ফোবিয়া

প্রকাশ | ৩১ অক্টোবর ২০১৯, ২১:২৫

অরুণ কুমার বিশ্বাস

ফোবিয়া মানে হলো অমূলক ভয়, অকারণ ভয়। ‘দমফাটা হাসির’ মতো দম আটকানো আতঙ্ক। অমূলক বলার অর্থ হলো যাদের কোনো বিষয়ে ফোবিয়া থাকে, তারা কোনো যুক্তিবুদ্ধির ধার ধারে না, নিছক ভয় পায়। এই যেমন কিছুলোক আছে দেখবেন, তারা ভিড়ভাট্টা এড়িয়ে চলে। তারা মনে করে, লোকজন তার ক্ষতি করতে পারে। এর নাম সোশ্যাল ফোবিয়া।

আবার অনেকে আছে দেখবেন, একলা ঘরে ঢুকতে ভয় পায়। তারা প্রায়শ মনে করে ঘরে ঢুকলে সে আটকা পড়বে। এমনি এমনি দরজা বন্ধ হয়ে যাবে, আর খুলবে না। এধরনের লোকেরা লিফটে উঠতেও ভয় পায়। প্রয়োজনে কুড়িতলা ভবনে হেঁটে উঠবে, তাও লিফটে চড়বে না। কী মুসবিত বলুন তো! আমি এমন একজনকে জানি, যে কিনা ভাল একটা চাকরি ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়, কারণ তার অফিসটা ছিল পনেরো তলার উপরে। একটা মারচেন্ট অফিস। লিফটে উঠলেই তার বুক ধড়ফড় করে, যেন এক্ষুনি তার দম বেরিয়ে যাবার জোগাড়। 

কেউ কেউ হয়তো বলবেন, মামুলি ব্যাপার। মেনে নাও। উঁহু, এটা মোটেও স্বাভাবিক কিছু নয়। এর নাম মনোবৈকল্য। মানসিক রোগের পর্যায়ে পড়ে। উপরে ওঠানামার ব্যাপারটা না হয় ছেড়ে দিলাম, কিন্তু যারা নারীকে ভয় পায় তাদের কী অবস্থা ভাবুন। এরা যেন মনে মনে বলে, ‘নারী ও নরক, প্রেমিকের মড়ক’। নিজের বোন এবং মা বাদে অন্যসব মহিলাকে তারা যমের মতোন ভয় পায়। ইংরেজিতে বলে মিসোজিনি। এরা আবার আরেক কাঠি উপরে। এই রোগে আক্রান্তরা নারীকে শুধু ভয় নয়, রীতিমতো ঘৃণা করে। অবশ্য রাস্তাঘাটে এসব মেয়েরা ছেলেদের দেখলেই বলে, কী মিস্টার, তোমার ঘরে কি মা-বোন নেই! মিসোজিনিস্টরা মেয়েদের কাছে বিশেষ সম্মান পায়, কারণ এসকল ছেলেরা নারীকুলের ধারেকাছে ঘেঁষে না। কাছে গেলেই যেন তাদের গায়ে বিষবিছুটি লাগবে।

ইদানিং একটা ব্যাপার খুব ঘটছে জানেন তো। ফোবিয়া যে কেবল অকারণ ভয় তা নয়, বাস্তব কারণেও মানুষ এখন ভয় পায়। প্রচণ্ড ভয়। এমন ভয় যে, মনে হয় যেন পেটের পিলে একলাফে গলার কাছে উঠে আসবে। কিছু কিছু ‘দেখতে ভাল’ চটকদার গোছের মেয়ে আছে, যারা কিনা ভাবে ছেলেরা তাদের দেখলেই অমনি লাফিয়ে এসে প্রেম নিবেদন করে বসবে। ছেলে নয়, উল্টো এসকল মেয়েরাই মনে মনে তটস্থ থাকে। এই বুঝি প্রণয় নিবেদন করে বসলো।

আঃ মলো যা! মনে মনে মনকলা খায় আর কি! ছেলেদের আজকাল অত সময় কোথায় যে বিনেমাগনায় প্রেম করবে! বেশ মনে আছে, আমরা যখন ডিইউ-তে পড়তাম, সকাল সাতটা থেকে রাত নটা অব্দি কিছু কিছ কাপল শিমের লতার মতো একে অপরের সঙ্গে জড়াজড়ি করে বসে থাকতো। অবাক বিস্ময়ে ভাবতাম, ইশ্ এদের কি খিদেতৃষ্ণা বলেও কিছু নেই! আর এখন- নো কাপল, নো প্রেম। ডিইউ ক্যাম্পাস, কলাভবন, টিএসসি, কার্জন হল- সব একেবারে সাফসুতরো, ফকফকা। ক্যাম্পাসে বা টিএসসিতে আপনি এখন ওষুধ খেতেও একটু প্রেম পাবেন না। এখন আর বোধ হয় আগের মতো কারো প্রেম পায় না, ভালোও বাসে না। 

আমি বরং এই প্রেমহীন প্রজন্মকে ভয় পাই। যারা ভালোবাসতে জানে না, তারা মানুষ খুন করতে পারে। যারা ভালোবাসে না, তারা কোনো কাজ ঠিকঠাক করে উঠতে পারে না। জাপানে শুনেছি কোনো এক গাড়ির কারখানায় প্রেম বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, যাতে সকলেই প্রেমে ভাগ বসাতে পারে, তাই সমান সংখ্যক ছেলে ও মেয়ে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। যারা যত বেশি প্রেম করবে, তাদের উপরি মানে বোনাস তত বেশি দেয়া হচ্ছে সেই কারখানায়। এই না হলে জাপান, লুটেপুটে খাও, যা পান। 

দিন কে দিন অবস্থা এমন হয়েছে যে, মানুষ এখন মানুষকেই সবচে বেশি ভয় পায়। যাকে বলে হিউম্যান’ও ফোবিয়া। পাবে নাই বা কেন! স্বামী স্ত্রীকে সন্দেহ করছে। ভাবছে, কোলের ছেলে তার নয়, এর বাপ অন্য কেউ। মানে সন্দেহবাতিকগ্রস্ত স্বামী নিজের ছেলেকেই পর ভাবতে শুরু করে। এই অব্দি হলেও না হয় মানা যেত। সম্প্রতি ফরিদপুরে যে কাণ্ড ঘটলো, তারপর আর বাপকেও ভয় না পেয়ে উপায় নেই। সন্দেহের বশে নিজের ছেলেকেই মেরে ফেলল পাষণ্ড বাবা। স্রেফ নিজের স্ত্রীর উপর প্রতিশোধ নিতে গিয়ে। নিজের ছেলেকে বাপ-চাচা-চাচাতোভাই মিলে নৃশংসভাবে খুন করে সুনামগঞ্জের নাম ক্ষুণ্ন করেছে আরেক বর্বর পাষণ্ড।      

আবার যেমন ধরুন বসকুলের কথা। বস মানেই মূর্তিমান আতঙ্ক। তাদের আচরণ স্বৈরশাসকের মতো। ধরুন বস আপনাকে কলিং করেছে। পাশেই রুম। যেতে কেন দেরি হল এই নিয়ে যা নয় তাই শুনিয়ে দিল। অথচ আপনি ওয়াশরুমে বসে কিছু একটা করছিলেন, মানে নিজেকে ভারমুক্ত করা আর কি। বস কিন্তু সেসব শুনতে রাজি নয়। পত্রপাঠ তাকে দেখা দিতে হবে। কিন্তু আপনারাই বলুন, ওসব জরুরি কাজ কি আর মাঝ রাস্তায় সাঙ্গ করা যায়! অধস্তন বলে কি আমরা মানুষ নই! নাকি আমরা কেবল অর্জন করতেই জানি, বর্জন করতে পারি না।   

চিকিৎসাবিদ্যায় অ্যালোপিশো বা ভুল উচ্চারণে অ্যালোপেসিয়া বলে একরকম রোগের নাম আছে। মানে যাদের চুল পড়ে, তবে সারা মস্তকজুড়ে নয়, কেবল চান্দির মাঝখান থেকে আচমকা চুল পড়তে শুরু করে। এই রোগ নাকি এমনি এমনি হয় না। এর পেছনেও রয়েছে এক চরম ফোবিয়ার ইতিহাস। যারা স্ত্রীকে যমের মতোন ভয় পায়, তাদের নাকি এই রোগ হয়। আবার যারা চাকরিতে বেকায়দায় থাকে, তাদেরও অ্যালোপিশো রোগ হয়। এসকল রোগী মনে করে, এই বুঝি তার বউ ভাগলো! অথবা কাল সকালে অফিসে গিয়ে দেখবেন তার চাকরি নেই। বস তাকে ডেকে এককাপ অতি মধুর কফি খাইয়ে সফেদ লেফাফায় ভরে একখানা চিঠি ধরিয়ে দেবে। মুখে বলবে, ইউ আর ফার্য়াড মিস্টার অমুক। কাল থেকে আমি আর আপনার মুখ দেখতে চাই না। যেন মানুষ নয় আপনি একখানা মুখপোড়া হনুমান। ব্যস, তক্ষুণি অমনি ঝর ঝর করে কিছু চুল পড়তে থাকবে। নিমিষে আপনার চান্দি খালি।   

সবশেষে আমার গোপন ভয়ের কথা বলি। মানে ফোবিয়া। লেখক বলে কি তার ভয় থাকতে নেই! নাকি লেখক কখনও খক খক করে কাশবে না! সেই কাঁচা বাজারের গল্প। যাচ্ছি বাজারে। হাতে থলি আর মোড়ানো কিছু টাকা। উদ্দেশ্য- রথ দেখা কলা বেচা দুটোই। মানে ইভ্নিং ওয়াকের সঙ্গে কাঁচা বাজার করা। যাচ্ছি বেশ। হঠাৎ ক্যাঁ করে চেঁচিয়ে উঠলাম। কেসটা কী! দুই মদনটাইপ লোক ফুটপাতে ঠ্যাঙ ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে বিড়ি টানছিল। আমি যাচ্ছি, হঠাৎ দিয়ে দিল ছ্যাঁকা। সত্যি বলছি, লোকে প্রেমে ছ্যাঁকা খেলেও এভাবে চেঁচায় না। মনে হল যেন আমার এপিডার্মা পুড়ে ছাই। আমি শেষ হয়ে যাচ্ছি।

কেসটা কী হল, ছ্যাঁকা দিলেন যে? আমি খেপে গিয়ে বলি।

ওরা মিটিমিটি হাসে, যেন রাজ্য জয় করে ফিরেছে। গলায় এবার বরমাল্য নেবে।

হাসছেন যে?

উত্তরে যা বলল, শুনে আমার আক্কেল গুড়ুম। বলে, দেখে চলতে পারেন না, আমরা বিড়ি টানছি! উজবুক কোথাকার! আপনার মতো লোকের জন্য কি আমরা আরাম করে একটু বিড়িও টানতে পারবো না!

তাহলেই বুঝুন, জাতি হিসেবে আমরা কতখানি সভ্যতা মেখেছি গায়ে! পাবলিক প্লেসে বিড়ি টানা দণ্ডনীয় অপরাধ। তারপর আবার আমাকে দিল ছ্যাঁকা। প্রতিবাদ করলাম, উল্টো শুনিয়ে দিল আমি নাকি উজবুক। সেই থেকে আমি বিড়িখোরদের দুচক্ষে দেখতে পারি না। ওরা আসলে আধা উন্মাদ। আমি  স্মোকারদের ভয় পাই। এটাই আমার একমাত্র ফোবিয়া।

লেখক: কথাসাহিত্যিক ও অতিরিক্ত কমিশনার, বাংলাদেশ কাস্টমস