ছাত্র রাজনীতি হোক দলীয় প্রভাবমুক্ত

মহিবুল ইজদানী খান ডাবলু
| আপডেট : ১৮ অক্টোবর ২০১৯, ১৫:৫৬ | প্রকাশিত : ১৮ অক্টোবর ২০১৯, ১৫:১৮

দেশে ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করা নিয়ে এখন চলছে আলোচনা-সমালোচনা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাত্ররাজনীতি বন্ধের বিপক্ষে মন্তব্য করেছেন। সম্প্রতি এক সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি বলেন, আমি নিজেও ছাত্ররাজনীতির মধ্যে দিয়ে আজ এখানে এসেছি। আওয়ামী লীগের আগে ছাত্রলীগের জন্ম হয়েছে। বাংলাদেশে ইতিহাসের সাথে ছাত্র রাজনীতি ওৎপ্রোতভাবে সম্পর্কিত। কথাটা অবশ্যই বাস্তব সম্পন্ন। আমার মনে হয় না মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য নিয়ে কেউ দ্বিমত পোষণ করবে। তবে বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক দলের সমর্থনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অঙ্গনে রাজনীতি করা কতটুকু যুক্তিসঙ্গত এ ব্যাপারে নতুন করে ভাবার সময় এসেছে।

অতীতের ছাত্ররাজনীতি আর বর্তমান ছাত্ররাজনীতির মধ্যে পার্থক্য অনেক। বছর বছর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর দৈনন্দিন ঘটনা আমাদেরকে বারবার স্মরণ করিয়ে দেয়, এভাবে আর চলবে কতদিন?

পঞ্চাশ ও ষাট দশকের রাজনীতি ছিল আমাদের স্বাধিকার আন্দোলনের রাজনীতি। এখানে শিক্ষার্থীদের ভূমিকা ছিল অসীম। পরবর্তী সময়ে আশির দশক ছিল জিয়া ও এরশাদ এই দুই সামরিক শাসকের বিরুদ্ধে আন্দোলন। অতীতের সাথে আজকের ছাত্ররাজনীতির পার্থক্য অনেক। ছাত্ররাজনীতি বাংলাদেশে একসময় প্রয়োজন ছিল, তবে এখন আর প্রয়োজন নেইl আজ আমাদের নতুন করে ছাত্ররাজনীতি নিয়ে ভাবতে হবে। কারণ বর্তমান ছাত্ররাজনীতিতে এখন ছাত্ররা রাজনৈতিক দলগুলোর সমর্থনে সরাসরি সক্রিয়।

স্ব স্ব রাজনৈতিক দলগুলোর স্বার্থ রক্ষা ছাড়া বর্তমান ছাত্র রাজনীতির আর কোনো ভূমিকা নেই। শিক্ষার্থীরা তাদের লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে নিজ নিজ দলীয় রাজনীতিতে সক্রিয়। ছাত্র কল্যাণের রাজনীতি না করে তারা নিজেদের রাজনৈতিক দলের স্বার্থরক্ষায় সরকারবিরোধী রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েছে। পরবর্তী সময়ে দল ক্ষমতায় গেলে তারা নিজের পদবিকে ব্যবহার করে কোটি কোটি টাকার দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ে। একে আমরা কখনো ছাত্ররাজনীতি বলতে পারি না।

ছাত্ররাজনীতি অবশ্যই থাকবে। বিশ্বের সকল গণতান্ত্রিক দেশে ছাত্ররাজনীতি আছে। সুতরাং বাংলাদেশ এর ব্যতিক্রম হবে কেন? তবে সে রাজনীতি হতে হবে ছাত্র কল্যাণের স্বার্থে, রাজনৈতিক দলের স্বার্থ রক্ষার্থে নয়। ছাত্রদের অধিকার, স্বার্থ রক্ষা, সঠিক শিক্ষা ব্যবস্থাসহ বিভিন্ন বিষয়গুলোকে সামনে রেখে শিক্ষার্থীরা করবে রাজনীতি। বছর বছর ছাত্র সংসদের নির্বাচনে জয়ী নেতৃত্ব শিক্ষাঙ্গনের সমস্যা সমাধানে কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি জানাবে। দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষ দাবি সমাধানের চেষ্টা না করলে প্রয়োজনে নির্বাচিত ছাত্র নেতৃত্ব শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের যেতে পারে। তারপরও যদি তাদের ন্যায্য দাবি সমাধানের কোনো চেষ্টা করা না হয় তখন তারা আন্দোলনে নামতে পারে।

যে আন্দোলন হবে ছাত্র কল্যাণের স্বার্থে, সরকার উৎখাতের জন্য নয়। এভাবেই বিশ্বের গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে ছাত্র রাজনীতি চলে আসছে। ইউরোপের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্র-ছাত্রীরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরে সরাসরি কোনো রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পর্কিত নয়। এখানেও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্র সংসদ আছে। প্রতি বছর নির্বাচন হয়। শিক্ষার্থীরা ভোট দিয়ে তাদের নেতৃত্বকে নির্বাচিত করে। ছাত্র সংসদ কোনো রাজনৈতিক দলের নাম কিংবা সমর্থনে কাজ করে না। ছাত্র সংসদ কাজ করে শিক্ষার্থীদের নানা সমস্যা সমাধানের লক্ষ্য নিয়ে। রাজনৈতিক শ্লোগান কিংবা বক্তব্য দিয়ে নয়।

ইউরোপে ছাত্র-ছাত্রীরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বাইরে রাজনীতির করে থাকে। শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সদস্য হিসেবে দলের বিভিন্ন শাখায় গুরুত্বপূর্ণ পদেও দায়িত্ব পালন করে। দেশের প্রতিটি নাগরিকের মতো শিক্ষার্থীদেরও দলীয় রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার অধিকার আছে। তবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরে নয়। ছাত্র রাজনীতি থাকবে তবে তা হতে হবে রাজনৈতিক দল প্রভাবমুক্ত একটি ছাত্র কল্যাণমুখী রাজনীতিl

বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো যাই বলুক না কেন যে ছাত্র সংগঠনগুলো রাজনৈতিক দলের কোনো অঙ্গ সংগঠন নয়, আসলে বাস্তব কি তা আমরা সবাই জানি। এভাবে শিক্ষার্থীদের আর কতদিন রাজনৈতিক দলগুলো তাদের স্বার্থে ব্যবহার করবে? লক্ষণীয় যে দেশের বড় বড় রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃত্বের ইশারায় প্রতিষ্ঠিত হয় ছাত্র সংগঠনের নেতৃত্ব। গণতন্ত্র এখানে ম্লান। নির্বাচন এখানে নীরব। স্বার্থ এখানে সরব। সুতরাং এভাবে বাস্তবতাকে এড়িয়ে যাওয়ার কোনো মানে নেই।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্ররাজনীতি থাকবে তবে সে রাজনীতি হবে ছাত্র কল্যাণমুখী রাজনীতিl কোনো রাজনৈতিক দলের লেজুড়ভিত্তিক রাজনীতি নয়l

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে রাজনৈতিক দলের সমর্থনে রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে পারে। সাথে সাথে প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র কল্যাণের ওপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত সংগঠনে শিক্ষার্থীরা তাদের দাবি দাওয়া তুলে ধরার জন্য রাজনীতি মুক্ত ছাত্র সংসদ নির্বাচিত করতে পারবে। অর্থাৎ শিক্ষার্থীরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অঙ্গনে সরাসরি কোনো দলীয় রাজনীতিকে সামনে রেখে আন্দোলনে যেতে পারবে না।

যেসব শিক্ষার্থী রাজনীতিতে আগ্রহী তারা তাদের স্ব স্ব দলের সমর্থনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বাইরে অবশ্যই সরকারবিরোধী আন্দোলনও করতে পারবে। সুইডেনের ছাত্র-ছাত্রীরা তাদের স্ব স্ব রাজনৈতিক দলের সমর্থনে সক্রিয়। তবে তা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরে নয়, বাইরে। সরকার চাইলে এ ধরনের একটা পরিবর্তন বাংলাদেশে আনতে পারে। সব কথার শেষ কথা হলো ছাত্র রাজনীতি থাকবে তবে তা হতে হবে রাজনৈতিক দল প্রভাবমুক্ত ছাত্ররাজনীতি। ছাত্র কল্যাণমুখী রাজনীতি।

লেখক: সদস্য, মনোনয়ন বোর্ড সুইডিশ লেফট পার্টি সেন্ট্রাল কমিটিl জুরি স্টকহল্ম আপিল কোর্ট

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :