প্রধানমন্ত্রীর হুঁশিয়ারি ও জনপ্রত্যাশা

সারওয়ার-উল-ইসলাম
| আপডেট : ২৯ অক্টোবর ২০১৯, ১৫:৪৩ | প্রকাশিত : ২৯ অক্টোবর ২০১৯, ১৫:৩৩

‘আমার আত্মীয় হোক আর যে-ই হোক, অপকর্ম করে কেউই কোনো ছাড় পাবেন না।’ গত ২০ অক্টোবর গণভবনে যুবলীগ নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে কথাগুলো বলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কতটা সংক্ষুব্ধ হলে এ কথা বলতে পারেন একজন প্রধানমন্ত্রী, তা সহজেই অনুধাবন করা যায়।

ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানে একের পর এক যুবলীগ নেতাদের অপকর্ম প্রকাশ্য হওয়ার পর বেশ অহমিকার সঙ্গে মিরপুরে এক আলোচনা সভায় যুবলীগের চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরী ডান হাতের বুড়ো আঙুল মুখের কাছে নিয়ে শিষ্টাচার বহির্ভূতভাবে বলেছিলেন, গোয়েন্দা সংস্থারা কি আঙুল চুষছিলেন? এরপর বেশ জোর দিয়েই বলেছিলেন, আমরাও বসে থাকব না।

এই হচ্ছে একজন সত্তরোর্ধ্ব যুবলীগ নেতার অহমিকা প্রকাশ। তিনি সরকারের চেয়ে অনেক শক্তিশালী সংগঠনের যেন হর্তাকর্তা। ইচ্ছে করলেই সরকারের আসন নাড়িয়ে দিতে পারেন, তছনছ করে দিতে পারেন সরকারের গদি। এমনটাই ফুটে উঠেছে তার সেদিনের কথাবার্তায়, যারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বা টেলিভিশনে দেখেছেন, নিশ্চয়ই একমত হবেন সবাই। তার কথায় অনেকের মনে হয়েছে এই যুবলীগই সরকারকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রেখেছে। নইলে কবেই পড়ে যেত আওয়ামী লীগ সরকার।

এই যে তার অহমিকা প্রকাশ, এর কারণ মনে করেছেন তিনি তো শেখ পরিবারের জামাই। তার টিকিটি ধরার সাহস পাবে না কেউ। সুতরাং যা মুখে আসে তা বলবোই। কে কি বলবে আমাকে?

তার এই অহমিকা প্রকাশ সরকারের ভাবমূর্তি কতটা ক্ষুণœ করেছে তা বোঝার মতো সাধারণ জ্ঞানটুকু যদি থাকতো তা হলে বলতেন না। যারা সাধারণ মানুষ তারা ভেবেই নিয়েছে শেখ পরিবারের সদস্য বলে তিনি হয়তো পার পেয়ে যাবেন। কারণ তা না হলে এভাবে বলার সাহস উনি পেলেন কোত্থেকে? যেহেতু জামাই মানুষ, সুতরাং তাকে কিছু বলা হবে না। কিন্তু হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রক্ত যার ধমনীতে বহমান সেই প্রধানমন্ত্রী এত সহজেই ছাড়ার পাত্রী নন।

আরেকটি বিষয়, ওমর ফারুক চৌধুরী নিজেই নিজের কথাবার্তায় ধরা খেয়েছেন। তিনি যে সম্রাট বা খালেদদের কাছ থেকে চাঁদাবাজির ভাগ পেতেন তা তার বক্তব্যে পরিষ্কার করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ১৮ সেপ্টেম্বর ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরুর পর থেকেই পদবাণিজ্য ও দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থ অর্জনের অভিযোগে অভিযুক্ত ওমর ফারুক চৌধুরী সমালোচনার মুখে পড়ে। তার ব্যাংক হিসাব তলব করার পাশাপাশি বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞাও আরোপ করা হয়। এরপর থেকেই ওমর ফারুক চৌধুরী লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যান।

১১ অক্টোবর তাকে ছাড়াই বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউর কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে জরুরি বৈঠক করেছে প্রেসিডিয়াম সদস্যরা। সে বৈঠকে ওমর ফারুকের ক্যাশিয়ার হিসেবে পরিচিত সংগঠনের দপ্তর সম্পাদক কাজী আনিসুর রহমান আনিসকে বহিষ্কার করা হয়।

ওমর ফারুক চৌধুরীর বিরুদ্ধে রয়েছে অনেক অভিযোগÑ ২০১২ সালে চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পান। সেই হিসেবে ২০১৫ সালে কংগ্রেস হওয়ার কথা থাকলেও তা হয়নি। তার কারণেই কংগ্রেস হয়নি এমন অভিযোগ রয়েছে যুবলীগ নেতাদের।

প্রধানমন্ত্রী কতটা ক্ষুব্ধ তার প্রমাণ পাওয়া গেছে ২০ অক্টোবরের বৈঠকে ওমর ফারুক চৌধুরীসহ শেখ ফজলুর রহমান মারুফ, নুরুন্নবী চৌধুরী শাওন, আতিউর রহমান দিপুকে গণভবনে ঢোকায় নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছিল। তাই তারা ঢোকার সুযোগ পায়নি। ওই বৈঠকে ওমর ফারুক চৌধুরীকে সংগঠন থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।

প্রধানমন্ত্রী বলেছেন যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে তাদের সবাইকে অব্যাহতি দেওয়া হবে।

প্রধানমন্ত্রীর এমন নির্দেশ আমাদের মনে আশা জাগায়। পাশাপাশি এরকম প্রশ্নও জাগে শুধু ঢাকা শহর না, সারা দেশেই যুবলীগ নেতাদের যে দুর্নীতি, তার কতটুকুই জানা যাবে বা প্রধানমন্ত্রী জানার সুযোগ পাবেন?

সারা দেশেই যুবলীগের নেতাদের যে দখল-চাঁদাবাজির দৌরাত্ম্য তা বন্ধ করার কি ব্যবস্থা আছে। একেকজন নেতা শত কোটির টাকার মালিক বনে গেছে গত ১০-১১ বছরে। তারা কি এত সহজেই এ পথ থেকে ফিরে আসবে? তাদের পৃষ্ঠপোষক কি শুধু এক ওমর ফারুক চৌধুরী? ওমর ফারুক চৌধুরীর মতো অনেক মুরব্বি আছে তাদের, যারা তাদের মাথার ওপর ছাতা হিসেবে কাজ করে। ঢাকায় বসে চুপচাপ কামিয়ে নেয় কোটি কোটি টাকা। যার ছিটেফোঁটাও টের পায় না সাধারণ মানুষ। শুধু ঢাকার বাইরে কেন? ঢাকার এমন অনেক জায়গা আছে, যেখানে রাস্তাঘাট দখল করে বাজার বসিয়ে মাসে মাসে কোটি কোটি টাকা কামিয়ে নিচ্ছে স্থানীয় সংসদ সদস্যদের ছাতার নিচে বসে থাকা ওয়ার্ড কাউন্সিলররা। শুধু এক-দুজন পাগলা মিজান আর রাজীবকে ধরলেই কি শেষ হয়ে যাবে?

ঢাকার প্রতিটি ওয়ার্ডের কাউন্সিলররা নিজের ওয়ার্ডের যেখানেই খালি জায়গা পেয়েছে সেখানে দোকান তুলে ভাড়া দিয়েছে। নিজে কখনো সেখানে গিয়ে চাঁদা তোলে না ঠিক, কিন্তু তার নিয়োজিত লোকজন প্রতিদিন সন্ধ্যায় গিয়ে টাকা তুলে নিয়ে আসে।

মিরপুরের অনেক যুবলীগ নেতার বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, কিন্তু তাদের ব্যাপারে কোনো খবর আজ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। তারা কি সবাই ধোয়া তুলশি পাতা? মিরপুর ১০ নম্বর থেকে পশ্চিমে গেছে ২ নম্বর। উত্তরে গেছে ১১ নম্বর। পূর্ব দিকে গেছে ১৩ এবং ১৪ নম্বর। দক্ষিণে গেছে কাজীপাড়া- শেওড়াপাড়া। এসব এলাকার ফুটপাত দিয়ে সন্ধ্যার পর হাঁটা মুশকিল। ফুটপাত দখল করে কয়েক হাজার দোকানপাট বসানো হয়েছিল। মাসে কোটি কোটি টাকা চাঁদা ওঠানো হতো। মিরপুর ১০ নম্বরের হোপ স্কুলের চারপাশ দিয়ে হাঁটা যেত না। ফুটপাত দখল তো হতোই, এমনকি রাস্তার ওপর বাঁশ গেড়ে দোকান তুলে স্থানীয় ওয়ার্ড কমিশনারের লোকজন মাসে প্রায় তিরিশ লক্ষাধিক টাকা চাঁদা ওঠাতো, এমন অভিযোগও রয়েছে। ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের পর সেই দোকানপাট কখনো বসে আবার উঠে যায়। শুধু এই জায়গা নয়, মিরপুরসহ ঢাকার অনেক জায়গার ফুটপাত দখল করে যারা চাঁদা তুলতো তাদের ধরার ব্যাপারে কোনো তৎপরতা দেখা যাচ্ছে না।

আগে যেসব এলাকায় ফুটপাত বসতো, এখন বসছে আবার উঠে যাচ্ছে, এই দিয়েই কি প্রমাণ হয় না, কারা এখানে দোকান বসিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে? এর জন্য গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন প্রয়োজনের কোনো দরকার পড়ে কি? যারা একেকজন কোটি কোটি টাকা কামিয়ে এখন পায়ের ওপর পা তুলে দেখছে সম্রাট-খালেদদের কোর্টে নেওয়া হচ্ছে আবার রিমান্ডে নেওয়া হচ্ছে, এসব দেখে যারা বেশ মজা পাচ্ছে তাদেরও ব্যাংক হিসাব তলব করা দরকার। তা না হলে এরাই আগামীতে যখন এই অভিযান একটু ঝিমিয়ে পড়বে, তখন আবার ফুটপাত দখল করে সরকারি খালি জায়গা দখল করে দোকানপাট বসাবে। এরা সব সময় থাকবে ধরাছোঁয়ার বাইরে। ঢাকার প্রত্যেক ওয়ার্ড কাউন্সিলরের ব্যাপারে গোয়েন্দা সংস্থার নজরদারি বাড়াতে হবে। কারণ গত দিনে তারা যে অবৈধভাবে কোটি কোটি টাকা কামিয়েছে তা কোথায় পাচার করেছে তার হিসাব নেওয়াও প্রয়োজন।

যুবলীগের দুর্নীতিবাজদের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর যে জিরো টলারেন্স নীতি, এ জন্য তাকে অভিবাদন। তিনিই পারবেন কঠিন হতে। কারণ তার কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই। তিনি জানেন তার আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে কারা কারা দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত। আর জানেন বলেই তাদেরকে ক্ষমতা থেকে আস্তে আস্তে সরিয়ে দিয়েছেন।

আগামী ২৩ নভেম্বর যুবলীগের কংগ্রেসকে সামনে রেখে ইতিমধ্যেই দৌড়ঝাপ শুরু হয়ে যাবে। প্রধানমন্ত্রী মনে করেছেন যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য চয়ন ইসলাম একজন ক্লিন ইমেজের মানুষ, তাকে কংগ্রেস আয়োজনের প্রস্তুতি কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছে। পাশাপাশি সাধারণ সম্পাদক হারুনুর রশীদকে করা হয়েছে সদস্যসচিব।

এই কংগ্রেসেও প্রধানমন্ত্রী তাঁর বিচক্ষণতার পরিচয়টি দেবেন। যারা প্রকৃতপক্ষেই কাজের মানুষ, দলের ভাবমূর্তি অক্ষুণœ রেখে কাজ করে যাবেন, তেমন মানুষই খুঁজে বের করে পদে বসাবেন। যারা আগামী বাংলাদেশকে আরো এগিয়ে নিয়ে যাবেন জাতির জনকের স্বপ্নের সোনার বাংলা হিসেবে। তেমন সুস্থ এবং ক্লিন ইমেজের মানুষের সমন্বয়ে গড়ে উঠুক যুবলীগের কমিটি, কোনো অঘটন ছাড়া। প্রধানমন্ত্রীর কাছে সাধারণ মানুষের এমনটাই প্রত্যাশা।

লেখক: সাংবাদিক

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :