত আপনার ওই কথা মেনে নেওয়া যায় না। ছাত্রলীগের বিশাল ঐতিহ্যকে যারা ধুলায় মিশিয়ে দিচ্ছে তাদের হয়ে ওই চাঁদের খুঁত আছেÑ এ ধরনের উপমা কবিতার খাতায় বেশ মানানসই, রাজনীতির জন্য একদম বেমানান।

আওয়ামী লীগে আগাছা-পরগাছা অনুপ্রবেশ করেছে। যাদের জন্য একটা সময় মানুষের মন থেকে সংগঠনটির প্রতি ভালোবাসা হয়তো একসময় কর্পূরের মতো উবে যাবে।

আর বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনা একা কি করবেন? তিনি তো পিতার মতোই সমস্ত অন্যায়ের ব্যাপারে কঠোর পদক্ষেপ নিয়ে থাকেন। কিন্তু তাঁর একার পক্ষে কি সব খবর রাখা সম্ভব? তারপরও নিজের চেষ্টায় যতটুকু অন্যায়ের খবর পান সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেন। তাঁকে কি সব খবর পৌঁছানো হয়?

সারা দেশে ছাত্রলীগের অধঃপতনের বিষয়টি তো এক বুয়েট ট্র্যাজেডি দিয়েই বোঝা যায়। কি দাপট ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের। কারণ তারা জানে অপরাধ করে পার পাওয়া যাবে। কোথাও না কোথাও তো সে রকম নজির সৃষ্টি হয়েছে। খুন-খারাবি করে আজ পর্যন্ত কোনো ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীর ফাঁসি হয়েছে? হয়নি। আইনের মারপ্যাঁচে বা প্রভাব খাটিয়ে বের হয়ে গেছে।

আর সে কারণেই ছাত্রলীগ করাকে সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়স্থল মনে করে কেউ কেউ। সেই সুযোগ নিয়েই দলের ভেতর ঢুকে গেছে জামায়াত-শিবির-ফ্রিডম পার্টি-বিএনপির দুধের সর খাওয়া লোকজন। যারা নিরাপদে থাকার জন্যই শুধু আসেনি, পাশাপাশি আওয়ামী লীগের যে ঐতিহ্য সেটাকে নষ্ট করার বড় মিশন নিয়েই ঢুকেছে। ওই কাল- কেউটেদের যারা অনুপ্রবেশে সুযোগ করে দিয়েছে তাদের মুখোশ খুলে ফেলতে হবে। তা না হলে আবরারদের মতো অনেক ট্যালেন্টকে আমাদের হারাতে হবে। আর আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকরা সংবাদ মাধ্যমে বলে বেড়াবেÑ অপরাধী যেই হোক কাউকে ছাড় দেবো না আমরা।

পুরো আওয়ামী লীগে শুদ্ধি অভিযান শুরু করা প্রয়োজন। মাননীয় সেতুমন্ত্রী, আপনি বিশ্বাস করেন আপনার দলের সবাই ভালো, তা বলা যায় না। কিন্তু এই খারাপ লোকদের বাদ দেওয়া খুবই কষ্টসাধ্য ব্যাপার? নাকি লোম বাছতে কম্বল উজাড় হয়ে যাওয়ার ভয়ে সেই শুদ্ধি অভিযান চালানো যাচ্ছে না?

আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে শুরু করে দেশের নানা ক্রান্তিকালে ছাত্রলীগের কি ভূমিকা ছিল তা আজকে যারা ছাত্রলীগ করতে আসছে তারা জানে না। আর জানে না বলেই যা ইচ্ছে তা-ই করে বেড়াচ্ছে। ছাত্রলীগের সেই ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখার জন্য কঠোর হস্তে দুর্নীতিবাজদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা জরুরি।

সবশেষে আবরারের হত্যাকা-ে যারা জড়িত তাদের সবাইকে আইনের আওতায় এনে কম সময়ের মধ্যে সর্বোচ্চ শাস্তি দিয়ে দেশবাসীর ভেতরে আওয়ামী লীগের প্রতি আস্থার জায়গাটা সৃষ্টি করুন। প্রমাণ করে দিন, বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ এবং এর অঙ্গসংগঠনের কেউই অপরাধ করে পার পায় না। পেতে হবে সর্বোচ্চ শাস্তি। তা না হলে জনরোষ একবার সৃষ্টি হয়ে গেলে তাকে আর ফেরানো সম্ভব হবে না।

প্লিজ সেতুমন্ত্রী, ছাত্রলীগের ব্যাপারে কঠোর হোন। নইলে পরে সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে পড়বে।

লেখক: ছড়াকার ও সাংবাদিক

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :