আওয়ামী লীগে নারীদের উত্থান-পতন!

সোহেল সানি
| আপডেট : ৩১ অক্টোবর ২০১৯, ১২:৪৫ | প্রকাশিত : ৩১ অক্টোবর ২০১৯, ০৮:৪৬
সোহেল সানি (ফাইল ছবি)

আশির দশকের শুরুতে নেতৃত্বের চরম সংকটের মুখে আওয়ামী লীগে নারী নেতৃত্বের হাতে অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার হাতে আসে। পরবর্তী সময়ে দল ও সরকার পরিচালনায় শেখ হাসিনার সুবিশাল ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তাঁর প্রায় চার দশকের শেষ দেড় দশকে দলে ও সরকারে নারীদের উত্থান অকল্পনীয় ও দারুণ চমকের।

বর্তমান সময় বাদ দিলে অতীত চিত্র অর্থাৎ স্বাধীনতাপূর্ব সময়ে আ.লীগের নারী নেতৃত্ব কার্যত হতাশাব্যাঞ্জক। কিন্তু অতীতে দু-চারজন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে স্থান পেলেও তাঁদের অধিকাংশই বিতর্কিত ভূমিকার কারণে দল থেকে ছিটকে পড়েছেন। আবার কেউ কেউ দলত্যাগ করে চরম প্রতিপক্ষ দলে গা ভাসিয়েছেন। এসব ঘটনা ঘটেছে বঙ্গবন্ধুর জীবদ্দশায়ই।

বঙ্গবন্ধুর হত্যার পরে এদের দুএকজন দলত্যাগ করে মন্ত্রী কিংবা নেত্রী হয়েছেন। অবশ্য তারা জাতীয় রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠালাভ করতে পারেননি। এ প্রজন্মের কাছে বিশেষ পরিচিতিও গড়ে ওঠেনি গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকার অভাবে। আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠালাভের পর থেকে গত ৭০ বছরে নারীদের উত্থান-পতনের গল্প লিপিবদ্ধ করার চেষ্টা করা হলো।

দলটির গত সাতটি দশকের মধ্যে দেখা যায়, দেশের প্রথম দুই দশকই রচিত হয়েছে আওয়ামী লীগের ইতিহাস দিয়ে। এই সময়ে বড় অর্জন ভাষা থেকে স্বাধীনতা এবং চার জাতীয় মূলনীতির ভিত্তিতে একটি উদার গণতান্ত্রিক শ্রেষ্ঠ সংবিধান রচনা। গত দুই দশকেও বড় দুটি অর্জন রয়েছে, বাংলাদেশকে একটি উন্নত দেশের মর্যাদার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দেয়া এবং প্রতিক্রিয়াশীলদের মূলোৎপাটন করতঃ ঐতিহাসিক কতগুলো কর্মসম্পাদন।

এক নজরে নারী নেতৃত্ব

১৯৪৯ সালের ২৩ জুন জন্ম হওয়া আওয়ামী মুসলিম লীগ তথা আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে কোনো নারী সদস্যের দেখা মেলেনি। এ অবস্থা বিরাজমান ছিল ১৯৫৫ সালের ২১ এপ্রিলের দ্বিতীয় কাউন্সিল পর্যন্ত। তবে আওয়ামী গঠন প্রক্রিয়ায় সরাসরি যুক্ত ছিলেন তৎকালীন পূর্বপাকিস্তান আইন পরিষদের সদস্য মিসেস আনোয়ারা খাতুন। তিনি দেশবিভাগপূর্ব বৃটিশ-ভারত অধীন বঙ্গীয় আইন পরিষদে নির্বাচিত ছিলেন। ১৯৫৩ সালের দলের প্রথম কাউন্সিলে নির্বাচিত কমিটিতে ঠাঁই না পেলেও ১৯৫৪ সালের ৮ মার্চের নির্বাচনে গঠিত আইন পরিষদের সদস্য ছিলেন আনোয়ারা খাতুন। ১৯৫৫ সালে নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী সারা পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। একই সময় পূর্বপাকিস্তানেও আতাউর রহমান খানের মুখমন্ত্রিত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসীন ছিল। কিন্তু কেন্দ্র বা প্রদেশে সরকারের মন্ত্রিসভায় কোনো নারী সদস্য ছিল না। কেবল সাতজন আইন পরিষদ সদস্য ছিল। সেসময়ের বহুল আলোচিত ‘মারী কনভেনশন' ছিল সরকারের জন্য একটা বড় ইস্যু।

১৯৫৫ সালের ২১ এপ্রিল আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটিতে মতদ্বৈধতার জের ধরে আইন পরিষদের যে ১১ শীর্ষ নেতা বহিষ্কার হন তন্মধ্যে আনোয়ারা খাতুন অন্যতম।

১৯৫৫ সালের ২১ এপ্রিলের কাউন্সিলে ‘মুসলিম’ শব্দ পরিত্যাগ করে আওয়ামী লীগ নাম ধারণ করা হয়, এবং ওয়ার্কিং কমিটিতে একটি মহিলা সম্পাদিকার পদ সৃষ্টি করেন আইন পরিষদ সদস্য সেলিনা বানুকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কিন্তু ১৯৫৭ সালের ৩০ মার্চ সেলিনা বানু পদত্যাগ করেন। সাংগঠনিক সম্পাদক অলি আহাদের বহিষ্কারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে। যে ওয়ার্কিং কমিটির পদত্যাগী ১১ কর্মকর্তার মধ্যে সেলিনা বানুই ছিলেন একমাত্র পদত্যাগী নারী সদস্য।

ওই বছরেরই ২ জুন ১১টি শূন্য পদে কো-অপট করা হয়। ফলে মহিলা সম্পাদিকা হন মেহেরুন নেসা খাতুন। ১৯৫৭ সালের ১৩ এপ্রিলের কাউন্সিলেও মেহেরুন নেসা খাতুন মহিলা সম্পাদিকা নির্বাচিত হন। জেনারেল ইস্কান্দার মীর্জার পর জেনারেল আইয়ুব খানের সামরিক শাসন শুরু হলে রাজনীতি স্থবির হয়ে যায়। নেতৃবৃন্দ অধিকাংশই নিক্ষিপ্ত হন কারাগারে।

১৯৬৪ সালে ৬ মার্চ কাউন্সিলে নতুন কমিটি হলেও কোনো নারী ছিলো না। ১৯৬৬ সালের ১৮-১৯ মার্চ কাউন্সিলে মওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশের প্রস্থান ঘটে এবং শেখ মুজিবুর রহমান সাধারণ সম্পাদক পদ থেকে প্রথমবারের ন্যায় সভাপতি নির্বাচিত হন। এ কাউন্সিলে আমেনা বেগম মহিলা সম্পাদিকা হন। দল স্থবিরতা কাটিয়ে নতুন উদ্যোমে কর্মকাণ্ড শুরু করলেও সাবেক মহিলা সম্পাদিকা মেহেরুন নেসা খাতুন নেতৃত্ব থেকে হারিয়ে যান। দলের নবাগত সভাপতি হওয়ার আগেই সাধারণ সম্পাদক পদে আসীন থাকতেই বাঙালি মুক্তির সনদ ঐতিহাসিক ৬ দফা ঘোষণা করেছিলেন। সভাপতি হওয়ার পর তাঁর ৬ দফাকে জনপ্রিয় করে তোলার জন্য লড়াকুমেজাজে মাঠে-ময়দানে নেমে পড়েন। টনকনড়া এ কর্মসূচি স্তব্ধ করে দিতে পাকিস্তান প্রেসিডেন্ট স্বঘোষিত ফিল্ডমার্শাল আগা মুহাম্মদ আইয়ুব খান ইস্পাত কঠিন দমনপীড়নের পথ বেছে নেন।

শেখ মুজিব রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে পথচলার দৃঢ় সংকল্প নিয়ে সারা দেশব্যাপী কর্মসূচি ঘোষণা করে ৬ দফাকে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে নেতাকর্মীদের ঝাঁপিয়ে পড়ার নির্দেশ দেন। এবার শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনে নেমে আসে বারবার সেই কারাভোগের পরিণতি। দলের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ কারাগারে নিক্ষিপ্ত হলে সাংগঠনিক সম্পাদক মিজানুর রহমান চৌধুরী আওয়ামী লীগের পক্ষে হাল ধরেন।

ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান চৌধুরী দলের কাণ্ডারি শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি ও ৬ দফার পক্ষে মাঠ সরগরম রাখতে সচেষ্ট হলে আইয়ুব শাহী এবার মিজান চৌধুরীকেও কারারুদ্ধ করেন। একে একে প্রচার সম্পাদক আব্দুল মোমিনসহ ওয়ার্কিং কমিটির প্রায় সকল নেতাকে কারাগারে নিক্ষেপ করলে দলের মহিলা সম্পাদিকা আমেনা বেগম ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক পদে আসীন হয়ে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন। অল্পদিনের ব্যবধানে আমেনা বেগমের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ আবারও সক্রিয় হয়ে উঠতে সক্ষম হয়।

বলাবাহুল্য, কেন্দ্রীয় নেতাদের শুধু নয়, জেলা-থানা পর্যায়ের নেতাদেরও একেক করে কারাগারে প্রেরণ করা হয়। ৬ দফা এতদিনে সাধারণ মানুষের প্রাণের দাবিতে পরিণত হয়। বিচারিক আদালতগুলো শেখ মুজিবকে বারবার মুক্তি দিলেও একেকটা মামলা রুজু করে তাঁকে গ্রেপ্তারের ঘটনা ঘটে।

১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান পর্যন্ত শেখ মুজিবের নিবাস হয়ে ওঠে এক কারাগার হতে আরেক কারাগার। গণঅভ্যুত্থানের মহানায়ক তোফায়েল আহমেদ ২৩ ফেব্রুয়ারি কারামুক্ত শেখ মুজিবকে ‘বঙ্গবন্ধু’ খেতাবে ভূষিত করেন। কয়েক লাখ ছাত্র-শ্রমিক-জনতার পক্ষে দেওয়া ওই খেতাব, প্রকারান্তরে সারা জাতির স্ব-শ্রদ্ধেয় খেতাবে পরিণত হয়।

১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে লৌহমানব আইয়ুব খানের পতন বঙ্গবন্ধুর ৬ দফাকে ঐতিহাসিক স্বীকৃতি এনে দেয়। দেশদ্রোহীতার অভিযোগ থেকে মুক্তি পান বঙ্গবন্ধু। আইয়ুব খানের গোলটেবিল বৈঠকে বঙ্গবন্ধু ৬ দফা দাবি পেশ করেন। ফলে ব্যর্থ হয়ে গোলটেবিল বৈঠক। ক্ষমতাগ্রহণ করেন তৎকালীন সেনাপ্রধান আগা মুহম্মদ ইয়াহিয়া খান। আস্থা সৃষ্টির প্রয়াস হিসেবে পাকিস্তানের প্রধান নির্বাচন কমিশনার পদে চমক দেখান একজন বাঙালিকে নিয়োগ দিয়ে নয়া প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া।

নিয়োগ পাওয়া ব্যক্তি একসময়ে শেরেবাংলার কৃষক প্রজা পার্টি ও পরে কৃষক শ্রমিক পার্টির নেতা ও আইন পরিষদ সদস্য ছিলেন। পরবর্তীতে ছিলেন মন্ত্রী ও পাকিস্তান সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতি। এই ব্যক্তিটি আর কেউ নন, বিচারপতি আব্দুস সাত্তার। প্রধান নির্বাচন কমিশনার হয়েই ইয়াহিয়া খানের রূপরেখার সাধারণ নির্বাচন দেন।

১৯৭০ এর ওই নির্বাচনে ৬ দফার পক্ষে ভোটের এক মহাবিপ্লব ঘটে। পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের জন্য নির্দিষ্ট ১৬৯ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগেরই কব্জায় চলে যায় ১৬৭টি। তিন মুসলিম লীগ- মুসলিম লীগ (কনভেনশন), মুসলিম লীগ (কাইয়ুম), মুসলিম লীগ (কাউন্সিল), মওলানা মওদুদী-গোলাম আযমের জামায়াতে ইসলাম, নূরুল আমীনের পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টি, মওলানা আতাহার আলী খানের নেজামে ইসলাম ধরাশায়ী হয় সর্বত্র। পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের ৩০০টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ২৮৮টি পেয়ে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে।

এই ঐতিহাসিক বিজয়ের পরই শুরু হয় ষড়যন্ত্র। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানের ভাবি প্রধানমন্ত্রী হিসাবে অভিষিক্ত করে, অন্যদিকে চলে গভীর চক্রান্ত।

যাহোক, আওয়ামী লীগের মহিলা সম্পাদিকা হিসেবে যে আমেনা বেগম ৬ দফাকে জনপ্রিয় করে নিজের ইমেজকে উচ্চ শিখরে পৌঁছে দিয়েছিলেন, সেই তিনি নির্বাচনের আগে জাতীয় লীগ নামে নতুন দল গঠন করেন। আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাকালীন সিনিয়র সহসভাপতি ও আওয়ামী লীগ সরকারের মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খান তাঁর সঙ্গী হন জাতীয় লীগের সভাপতি হয়ে। কিন্তু নির্বাচনে আতাউর রহমান খান ও আমেনা বেগম জামানত বাজেয়াপ্ত হয়।

লেখক: সাংবাদিক

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :