নিয়তি

অয়েজুল হক
| আপডেট : ১৮ অক্টোবর ২০১৯, ২১:১৬ | প্রকাশিত : ১৮ অক্টোবর ২০১৯, ২১:১৫

মাছ ধরার একটা রুটিন আছে মতির। লেখাপড়া না জানলেও মতি জীবনটাকে সাজাতে চায় রুটিনমাফিক। এই যেমন মাছ ধরতে যাওয়ার আগে একটা পান খাবে, পানে কাচা সুপারি থাকতে হবে। মাছ যতোই কিলবিল করুক রাত দশটার পর সে বাড়ি ফিরবে। মাঝেমাঝে যে ব্যতিক্রম হয় না তা নয়। রুটিন মতো আজও সন্ধ্যা নামতেই মাছ ধরার তোড়জোড়। মিনি তাড়াতাড়ি পান দে। কাচা সুপারি দিবি কিন্তু। মিনি পান দিতে দেরি করে না। নতুন বউ। বিয়ে করেছে আট মাস। বাবা-মা সাধ করে মিনি নামের মেয়েটাকে গলায় ঝুলিয়ে দিয়েছে! অবশ্য আট মাসের সংসার জীবনে অশান্তিতে পড়তে হয়নি মতির। পান গালে পুরে প্রতিদিনের মতো চেনা পথে যাত্রা মতির।মধুমতি নদীটা আর আগের মতো নেই। এই নদীর সাথে বংশ-পরম্পরায় ওদের সম্পর্ক। ছোটবেলা বাবার সাথে যখন মাছ ধরতে আসতো তখন নদীর সে কী তুফান, জোয়ার ভাটার টান! একূল থেকে ওকূল দেখা যেতো না। ভয়ে কতোদিন কেঁদেছে হিসাব নেই। সে নদী এখন মৃতপ্রায়। বালুচরে। দিনে দিনে শেষ হওয়া নদী দেখে কষ্ট হয়। অবশ্য মতির কষ্ট নদী বোঝে কি না সে জানে না।

ঘাট থেকে নৌকা নিয়ে পাড় বেয়ে সামান্য কিছুদূর এগিয়েছে ঠিক সে সময় ঝপ করে কিছু একটা পড়ার শব্দ কানে আসে। এই নির্জন এলাকায়, রাতের নদীতে সাধ করে কেউ গোসল করতে আসবে, লাফিয়ে পড়বে নদীর ভেতর তেমন সম্ভাবনা ক্ষীণ। কৌতূহল থেকেই শব্দের দিকে এগিয়ে যাওয়া। কাছাকাছি গিয়ে টর্চ লাইটের আলো ফেলে। একটা বস্তা ডুবছে। দ্রুত নৌকা বাড়ায়। বস্তাটা ডুবে যাবার সামান্য আগেই দু'হাত বাড়িয়ে বস্তার মুখটা ধরে ফেলে। ওজন কম নয়। বেশ কষ্ট করেই টেনে তুলতে হয়। বস্তার মুখ খুলে একেবারেই ভড়কে যায় মতি। মানুষ! দশ-বারো বছরের বালক।অনেকদিন পর রুটিন ভেঙে বাড়ি ফেরার প্রচণ্ড তাড়া অনুভব করে বুকের ভেতর। ভয়ে, অস্থিরতায়। নৌকা ঘুরিয়ে দ্রুত ঘাটে পৌঁছে বস্তাটা ঘাড়ে করে বাড়ির দিকে হাঁটে। ভয়ে শরীর কাপে।বাড়ি ফিরে চিৎকার করে ডাকে, মিনি ও মিনি।

ডাক শুনে ছুটে আসে মিনি। বস্তা ঘাড়ে করে স্বামীকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কিছুটা অবাক হয়। বাড়ি ফিরে মতি চিৎকার করেনা, এতো আগে বাড়ি ফেরার কথাও না । হাতে মাছের একটা ব্যাগ থাকবে, সেটাও নেই! ছোট ব্যাগের বদলে বড় বস্তা! মিনি ভাবে আজ অনেক বড় মাছ পেয়েছে হয়তো! মুখে হাসি নিয়ে দৌড়ে যায়, কি মাছ পাইলা?

- মাছ না মানুষ পাইছি। মনে হয় বাইচা আছে।

- কী কন! নদীতে মানুষ পাইলেন!

- হ, আজকাল নদীতে মাছের সাথে মানুষও পাওয়া যায়।তাড়াতাড়ি ধর।

দুজনে ধরাধরি করে বস্তা থেকে বের করে নদীতে ফেলা মানুষ। আট দশ বছরের ছোট মানুষ। বেশ রুষ্টপুষ্ট দেহ। চেহারায় মায়ার ছোঁয়া।

- জান আছে, দম নেয়। হাসফাঁস করে কথা বলে মতি।

- হ।

- মাদুর আর পাখা নিয়ে আয়।

মিনি দ্রুত ঘর থেকে একটা তালপাখা আর খেজুর পাতার মাদুর নিয়ে আসে। উঠানেই বিছিয়ে দেয়। ছেলেটাকে শুইয়ে দিয়ে মিনি বাতাস করে, মতি ওর শরীরটা ভালো করে মোছে। মাথায় পানি দেয়, তেল দিয়ে শরীর মালিশ করে। ঘণ্টাদু'য়েক পর চোখ মেলে তাকায় ছেলেটা। তাকিয়েই কান্না জুড়ে দেয়, আমাকে মারবেন না। আব্বু..... মতি সান্ত্বনা দেয়, তোমার কোনো ভয় নেই বাবা। ছেলেটা মতি আর মিনিকে ভালো করে দেখে। হয়তো ওদের চেহারায় কিছু খোঁজে, হিংস্রতা কিংবা মানবতা!

- তোমার নাম কী বাবা? আদূরে গলায় প্রশ্ন করে মতি।

- মাহি।

- কারা তোমাকে নদীতে ফেলে দিল?

- আমার স্যার আর তার বন্ধু। জানেন আমাকে বুঝেয়ে, লোভ দিয়ে স্যার আর তার বন্ধু খারাপ কাজ করতে চাইছিল। আমি চিৎকার করতেই আমার গলা টিপে ধরে।

- তারপর?

- তারপর তো এই যে এখানে, আপনারা কে? স্যারের বন্ধু?

- না, আমরা তোমার বন্ধু।

মাহি হাসে, পরিচ্ছন্ন পবিত্র এক হাসি।হাসি দেখে মতি ভাবে মানুষ এতো নিষ্ঠুর, পাশবিক হয় কী করে! মাহিকে ঘরে নিয়ে খাবার খাওয়ায়। মাহি বার বার বাবা-মার কথা, বাড়ি ফেরার কথা বলে। ওর বাবা গাছগাতির চেয়ারম্যান। মতি সান্ত্বনা দেয় যতো দ্রুত সম্ভব বাড়িতে পৌঁছে দেবার। পরদিন সাত সকালে বাড়ি থেকে বের হতেই অবাক হয় মতি!গ্রামের পর গ্রাম ছড়িয়ে গেছে চেয়ারম্যানের ছেলে হত্যার খবর।মাহিকে নিয়ে বাড়ি থেকে বের হতে ভয় করে।মানুষ মাহিকে তার সাথে দেখে ভুলকরে আক্রোশে পেটাতে পারে। মেরে ফেলতে পারে।দিন রাত মিলিয়ে দেড় দিন কেটে যায়। দু'দিনের মাথায় সন্ধ্যা নামতেই বউ আর মাহি কে নিয়ে একপ্রকার লুকিয়ে গাছগাতি মাহিদের বাড়ির সামনে পৌঁছে। মিনি আর মাহিকে বাইরে রেখে ভেতরে যায় মতি, চেয়ারম্যান সাব আছেন নাকি? হাঁক শুনে ভেতর থেকে বেরিয়ে আসেন চল্লিশোর্ধ একজন মানুষ। মাহি ছেলেটার সাথে চেহারার বেশ মিল। চোখ, মুখ....

- কে আপনি?

- আমি মতি স্যার। আমাকে চিনবেন না, সাত মাইল দূর থেকে আইছি।

- কী করেন?

- মাছ মারি। মধুমতির জেলে, আমার বাপ দাদারাও মাছ আর নদী নিয়ে কারবার করতেন।

- ও, আচ্ছা। বলুন আমি কী করতে পারি। চেয়ারম্যান সাহেবের কথা বলতে ভালো লাগছে না, চেহারায় তার প্রতিচ্ছবি দেখা যায়।

- আপনার কি মন খারাপ স্যার?

- হ্যাঁ।

- কেন?

কণ্ঠ থেকে বড় একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়, ‘ আমার একটাই ছেলে মাহি। গ্রামের এক বদমাশ তাকে হত্যা করে নদীতে ফেলে দিয়েছে? অনেক খোঁজাখুঁজির পরও লাশটা পেলাম না।’ কথার সাথে সাথে আবেগ তাকে গ্রাস করে। চোখের কোণে অশ্রুরা জমা হয়, ভর করে। কান্নার মতো করে বলেন, ‘ সন্তানের মরা মুখটাও দেখতে পারলাম না ’

মতি মনে মনে বলে, পারবেন স্যার, লাশটা ফিরে আসবে।

- বদমাশটা কে কি ধরতে পেরেছেন স্যার?

- হ্যাঁ, ঘটনার দিনই ধরা পড়েছে। হত্যার কথা স্বীকারও করেছে।

মতি ভেতরের সব কথা চেপে রাখে।

- কেন হত্যা করলো স্যার, অতোটুকু মানুষ কেউ মারে!

- মারে। মানুষ যখন রূপের মানুষ হয়, মনুষত্ব বিসর্জন দিয়ে পশু হয় তখন সে সবই পারে।

- তা ঠিক, পশু মানুষও আছে দুনিয়ায়।

- ওকে যে মেরেছে সে দূরের বা অপরিচিত কেউ নয়।

- জি। ঘাড় নাড়ে মতি।

- মাহি কে প্রাইভেট পড়াতো। প্রতিবেশী। ফাহিম নামের বদমাশটাকে ভালো বলেই জানতাম। ওর নোংরা বিকৃতরুচি বুঝে ওঠার আগেই খুনের স্বীকার হলো মাহি।

- ঠিক বুঝলাম না স্যার।

- সেদিন বিকেলে মাহি খেলা করছিল, ফাহিম ওকে ডেকে নিয়ে যায়।

- তারপর।

- ওর ভাষ্যানুযায়ী জোর করে মাহিকে দিয়ে যৌন লালসা মিটায়, মাহি চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করলে এক পর্যায়ে সে ওকে গলা টিপে হত্যা করে। লাশটা বস্তায় ভরে নদীতে ফেলে দেয়। অশ্রুসিক্ত হয় চেয়ারম্যানের দু'চোখ। অশ্রু ফোটা চোখ হয়ে গাল বেয়ে মাটিতে পড়ে।

- স্যার বাইরে আমার বউ দাঁড়িয়ে আছে, একটা ছেলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

- কেন!

- নদীতে একটা মানুষ পেয়েছি আমি। বস্তার ভেতর..... মতির কথা শেষ হয় না চেয়ারম্যান সাহেব কান্না জড়ানো গলায় বলে ওঠেন, কই কই! যদি আমার মাহি হয় শেষ দেখাটা দেখতে পাবো। দু'দিনে কি লাশটা পচে গলে গেছে? মতি এক কথায় জবাব দেয়, না।

বাইরে অনেক মানুষের গুঞ্জন শোনা যায়। সাথে সাথে সে ভিড় আর গুঞ্জন বাড়ির ভেতর প্রবেশ করে। মিনি আর মাহিকে একঝাঁক মানুষ একপ্রকার ধরে বেঁধে নিয়ে আসে। বয়সে তরুণ এক যুবক সামনে এসে কথা বলে, স্যার এই যে মাহি! মরেনি। ঘটনা তাহলে অপহরণ! বদ মহিলাটাকে আজ মেরেই ফেলবো.... চোখের সামনে জীবন্ত মাহিকে দেখে বুকের ভেতর সুখেরা ঝাঁক বেঁধে জমা হয়। আবেগ সামলে সামনে দাঁড়ানো যুবকসহ সবাই কে বলেন, কাকে মারবে! যারা হায়েনার নিষ্ঠুর পাশবিকতার গ্রাস থেকে মাহিকে বাচিয়ে আমার কোলে তুলে দিতে আসলো তাদের?

ভেতর থেকে এক মহিলা দৌড়ে আসেন। মাহিকে বুকের ভেতর জাপটে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকেন। মাহিও কাঁদে। দু'হাতে মাহির মুখ ধরে চিৎকার দেন, আমার মাহি ফিরে এসেছে। আমার মাহি বেঁচে আছে। মাহি.....মুহূর্তেই জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। চেয়ারম্যান সাহেব মতিকে বুকে টেনে বলেন, জেলে তুমি কী চাও বলো?

- কিছু চাই না স্যার।

- আমি দেব, সারাজীবন দেব। মতি অবাক হয়ে শুধু তাকিয়ে থাকে। সে তো বিনিময় বা প্রত্যাশার জন্য কিছু করেনি। মানুষ হিসাবে তার যে দায়বদ্ধতা সেটা করার চেষ্টা করেছে। সময়ের সাথে সাথে ভিড় বাড়ে, অনেক মানুষ। ভিড়ের ভেতর ভিন্ন ভিন্ন কথা ভাসে, মাহি মরেনি! দেখ, নিয়তি কাকে বলে!

লেখক: গল্পকার

সংবাদটি শেয়ার করুন

ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :