নতুন আইন

এবার কি শৃঙ্খলা ফিরবে সড়কে?

প্রকাশ | ২৭ অক্টোবর ২০১৯, ১১:৪৭

হাবিবুল্লাহ ফাহাদ

কদিন আগের কথা। গুলশান শুটিং ক্লাব থেকে চড়েছি হাতিরঝিলের চক্রাকার বাসে। গন্তব্য এফডিসি মোড়। সময় সকাল সোয়া ৯টার মতো হবে। বাসটি শুটিং ক্লাব থেকে ছেড়ে মেরুল বাড্ডার কোলঘেঁষে স্টপেজের কাছে এসে মাত্র কয়েক সেকেন্ডের জন্য থামলো। তখনো যাত্রীরা নামছে। যাত্রীদের নামা শেষ হওয়ার আগেই চালক আচমকা গাড়িটি টান দিল। নামার জন্য বাবার হাত ধরে দুয়ারে দাঁড়িয়ে ছিল চার কি পাঁচ বছরের একটি শিশু। সবে এক পা দিয়েছে নামার জন্য, অমনি গাড়িটি টান দেওয়ায় মেয়েটি উপুড় হয়ে রাস্তার পাশে পড়ে গেল। এ ঘটনায় বাসের যাত্রীরা হৈ-হৈ করে উঠলেও চালকের তাতে ভাবান্তর হলো না। এবার চালকের সহকারী দৌড়ে এসে গাড়িতে চড়তে চড়তে চালকের উদ্দেশে বললেন, ‘বাচ্চাটারে দেখবেন না ওস্তাদ?’

চালক তখন মাথা তুলে লুকিং গ্লাসে তাকিয়ে জবাব দিলেন, ‘বাচ্চার বাপ যদি বাচ্চারে না দেখে, আমি দেইখা কী করবো?’

এবার একজন যাত্রী বললেন, ‘আপনি তো গাড়িটা হঠাৎ টান না দিলেও পারতেন! খেয়াল করবেন না?’

এতেও বিন্দুমাত্র নমনীয় হলেন না চালক। বললেন, ‘এত খেয়াল রাইখা তো গাড়ি চালান যায় না।’

এবার চালকের সহকারী আবার বললেন, ‘বাচ্চাটা যদি আপনের হইতো ওস্তাদ?’

চালক এবার ধমক দিয়ে বললেন, ‘কথা কম ক। যাত্রী তোল।’

দুই.

গত বছরের ২৩ জুলাই। বিমানবন্দর সড়কে বাসচাপায় প্রাণ হারান রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থী আবদুল করিম ও দিয়া খানম মিম। ওই ঘটনা নাড়া দিয়েছিল গোটা শহরের ছাত্র-জনতাকে। সড়ক অবরোধ করে অপরাধী চালকের বিচার দাবিতে আন্দোলন হয়েছিল। ছাত্ররা নেমে এসেছিল রাস্তায়। সড়কে পরিবহনের শৃঙ্খলা ফেরাতে নিয়োজিত হয়েছিল স্বেচ্ছাসেবায়। ওই সময় তারা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল, চাইলে সুশৃঙ্খল সড়ক নিশ্চিত করা যায়।

তারপর বছর পার হয়েছে। সড়কে শৃঙ্খলা ফেরেনি। কয়েক দিন সবাই সতর্ক থাকলেও পরে যা তাই হয়েছে। প্রাণ গেছে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী আবরারের। তাও বেপরোয়া চালকের দায়ে।

প্রতিদিনই সড়কে দুর্ঘটনা ঘটছে। প্রাণহানি হচ্ছে। এই প্রতিবেদনটি যখন লেখা হচ্ছে, ২৫ অক্টোবর সকালে, তখন গণমাধ্যমে সদ্য খবর- ‘বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার রহবল এলাকায় বাস খাদে পড়েছে। এতে মারা গেছেন মা-মেয়েসহ তিনজন। আহত অন্তত ছয়জন।’

সড়ক দুর্ঘটনা একটি বড় ব্যাধি হয়ে দেখা দিয়েছে। এমন কোনো দিন নেই যে, সড়কে প্রাণ ঝরছে না। এত উদ্যোগ, এত সতর্কতা, আইনের এত কঠোর প্রয়োগই যদি হচ্ছে, তাহলে দুর্ঘটনা থামছে না কেন? কী সেই কারণ? চালকদের দাবি, দুর্ঘটনায় তাদের দায় নেই। তাহলে দায় কার? যাত্রী আর পথচারীদের?

এখন পর্যন্ত একটি দুর্ঘটনার পরও কি চালক স্বীকার করেছেন, দুর্ঘটনাটি তার দোষে হয়েছে? বরং দায় চাপাতে চেয়েছেন অন্যের ওপর। এই মানসিকতা চালকের সংশোধনের পথে অন্তরায়। এ কথা ঠিক যে, পরিবহন খাতে যারা চালক, চালকের সহকারী বা মেকানিক হিসেবে কর্মরত তাদের শিক্ষার যোগ্যতা বা পারিবারিক অবস্থা অতটা ভালো নয়। দারিদ্র্যের কশাঘাতে পিষ্টরা বাধ্য হয়ে এ পথে আসেন। কেউ স্বেচ্ছায়, ভালোলাগা থেকে কিংবা শখ থেকে এই পেশায় এসেছেন, এমন নজির থাকলেও সংখ্যায় অতি নগণ্য। চালকদের বেশির ভাগেরই শুরু হেলপার বা চালক সহকারী হিসেবে।

শুরু থেকেই তারা নানান প্রতিকূলতার মুখোমুখি হয়ে এ পেশায় থিতু হয়েছেন। অবজ্ঞা, অবহেলা, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনও পোহাতে হয়েছে কখনো কখনো। এতে ভালো আচরণ, প্রশিক্ষণ বা ইতিবাচক মানসিকতা গড়ে ওঠেনি তাদের মধ্যে। রূঢ়, রুক্ষ, নির্মম আচরণ তাদের হৃদয়কে পাষাণ করেছে। তারা ধরেই নিয়েছেন, ‘গাড়ির লাইনে’ ভালো ব্যবহার চলে না।

তিন.

বিদ্যমান সড়ক পরিবহন আইনে গুরু পাপে লঘুদণ্ডের অভিযোগ তুলে আসছিলেন সংশ্লিষ্টরা। এই আইনে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানিতে চালকের সর্বোচ্চ শাস্তি তিন বছর। এটি জামিনযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য। সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, মানুষ মারার মতো অপরাধে এত অল্প সাজা এবং জামিনের বিধান থাকাও চালকদের উদাসীনতার জন্য দায়ী। তারা জানে দুর্ঘটনায় মৃত্যু হলে শাস্তি খুব বেশি নয়। চাইলে জামিনও পাওয়া যাবে। এছাড়া লাইসেন্স ছাড়া গাড়ি চালালে এই আইনে ৬০০ টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে, যা বর্তমান বাজারে খুবই নগণ্য। ৫০০ টাকা জরিমানা গুনলে ট্রাফিক আইন অমান্যের মতো অপরাধ থেকে ক্ষমা পাওয়া যায়। এত লঘু শাস্তিও চালকদের মধ্যে ভীতি সঞ্চারে বা সতর্কতা তৈরিতে সহায়ক নয় বলে মনে করা হয়েছে। এর প্রেক্ষিতে নতুন সড়ক পরিবহন আইন প্রণয়নের দাবি উঠেছিল। নতুন সেই আইন হয়েছে। তবে এ জন্য অনেক ঘাত-প্রতিঘাত মোকাবেলা করতে হয়েছে। আইন অনেক আগে প্রণয়ন হলেও অদৃশ্য কারণে আট বছর ঝুলে ছিল।

গত বছরের জুলাইতে দুই কলেজ শিক্ষার্থীর মৃত্যুর পর গণআন্দোলনের মুখে ওই বছরের ৫ আগস্ট মন্ত্রিসভায় আইনটি অনুমোদন পায়। গত বছর ১৯ সেপ্টেম্বর সংসদে আইনটি পাস হয়। ওই বছর ৮ অক্টোবর এর গেজেট জারি করা হয়। তবে আইনে বলা হয়, সরকার আইনটি কার্যকরের তারিখ ঠিক করে এর প্রজ্ঞাপন জারি করবে।

এরপর শুরু হয় পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের আন্দোলন। তারা আইন পরিবর্তনের দাবিতে টানা ৪৮ ঘণ্টা ধর্মঘট পালন করে। পরে এ ব্যাপারে সরকার একটি কমিটি করে দেয়। কমিটি আইনে কিছু পরিবর্তনের সুপারিশ করে। কিন্তু সরকার আইন কার্যকরের আগে এসব সুপারিশ আমলে নেয়নি। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার পর আগামী ১ নভেম্বর থেকে সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮ কার্যকর হচ্ছে।

নতুন আইনে সাজা অনেকটাই বেড়েছে

নতুন সড়ক পরিবহন আইনে অপরাধের সাজা অনেকটাই বেড়েছে। সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানির দায়ে সর্বোচ্চ পাঁচ বছর শাস্তির বিধান রয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ‘দ-বিধির ৩০৪বি ধারায় যা-ই থাকুক না কেন, কোনো ব্যক্তির বেপরোয়া বা অবহেলাজনিত মোটরযান চালনার কারণে সংঘটিত কোনো দুর্ঘটনায় কোনো ব্যক্তি গুরুতরভাবে আহত বা নিহত হলে চালক সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবে।’

এছাড়া লাইসেন্স ছাড়া গাড়ি চালালে আগে যেখানে ৬০০ টাকা জরিমানা গুনতে হতো এখন সেটা ২৫ হাজার টাকা করা হয়েছে। অনাদায়ে সর্বোচ্চ ছয় মাস কারাভোগ। ভুয়া লাইসেন্স ব্যবহার করলে এক থেকে পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা গুনতে হবে। অনাদায়ে ছয় মাস থেকে দুই বছরের কারাদণ্ড। ট্রাফিক সংকেত ভঙ্গে বর্তমানে সর্বোচ্চ জরিমানা ৫০০ টাকা। নতুন আইনে জরিমানা গুনতে হবে সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা। রং সাইডে গাড়ি চালালেও একই পরিমাণ জরিমানা দিতে হবে। হেলমেট না থাকলে এখন জরিমানা ২০০ টাকা। নতুন আইনে জরিমানা সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা।

সড়ক বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, অতীতের চেয়ে এটি অনেক ভালো হয়েছে। যদিও সাজার পরিমাণ আরও বাড়ানোর ব্যাপারে তাদের সুপারিশ ছিল। তবে এই বিদ্যমান আইনের তুলনায় এটি অনেক শক্তিশালী। যদি এটি কার্যকর হয়, তাহলে চালক-শ্রমিকদের মধ্যে এর প্রভাব পড়বে। তারা নিশ্চয়ই আগের চেয়ে আরও সতর্ক হবে। যদি এই আইনটি শতভাগ নিয়মতান্ত্রিকভাবে কার্যকর করা যায়, তাহলে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।

সড়ক সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই আইন কার্যকরের পর পরিবহন চালক-শ্রমিক-মালিকরা আগের মতো আন্দোলনে নামতে পারে। অতীতেও তারা এ ধরনের কাজ করেছে। কোনো অপরাধে চালক বা শ্রমিকদের শাস্তি হলে তারা সেই শাস্তির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে। ধর্মঘট করে সরকার ও সাধারণ মানুষকে জিম্মি করার চেষ্টা করেছে। এই চেষ্টা যে ভবিষ্যতে হবে না, তা নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারবে না। বরং পরিবহন খাতের সংশ্লিষ্টরা মনেই করে, তাদের কাছে সারাদেশ জিম্মি। তাদের কিছু হলে তারা ধর্মঘটের ডাক দিবে। সারা দেশের পরিবহন ব্যবস্থাকে মুহূর্তের মধ্যে থমকে দিবে। এই ভয়ে তাদের কেউ সাজা দিতে পারবে না। তাদের এই অন্যায় চিন্তাধারায় পরিবর্তন আনতে সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আরও কঠোর হতে হবে।

চালক-শ্রমিক-মালিকদের বোঝাতে হবে, এই আইন তাদের ওপর বোঝা নয়, বরং নিরাপদ সড়ক নিশ্চিতের পথে সহায়ক হবে। সাধারণ মানুষের জানমাল রক্ষায় ভূমিকা রাখবে। নিয়ম বা আইন ভাঙার সংস্কৃতি থেকে আইন মানার সংস্কৃতি গড়ে তুলবে। এটি তাদের জন্যও ভালো।

নতুন এই আইনটি বলবৎ রাখার ব্যাপারে জোর দিয়েছেন সড়ক বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেছেন, পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের চাপে সরকারের উচিত হবে না, আইনটিতে ভবিষ্যতে কোনো পরিবর্তন আনা বা সাজা কমানো।

এ ব্যাপারে ‘নিরাপদ সড়ক চাই’-এর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, ‘আন্দোলন করে পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা বিদ্যমান আইনটিকে দুর্বল করে দিয়েছিল। তারা কিছু হলেই সরকারকে জিম্মি করে ফেলতো। এটি যেন ভবিষ্যতে না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘নতুন আইনটি কার্যকর হলে সড়কে শৃঙ্খলা ফিরবে বলে মনে করি। তাই কোনো ধরনের আন্দোলনের মুখে এটিকে যেন সংশোধন করা না হয়।’

(ঢাকাটাইমস/২৭অক্টোবর/এইচএইফ/জেবি)