অল্প সুখের ছোট্ট গল্প

প্রকাশ | ২৭ অক্টোবর ২০১৯, ২১:৪৯

অরুণ কুমার বিশ্বাস

চারুবাবু পদস্থ মানুষ। না না, নীতির সূত্রে নয়, চাকরি মারফত। চারুবাবু রাজনীতি করেন না, তিনি চাকরি করেন। বেশ রসালো চাকরি। উপরিটুপরি আছে আর কি। ইদানিং লোকের নজর এত নেমেছে যে, মেয়ের জন্য ছেলে খুঁজতে গিয়ে প্রথমেই জানতে চান চাকরি যাই হোক, ছেলের উপরি কামাই আছে কিনা। সেই অর্থে চারুবাবুর শাঁসালো চাকরি। তবে তিনি চৌকস নন বিধায় উপরি খেয়ে উঠতে পারেননি। তিনি সুখের অনুসন্ধান করেন। 

চারু বুঝতে পারছেন যে, অঢেল টাকায় সুখ নেই, খুব সুন্দরী দেখতে বউ হলেও নয়। কাজকাম ফেলে তাকে রীতিমতো পাহারা দিতে হয়, চোখে চোখে রাখতে হয়। নইলে হয়তো চালিয়াত গোছের অধিক মালদার কেউ এসে বউ ছিনিয়ে নিয়ে যাবে। ঘুড়ি ভোকাট্টা! সাধে কি আর বলে, প্রিটি লেডি ইজ নট অ্যা প্রবলেম, ওয়াইফ-ম্যানেজমেন্ট ইজ দ্য রিয়েল চ্যালেঞ্জ। 

আবার কেউ কেউ বলে, এসব ছাড়া জীবনটা নাকি স্রেফ পচা আলুর বস্তা। নারী-বাড়ি-গাড়ি-বিগ ব্যাংক ব্যলেন্স না হলে লাইফ ইজ আলুনি। একেবারে যাচ্ছেতাই। আদতে কি তাই? এই যে চারুবাবুর বন্ধু ফায়েজ, ডাকনাম ফজু- ‘কেমন আছো’ বললেই অমনি সে নিমতেতো গলায় বলে, না রে ভাই, ভালো নাই। এত এত প্রবলেম। মাথায় সবসময় ‘ঘুরন্টি’ মারে। 

অথচ চারু জানেন, চাকরিসূত্রে ফজু মেলা মালকড়ি কামিয়েছে। এখনও কামাচ্ছে। তার মাসের খরচ দশ লাখ। অথচ বেতন? মাত্র ষাট কি সত্তর হাজার। বাকি টাকা কোত্থেকে আসে! ওই যে, উপরি কামাই। এরপরও দেশ উচ্ছন্নে যাবে না তো কি সিঙ্গাপুর হবে! হয় কখনও!  

আসলেই ফজু ভালো নেই। কারণ শখ করে কেউ কাউকে উপরি টাকা দেয় না। হয় কাউকে বাঁশ দেবার ভয় দেখাতে নয়, নইলে ব্ল্যাকমেল করতে হয়। ফজু এই কাজে বিশেষ পারঙ্গম। সে নিজেই বলে, ভাই, আমি জীবনে একটাও হাচা কথা কই নাই। সব মিছা। ফজু উপরি নেয়, অথচ পরিবারে সময় দেয় না। বউ-ছেলেমেয়ে তারে জ্বালায়। তারা তো শুধু টাকা চায় না, ফজুকেও চায়। ফজু রাত জেগে কাজ করে, তারপর ঠেসে মালকড়ি নেয়। পাঁচটার পরে শুরু হয় তার আসল অফিস। নানাজনের কাছে হাত পাততে হয়। যারা উপরি নেয়, তাদের অবশ্য লাজলজ্জা একটু কম থাকে। নইলে কি আর ভিক্ষুকের মতো হাত পেতে টাকা চাইতে পারে!

সে যাক, ফজুর কথা বাদ। এবার চারুবাবুর কথা বলি। তিনি সোজাসাপটা মানুষ। ডিপার্টমেন্ট তাই তাকে খুব একটা পোঁছে না। একটু খেয়াল করে দেখবেন, পরিবারে, বাজারে বা চাকরিতে যারা নিরীহ তাদের মোটে ‘বেইল’ নেই। বস জানে, চারুর কারো ক্ষতি করার ‘খেমতা’ নাই। বস তাই তাকে ওয়েস্ট পেপারের মতো ফেলে রাখে। ভালো ভালো পদায়ন তারা পায়, যারা কিনা বসের বিশেষ মনোরঞ্জন করতে পারে। ফজু সেই কৌশল জানে। বস্তুত, সে অধিক সঙ্গমেও পারঙ্গম। লোকাল বাসে লেখা থাকে, নিজে বসুন, অপরকে বসতে দিন। ফজু সেই সহবত প্রয়োগ করে ভালো পোস্ট-প্রোমোশন পায়। মনে করে সে সুখে আছে, আদতে নেই। তারা নানা রকম অসুখ। হালে নাকি একটা বদরোগেও ধরেছে। পাছায় পাইলস। অন্যের পাছায় আর বাঁশ দেবে, ফজু!

চারুবাবু নটা পাঁচটা অফিস করেন। না না, তিনি কাজে ফাঁকি দেন না। দেবেন কী করে! তাকে তো গুরুত্বপূর্ণ কোনো কাজই দেয়া হয় না। কারণ তিনি উপরি আদায় করতে পারবেন না। তিনি অফিসে বসে বসে ভেরেণ্ডা ভাজেন। কী আর করবেন! কর্তার ইচ্ছায় কর্ম।

চারুর তাতে মনক্ষুণ্ন হবার কোনো কারণ নেই। তিনি সুখী মানুষ। ফ্যামিলি পারসন। দুই ছেলে-বউ নিয়ে সুখের সংসার। ছেলেরা নম্রভদ্র। বাপের কাছে দামি গিফট চেয়ে বা ফি-হপ্তায় চিনেখাবার খেতে চেয়ে তার কান ঝালাপালা করে না। চারু তাদের শিখিয়েছেন, বাইরের খাবার ভালো নয়। খেলে কোলাইটিসসহ আরো মেলা রোগ হয়। কারণ ওরা স্যানিটেশন জানে না। বাজে তেলে খাবার রান্না হয় ইত্যাদি। 

চারু নটরডেম কলেজে বারট্রান্ড রাসেলের বই পড়েছেন। কংকেস্ট অফ হ্যাপিনেস। সুখকে কীভাবে জয় করতে হয়। শুরুতেই ছিল একটা বাণী- প্লেন লিভিং, হাই থিংকিং। অর্থাৎ সাধারণ জীবনযাপন করা সুখী হবার প্রথম ও প্রধান উপায়। অন্যের সঙ্গে তুলনা করেছ কি মরেছ। অমুকের এটা আছে, আমার নেই। তার বউ অত্যধিক সুন্দরী, আমার বউয়ের নাক বোঁচা। বন্ধুর ছেলে মেধাবী, আমারটা চলতি মান। শমুকের বড় চাকরি, আমি কেরানি। সে গাড়িতে চড়ে, আমি লোকাস বাস। আরে ভায়া, পোরশে বা হ্যামারে চাপলেই কি আর হার্টে রিং পরানো ফিরবে! নাকি তার চালকের সাথে ভেগে যাওয়া বউ আবার ফিরে আসবে! আসবে না। দামি গাড়ি মোটেও সুখের নিশ্চয়তা দেয় না। তাতে ক্যানসারও সারে না। অতএব মানুষের সঙ্গে মিশুন, নিয়মিত হাঁটুন। রিকশা চড়ে বাতাস খান। দেখবেন জীবন জমে যাবে।  

চারুবাবুর মেলা টাকা নেই, তবে সুন্দর একটা ফ্যামিলি আছে। তার চিন্তাও কম। উপরি কামাই কোথায় লুকোবেন এই নিয়ে তার ঘুম হারাম হয় না। খেয়াল করে দেখবেন যারা সাধারণ ও গরিব, তারা যেখানে সেখানে ঘুমিয়েই অমনি নাক ডাকাতে শুরু করে। তাদের কষ্ট করে সিডেটিভ খেতে হয় না। নাকে সর্ষেতেলও ঢালতে হয় না। ঘুম। ইয়েস, সুখের অন্যতম সূচক। রাতে ঘুম না হলে তাকে আর যাই হোক, সুখী মানুষ বলা যাবে না। বেশি মালদাররা যুতমতো ঘুমোতে পারে না। টাকার চিন্তায় তাদের ঘুম আসে না। ব্লাকমানি ম্যানেজ করতে হিমশিম খায়।

চারুবাবু অফিস থেকে ফিরে হাতমুখ ধুয়ে ছেলেমেয়ের সঙ্গে বসেন। ওদের পড়ালেখার খোঁজ-খবর নেন। ছোটোটাকে আদর করেন, চটকান, কষে ডলাডলি করেন। সে খিলখিল করে হাসে। অপার বিস্ময়ে চারুবাবু ছেলেকে হাসতে দেখেন। আহ! এরচে বড় সুখ আর কী হতে পারে! বড়টাকে কিছু উপদেশটেশ দেন। সে একটু লাজুক। বাবার দিকে সে এমনভাবে তাকায়, চারুবাবু বুঝে যান ছেলেটা তাকে খুউব ভালোবাসে। দিস ইজ হেভেনলি। কোটি টাকায়ও এই অনুভূতি হয় না।

ইত্যবসরে বউ কফি করে আনেন। চারুর বউও চাকরি করেন, তবে তিনি টাকা ওড়ান না। শাড়িচুড়ি গয়নার উপর তার লোভ নেই। ভাল ঘরের মেয়ে কিনা। জাতের মেয়ে কালোও ভালো, জানেন তো। খালি কতগুলো ফর্সা হলেই হয় না। খড়িমাটির মতো। তার মন পরিষ্কার কিনা, রুচি পরিচ্ছন্ন কিনা, দেখতে হবে।

তারপর হাঁটতে বেরোন চারুবাবু। দৈনিক অন্তত একঘণ্টা জোরে হাঁটা চাই তার। যাকে বলে ব্রিস্ক ওয়াক। এটা নিয়মিত করলে হার্ট ভালো থাকবে। হাঁটার পথে তিনি নিজে দেখেশুনে কাঁচা বাজার করেন, দেশি হাঁসের ডিম কেনেন, পাকা এবং কাঁচা দুরকম পেঁপে কেনেন। মোটকথা পরের মুখে ঝাল খেয়ে তিনি অভ্যস্ত নন। যা করার নিজেই করবেন। তাতে তার ইজ্জত যায় না। কুচো চিংড়ি দিয়ে পুঁইশাক, শোল মাছের সাথে ডগডগে লাউ- আহ্ স্বর্গ!

চারুগিন্নি নিজে সেসব রান্না করেন। কষ্ট হয়, তাও করেন। নিজের পরিবার বলে কথা। এমন স্বাদের খাবার কি আর পাঁচ তারকায় মেলে! ছুটা বুয়া আছে, তবে তার কিচেনে ঢোকা বারণ। কারণ সে স্যানিটেশন জানে না। নানান রাগের জীবাণু এনে খাবারে মিশিয়ে দেবে। তাতে অসুখ হবে, গচ্ছা যাবে চারুবাবুর। তারচে বাপু একটু মানিয়ে গুছিয়ে নাও, তোমারই তো সংসার, নাকি! ছেলেপুলে ভালো থাকলে, সুস্থ থাকলে কার লাভ, তোমার নয়! বউকে টুক করে খানিক খাঁটি ইয়ে মানে ওলিটেলিয়া মালিশ করেন চারুবাবু। তার সাফ কথা, তেল মারলে নিজের পরিবারকে মারবো, অন্যকে নয়। তার উপরি কামাই কিংবা পদের দরকার নাই। সরকার এমনিতেই তাকে বেশ ভালো রেখেছে। সরকারকে লাল সেলাম! লোভের মুলো চারু গিলিবেন না।

হিসাব কষে দেখলেন, চারুবাবু সত্যি সুখী মানুষ। বেশ সুখী তিনি। তিনি ধার দেন না, আবার নেনও না। শেক্সপিয়রের উপদেশ। তবে তিনি মানুষের ভালো চান। টুকটাক হেল্পও করেন। তিনি লেখেনটেখেন। একজন বাজে লোকের লেখা পাঠক কেন পড়বে! তাই লেখককে ভালোমানুষ হতে হয়। সর্বাংশে। 

তিনি নিয়মনিষ্ঠ মানুষ। সময় মেপে চলেন। টাইমলি ঘুমাতে যান। মিনিট তিনেকেই গভীর ঘুমে তলিয়ে যান চারুবাবু। কারণ তার কোনো বাজে চিন্তা নাই। কাউকে ঠকানো তার ধাতে নেই। তিনি বিশ্বাস করেন, মানুষ চাইলেও খুব উপরে উঠতে পারে না। যদি না তিনি মানুষ ভালো হন। বা উঠলেও তা টিকবে না। ফলে টেকসই সুখ তার কপালে জুটবে না। চারুবাবু প্রচুর হাসেন, প্রচুর ছোটাছুটি করেন। কেউ কেউ আছে দেখবেন, সবসময় গুরু-গম্ভীর ভাব, যেন মহা দার্শনিক তিনি। তার পাণ্ডিত্যের সীমা নেই। চারুবাবু মনে করেন, মানুষ স্বভাবতই নির্বোধ। সে জানেই না, কীসে তার ভাল হবে। সুখ বেচে টাকা কামায় মানুষ। মানুষ হামবড়া ভাব দেখায়, আবার অকারণ উল্লম্ফন করে। কূপমণ্ডূক টাইপ লোকেরই এমন করে।

এসব ভেবে তিনি মিটিমিটি হাসেন। এটাই তার সুখের লক্ষণ। বস্তুত, তিনি সুখী হতে জানেন। নিজে সুখী ফিল না করলে কেউ বস্তাভর্তি সুখের চালান এনে আপনার ঘরে রেখে যাবে না। কাড়ি কাড়ি টাকা দিলেও না। সবশেষ কথা, টাকা আর সুখ পরস্পর সাংঘর্ষিক। চারুবাবুর হিসাবে যার যত টাকা, সে তত অসুখী। যার মন যত বড় ও সহজসরল, সেই তত সুখী। কথা কিলিয়ার! হে হে হে!

লেখক: কথাসাহিত্যিক ও অতিরিক্ত কমিশনার, বাংলাদেশ কাস্টমস