হাসু-কাসুতে বিপর্যস্ত আদাবর-শেখেরটেক

প্রকাশ | ৩০ অক্টোবর ২০১৯, ০৮:২১ | আপডেট: ৩০ অক্টোবর ২০১৯, ১০:৫৭

কাজী রফিক, ঢাকাটাইমস

২০১২ সালে আদাবর থানা ছাত্রলীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক রিয়াজ মাহমুদের ওপর হামলা করে আদাবর থানা আওয়ামী লীগের তৎকালীন নেতা আবুল হাসেমের (হাসু) নেতৃত্বাধীন সন্ত্রাসী বাহিনী। ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে জখম করা হয় রিয়াজকে। আশঙ্কাজনক অবস্থায় দীর্ঘদিন চিকিৎসাধীন থাকার পর প্রাণে রক্ষা পান তিনি।

এ হামলার ঘটনায় ক্ষুব্ধ স্থানীয় আওয়ামী নেতাকর্মীরা মোহাম্মদপুর-আদাবর ও গণভবন এলাকায় রিয়াজের ছবিসহ পোস্টার লাগালে বিষয়টি দলের নেতাদের নজরে পড়ে। দল থেকে বহিষ্কার করা হয় আদাবর থানা আওয়ামী লীগের তৎকালীন নেতা আবুল হাসেম (হাসু) এবং তার বড় ভাই আবুল কাসেমকে (কাসু)।

২০১৫ সালে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) নির্বাচনে ৩০ নম্বর ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে মনোনয়ন দেয়া হয় আরিফুর রহমান তুহিনকে। তার বিপরীতে অবস্থান নেন বহিষ্কৃত নেতা হাসু এবং তিনি জয় লাভ করে কাউন্সিলর হন।

আওয়ামী লীগের তৃণমূলের কর্মীদের সূত্রে জানা যায়, নির্বাচনের দিন আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীর নেতাকর্মীদের কেন্দ্র থেকে বের করে দেয় হাসুর ক্যাডার বাহিনী। এমনকি ঘটনা আড়াল করতে নিজের কর্মীদের গলায় ঝুলিয়ে দেন আওয়ামী লীগের প্রার্থীর প্রতীক।

এলাকাবাসীর অভিযোগ, কাউন্সিলর নির্বাচিত হওয়ার পর আদাবর-শেকেরটেক এলাকার একনায়ক বনে যান হাসু। ভাইয়ের ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে দখলদারি কায়েম করতে শুরু করেন কাসু।

তাদের ভয়ে এত দিন মুখ খুলতে পারেনি এলাকার মানুষ। সরকারের ক্যাসিনোবিরোধী ও শুদ্ধি অভিযানের শুরু থেকে হাসু-কাসুর বিরুদ্ধে মুখ খুলতে শুরু করেছেন তাদের দৌরাত্ম্যে সর্বস্বান্ত হয়ে যাওয়া অনেকে। উঠে আসে তাদের নানা অপকর্মের চিত্র।

হাসু-কাসুর দৌরাত্ম্যের শিকার মনসুরাবাদ এলাকার বাসিন্দা বাবুল মিয়া। ঢাকা টাইমসকে তিনি বলেন, কাউন্সিলর নির্বাচিত হওয়ার পর হাসুর নজর পড়ে তার মনসুরাবাদ ১০ নম্বরের একতলা বাড়ির দিকে। নিজের সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে বাড়িটি দখলে নেয়ার চেষ্টা করেন হাসু। বাধা দিলে সন্ত্রাসীদের দিয়ে কুপিয়ে জখম করা হয় বাবুল মিয়াকে।

দীর্ঘদিন চিকিৎসার পর কোনোভাবে প্রাণে রক্ষা পান তিনি। আর জমি রক্ষা পায় গণমাধ্যমের কল্যাণে।

বাবুল বলেন, ‘আমারে তো কোপাইয়া কিছু রাখে নাই। চল্লিশটা কোপ দিছে। আল্লাহ বাঁচাইছে। পত্রপত্রিকায় নিউজ হওয়ার কারণে আমার বাড়িটা আর দখল করতে পারে নাই তারা।

বাবুল মিয়ার ওপর হামলার ঘটনায় তার স্ত্রী মামলা করেছিলেন। কিন্তু কিছুই হয়নি বলে অভিযোগ করেন তিনি।

নিজের বাড়ি রক্ষা পেলেও চার বছর ধরে হাসু-কাসুর দখলে বাবুলের শ্বশুরের জমি। মনসুরাবাদ মসজিদের পশ্চিম পাশে আক্তার প্রোপার্টিজের আগের জমিটা তার শ্বশুরের। ১১ শতাংশ জমিটি দখলে বাধা দেয়ায় একইভাবে কুপিয়ে জখম করা হয়েছে বাবুলের শ্যালক আবু জাফর তানমেসকে। মাথায় কোপ লাগার কারণে ঘটনার পর থেকে মানসিক ভারসাম্যহীন অবস্থায় আবু জাফর। বর্তমানে তিনি শেরেবাংলা নগরের জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। এ বিষয়ে একটি মামলা দায়ের করা হয়। মামলা নম্বর ৩১।

শেখ মোহাম্মদ আলী হোসেন নামের এক ভুক্তভোগী জানান, কাউন্সিলর সলু (সাবেক কাউন্সিলর), রতনরা (বর্তমান ২৯ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর) মামলা দিয়েছে। তারা ন্যাশনাল হাউজিং লিমিটেডের মাধ্যমে জমি দখল করে নিয়েছে।

শেকেরটেক ৬ নম্বর সড়কের পশ্চিম মাথায় রামচন্দ্রপুর মৌজার ২০৯ নং দাগের ১৯০ শতাংশ দখল করে রেখেছে। যার ৯০ শতাংশে বহুতল ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। বাকি ১৩০ শতাংশ খালি পড়ে রয়েছে। এ ছাড়া ২০৩ নং দাগের ৬৪ কাঠা জমি দখল করে রেখেছে হাসু-কাসু সিন্ডিকেট।

এ বিষয়ে মামলা হলে একটি মামলার রায় বাদী আলী হোসেনের অনুকূলে আসে। অপরটি বিচারাধীন রয়েছে।

আলী হোসেন জানান, খোকন, মুজা হাজি, সাদেক হোসেনসহ কাউন্সিলরের একটি সিন্ডিকেট রয়েছে। তাদের মাধ্যমে জমি দখল এবং তা ভোগ করে আসছে এই কাউন্সিলর।

শেখ আলী হোসেন বলেন, ‘আমার দাদা-পরদাদাদের নামে এই এলাকা। আমরা এই এলাকা থেকে মণকে মণ ধান পাইতাম। আজ আমরা না খাইয়া থাকার অবস্থা। এই হাসু সাবেক এমপি মকবুলের সঙ্গে চলত। এদের কত টাকা আছে, তারা নিজেরাও জানে না।’

শেকেরটেকের মফিজ হাউজিংয়ের ইয়াসিন আলীর সাত কাঠা জমি, আদাবর এলাকার হারুন ও কামাল নামের দুই ব্যক্তির ৫৬ কাঠা, একই এলাকায় শাওন ট্রেডার্স নামের একটি দোকান ভোগদখল, আদাবরের ১০ নম্বর সড়কের পাঁচ কাঠার প্লট, শেখেরটেকের ৭ নম্বর রোডের তিন কাঠার প্লট, বায়তুল আমান হাউজিং সোসাইটিতে আট ও ১০ কাঠার দুটি প্লট, উত্তর আদাবরের আজিজ গার্মেন্ট নামের ছয়তলা ভবনসহ অনেক বাড়ি ও জমি দখলের অভিযোগ এই দুই ভাইয়ের নামে। এ ছাড়া আরও অনেক ভুক্তভোগী থাকলেও তাদের অনেকেই হাসু-কাসুর ক্যাডার বাহিনীর ভয়ে মুখ খুলতে রাজি নন।

এদিকে নিজের ওয়ার্ডের বাইরেও হাসুর বিরুদ্ধে রয়েছে দখলের অভিযোগ। মোহাম্মদীয়া হাউজিং লিমিটেডের ৭ নম্বর সড়ক এলাকায় হাসু-কাসুর বেশ কিছু পৈতৃক সম্পত্তি রয়েছে। এসব জমি ডানে-বামে বাড়িয়ে মূল সম্পদের দ্বিগুণ করার অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। দখল করেছেন সেখানকার রামচন্দ্রপুর পয়োনিষ্কাশন খালের একাংশ। এরই মধ্যে সেসব জমি একে একে বিক্রি করতে শুরু করেছেন তারা।

দখলের জমি দ্রুত বিক্রি করে দেওয়া তাদের একটি কৌশল বলে জানান ভুক্তভোগীরা। তারা জানান, হাসু-কাসু দখল করা জমি নিজেরা ধরে রাখেন না। বরং জমি দখলের পর দ্রুত সময়ের মধ্যে বিক্রি করে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন।

২০১২ সালে হাসু বাহিনীর হামলার শিকার হওয়া আদাবর থানা ছাত্রলীগের সভাপতি রিয়াজ মাহমুদ দুই ভাইয়ের নৈরাজ্যের বর্ণনা দিয়ে বিচারের দাবি জানান।

ঢাকা টাইমসকে রিয়াজ বলেন, ‘আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কার হয়ে নিজের ক্যাডার বাহিনী দিয়ে সে পুরো এলাকা জিম্মি করে রাখতে চাচ্ছে। ক্ষমতার অপব্যবহার করে অনেক মানুষের জমি দখল করেছে। আমার মতো অনেকের ওপর হামলা করেছে। আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে এর বিচার দাবি করছি।’

নিজের বিরুদ্ধে ওঠা সব অভিযোগ মিথ্যা বলে দাবি করেন কাউন্সিলর  আবুল হাসেম (হাসু)। ঢাকা টাইমসকে তিনি বলেন, ‘আমার বিপক্ষে যারা নির্বাচনে হেরেছিল, তারা এসব ছড়াচ্ছে। এগুলো রাজনৈতিক কারণে করা হচ্ছে। আপনারা খোঁজ নিয়ে দেখেন, যাদের মধ্যে ভয় আছে, যারা অপরাধ করেছে, তারা কেউ এলাকায় নেই। আমি আছি।’

(ঢাকাটাইমস/৩০অক্টোবর/কারই/মোআ)