বুক রিভিউ কী, কেন, কীভাবে

অরুণ কুমার বিশ্বাস
 | প্রকাশিত : ১৭ অক্টোবর ২০১৯, ২২:২১

পত্র-পত্রিকায় ও অনলাইনে ইদানিং বুক রিভিউ বা পাঠপর্যালোচনা বেশ চোখে পড়ছে। তার মানে কারো কারো মতে বই পড়ার প্রবণতা কমলেও সমাজে বোদ্ধা পাঠকের সংখ্যা নেহাত কম নয়। তারা শুধু বই পড়ছেন এমন নয়, পাঠের পর পাঠ প্রতিক্রিয়া কিংবা পর্যালোচনাসহ হাজির হতেও সঙ্কোচ বোধ করছেন না। এটা নিঃসন্দেহে একটি ভাল সংবাদ। কিন্তু একথা বললেও নিশ্চয়ই অত্যুক্তি হবে না যে, বেশির ভাগ পাঠপর্যালোচনা বইয়ের সারাংশ তৈরির প্রয়াস মাত্র। একে ঠিক ‘রিভিউ’ বা পাঠ মূল্যায়ন বলা চলে না।

রিভিউ বলতে আমরা ঠিক কী বুঝি?

সোজা বাংলায় রিভিউ মানে ফিরে দেখো। আমি মজা করে বলি ‘ঘুরে ফিরে দেখা’। অর্থাৎ একটি বই পাঠের পর স্রেফ পাঠক হিসেবে নয়, একজন বোধবুদ্ধিসম্পন্ন সমলোচক হিসেবে বইয়ের নামকরণ থেকে শুরু করে বইয়ের মোটিফ বা উপজীব্য, রচনারীতি, শব্দচয়ন, বিষয়ের সঙ্গে সমসাময়িকতার অন্বয় ইত্যাদি নানা বিষয় নিয়ে নাতিদীর্ঘ আলোচনা। মনে করবেন আপনি একজন দক্ষ ক্রিটিক। ক্রিটিকের সাধারণ বাংলা তর্জমা সাহিত্যসমালোচক। তবে সমালোচনারও কিন্তু একটা আলাদা মানে আছে। যদি আপনি চলমান রাজনৈতিক কেতা বা সংস্কৃতিতে বিশ্বাসী হন তাহলে ভুল করবেন। সেখানে সমালোচনা মানে নিছক খুঁত ঘাঁটা। সাহিত্যসমালোচকের কাজ বইটির ভালমন্দ দুটি দিক নির্মোহ দৃষ্টিতে দেখে-শুনে ও সম্যক উপলব্ধি করে তারপর ইতিবাচকভাবে ও ভাষায় তুলে ধরা, স্রেফ ‘ফল্ট ফাইন্ডিং’ নয়।

বিশিষ্ট সাহিত্যসমালোচক বিল অ্যাসেঞ্জোর মতে, বুক রিভিউ বইটি বর্ণনা করে, পর্যালোচনা করে এবং মূল্যায়ন করে। তার ভাষায় ‘ডেসক্রাইব, অ্যানালাইজ এন্ড ইভ্যালুয়েট’। এখানে বর্ণনা মানে সংক্ষিপ্তভাবে বইটির মূলভাব তুলে ধরা, যাতে রিভিউ পাঠক সহজেই উপজীব্য বুঝতে পারেন। ‘সিনপসিস’ বা সারাংশ বলেন কেউ কেউ।

রিভিউ লেখার আগে যা মাথায় রাখবেন: বইয়ের টাইটেল বা নাম, মোটিভ বা উপজীব্য, সময় বা কাল,মূলভাব বা প্রধান বিষয়- যা কিনা বইয়ে বিধৃত হয়েছে, বা যার মধ্যদিয়ে ঘটনার অনুগমন ও প্রবহমানতা বিদ্যমান।

লিখনশৈলী, আঙ্গিক বা ফরম্যাট: শুরুতেই বইয়ের বাহ্যিক গুণাগুণ সম্পর্কে বলার কোনো প্রয়োজন নেই, কারণ ওটা রিভিউর মুখ্য উদ্দেশ্য নয়। একেবারে শেষের দিকে প্রডাকশন সম্পর্কে কিছু বলা যেতে পারে।

বইটি যদি উপন্যাস হয়, তাহলে: কাহিনির ধরন কিংবা সেটি সাহিত্যবিচারের কোন বিভাগে পড়ে, তা উল্লেখ করা বাঞ্ছনীয়। আপনি যদি বইয়ের টাইপ বা ধরন না বোঝেন, তাহলে কিছুতেই শেষ অব্দি একটি সফল রিভিউ লিখে উঠতে পারবেন না।

লেখকের ‘পয়েন্ট অফ ভিউ’ বুঝে নেয়া দরকার। সেই ভিউপয়েন্টের সঙ্গে আপনি একমত কিনা, বা দ্বিমত হলে কেন, তাও বলতে হবে। মনে রাখবেন, আপনি কিন্তু তুখোড় সমালোচকের চোখে বইটি ব্যবচ্ছেদ করছেন। তাই না বুঝে মিছে লেখকের মানহানি ঘটাবেন না।

কিছু কিছু লাইন বা বিষয় কোট করতে পারেন, যা কিনা বইটির জঁনরা বা মূলভাবের সঙ্গে বিশেষভাবে সংগতিপূর্ণ।

লেখকের রচনারীতির উল্লেখ করবেন। ফরমাল, ক্যাজুয়াল, নাকি উভয়ই! তার এই রচনারীতি কি মোটিভ বা বিষয়ের সঙ্গে সাজুয্যপূর্ণ বলে মনে করেন, তাও লিখবেন।

উত্তম পুরুষ, নাম পুরুষ নাকি সর্বজ্ঞ লিখনরীতিতে (ওমনিসিয়েন্ট রাইটার) লেখক বইটি লিখেছেন তাও বলা যেতে পারে।

শব্দচয়ন বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। লক্ষ্য করবেন, প্রবন্ধ, কবিতা কিংবা গদ্যের (গল্প, উপন্যাস বা রম্যরচনা) ভাষা কিন্তু এক নয়। শব্দচয়নেও বিশেষ পার্থক্য রয়েছে।

লেখক তার গ্রন্থে স্বীকৃত কোনো কনসেপ্ট উল্লেখ করলে সেটি সঠিক ও সার্থকভাবে চরিত্রায়নে প্রতিফলিত কিনা তাও খতিয়ে দেখবেন।

লেখকের লেখার শেষভাগ কি সামারি বা মূল বিষয়ের সঙ্গে সুসামঞ্জস্যপূর্ণ, নাকি খাপছাড়া মনে হল- তাও বিবেচনায় নেবেন।

ইলাস্ট্রেশন থাকলে অবশ্যই তার গুণাগুণ বিচার করবেন। ছোটোদের বইয়ের ক্ষেত্রে ইলাস্ট্রেশনের ‘কোয়ালিটি ও ক্লারিটি’ একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

উপন্যাস হলে অবশ্যই তাতে সমাজের প্রতি একরকম মেসেজ বা লেখকের নিজস্ব অভিমত ফুটে উঠতে পারে। এটি লেখকের স্বাধীনতা। আপনাকে ভেবে দেখতে হবে, তার এই মনোভাব সমাজঘনিষ্ঠ, নাকি একেবারেই গ্রহণযোগ্যয় নয়, বা উৎকেন্দ্রিক। যেমন কিছু কিছু লেখক তাদের তথাকথিত মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাসে প্রকারান্তরে দেশের বিরুদ্ধেই অবস্থান নিয়েছেন, যেন সুগার কোটেড কুইনিন।

বলা হয়, লেখা বুঝতে গেলে লেখককে বুঝেতে হয়। তিনি কোন সমাজে বা ক্লাসে বিলং করেন তাও বিবেচ্য বিষয়। তবে যারা প্রকৃতই মনস্বী লেখক, তারা কিন্তু নিজের শ্রেণি বা আবাসের (বা লেবাস) উর্ধ্বে উঠেও পুরো সমাজকে নৈর্বাক্তিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে পারেন।

একটি পারটিকুলার চরিত্র সৃষ্টি করতে গিয়ে কেউ কেউ অকারণ অশ্লীল/অবমাননাকর বা স্থূল শব্দ ও ডায়ালগ ব্যবহার করেন। ক্রিটিক হিসেবে আপনাকে সেটি চুলচেরা বিশ্লেষণ করে আদৌ তার দরকার ছিল কিনা তা প্রতিপাদন করবেন।

রিভিউর শুরুতে: বইয়ের শিরোনাম, লেখক, প্রকাশনা সংস্থার নাম, তারিখ, এডিশন, পৃষ্ঠাসংখ্যা আইএসবিএন নম্বর ইত্যাদি উল্লেখ করবেন।

এমন একটি বাক্য দিয়ে শুরু করুন, যা কিনা পাঠক পড়ামাত্র লুফে নেয়। মনে রাখবেন, আপনি কিন্তু রিভিউর মাধ্যমে লেখকের সঙ্গে পাঠকের একটি সম্পর্ক গড়ে দিচ্ছেন। বইটি পড়তে গিয়ে সবচে ভালোলাগা একটি বাক্য বা বিষয় দিয়ে শুরু করতে পারেন।

অতি অন্তঃজ কিছু বিষয়, যেমন বইটির মোটিফ বা উপজীব্য, উপন্যাস হলে মূল চরিত্রসমূহের পরিচয় দিতে পারেন।

একটা বিষয় মাথায় রাখবেন, আপনি কিন্তু লেখকের লেখা বইটির পাঠপর্যালোচনা করছেন। আপনি যেভাবে বইটি দেখতে চান, তা কিন্তু নয়। বইয়ের বিচার করুন, স্বপ্নের নয়। লেখকের প্রতি অকারণ অবিচার করবেন না। সরাসরি বাজে মন্তব্য করবেন না।

আপনি যদি লেখকের বই আগেও পাঠ করে থাকেন, তাহলে পূর্বের সঙ্গে তুলনা করতে পারেন। এটা অবশ্য ইতিবাচক হলেই করা উচিত। নইলে রিভিউ পাঠকগণ আপনার লেখা পড়ে লেখক সম্পর্কে বিরূপ ধারণা পাবেন।

বইয়ের সঙ্গে যায়, লেখকের এমন কিছু ব্যক্তিক বিষয়- যেমন তার অভিজ্ঞতা, দৃষ্টিভঙ্গির প্রসারতা, বিদেশ ভ্রমণ, পেশা, অন্যান্য ইতিবাচক গুণ যা কিনা বইটিকে সমৃদ্ধ করেছে বলে আপনি মনে করেন, তাও উল্লেখ করবেন।

আরেকটি বিষয় খেয়াল রাখুন। আপনার রিভিউর টার্গেট পাঠক কে! কাদের জন্য আপনি বইটির পাঠপর্যালোচনা করেছেন! সেই অনুযায়ী রিভিউর ভাষা ও শব্দ নির্বাচন করুন। উপন্যাসের রিভিউ প্রবন্ধের ভাষায় লিখলে পাঠক নিশ্চয়ই হতাশ হবে।

রিভিউর শব্দসংখ্যা বইয়ের ধরণ ও পৃষ্ঠার উপরে নির্ভর করে। এ বিষয়ে ধরাবাঁধা কোনো নিয়ম নেই।

চেষ্টা করুন একটি ইতিবাচক বাক্য দিয়ে রিভিউ শেষ করতে। তার মানে এই নয় যে, বইটি সুখপাঠ্য মনে না হলেও আপনি মিছেই লেখার গুণগান করবেন।

একনজরে বুক রিভিউর প্রাসঙ্গিক বিষয়াবলী:

মাথায় রাখুন- কী নিয়ে গল্প? প্রধান চরিত্র কে কে? কোন সময়/সমাজ/বিষয় নিয়ে লেখক লিখেছেন? চরিত্রসমূহ কি বিশ্বাসযোগ্য হয়েছে? শিক্ষণীয় বা বিনোদনের খোরাক ছিল কি না? গল্পের মূল ঘটনা ও সংঘটনকারী কারা?

অ্যাডভেঞ্চার বা থ্রিলারধর্মী হলে লেখক কি শেষঅব্দি টানটান উত্তেজনা ধরে রাখতে পেরেছেন?

পুরো বইটিতে আপনার প্রিয় চরিত্র কে? কেন? বইটি কি আপনি পছন্দ করেছেন? করে থাকলে, কেন?

বইটিতে কী কী ত্রুটি আপনার চোখে ধরা পড়েছে তা উদাহরণসহ উল্লেখ করুন। আপনি কি বইটি অন্যদের পড়ার জন্য উৎসাহিত করবেন? বইটির সামাজিক ও সাহিত্যমূল্য কতখানি? এটিকে আপনি ‘ক্ল্যাসিক’ বলে মনে করেন?

আপনি যা করবেন না: রিভিউতে বাজে ও অশ্লীল মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকবেন। মনে রাখবেন, তাতে আপনার রুচি ও ব্যক্তিপরিচয় প্রতিফলিত হবে। কাজটি আপনি শত্রুতাবশত করেছেন, পাঠক তাই ভাববে।

আবেগের বশে রিভিউ লিখবেন না। কাছের ও পছন্দের লোক হলে অনর্থক ইচ্ছেমতো প্রশংসা করবেন, এটা ঠিক নয়।

আবার বইটি ভাল না লাগলেও লেখকের মুখ চেয়ে অধিক প্রশংসা কাম্য নয়। তাতে লেখক তার অক্ষমতা বা ত্রুটি বুঝতে পারবে না।

সবশেষে বলি, বইটি ভালো করে পড়ুন। প্রয়োজনে বারবার পড়ুন। প্রচুর বই পড়ুন। বুঝেশুনে তারপর পাঠপর্যালোচনা করুন। তাতে লেখক, পাঠক এবং আমাদের বাংলা সাহিত্য সমৃদ্ধ হবে। সবার জন্য শুভকামনা।

সংবাদটি শেয়ার করুন

ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :