প্রধানমন্ত্রীর বিনামূল্যের বাড়ির দাম ৪৫ হাজার টাকা!

প্রকাশ | ০৩ নভেম্বর ২০১৯, ০৮:২৩ | আপডেট: ০৩ নভেম্বর ২০১৯, ১২:৩৬

মো. জাকির হোসেন, সৈয়দপুর (নীলফামারী)

‘জায়গা আছে বাড়ি নেই’ এমন হতদরিদ্রদের জন্য প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ বরাদ্দের  সরকারি বাড়ি বিনামূল্যে বরাদ্দপ্রাপ্তকে বুঝিয়ে দেওয়ার কথা। কিন্তু নীলফামারীর সৈয়দপুর উপজেলার কাশিরাম বেলপুকুর ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের চওড়া বাজার গুয়াবাড়িতে এই বাড়ি পেতে ৪৫ হাজার টাকা দিতে হয়েছে অসহায় পরিবারকে।

বরাদ্দপ্রাপ্ত অসহায় আওয়ামী লীগের কর্মী ওবায়দুল হক এই টাকা দেন দলের ওয়ার্ড সাধারণ সম্পাদকসহ মহিলা মেম্বার ও অন্যদের। চরম দরিদ্র ও ভিক্ষা করে জীবিকা নির্বাহকারী ওবায়দুল হক তার সারা জীবনে সঞ্চিত কিছু টাকা ও এনজিওর ঋণ নিয়ে পরিশোধ করেন বাড়ির ‘মূল্য’।

সরেজমিনে গিয়ে হতদরিদ্র ওবায়দুল হকের বয়ানে এসব তথ্য জানা গেছে।

ওবায়দুল বলেন, ‘ইউনিয়ন থেকে শুরু করে উপজেলা আওয়ামী লীগের সব স্তরের নেতারা আমাকে দলের একজন নিবেদিত প্রাণকর্মী হিসেবে চেনেন। আমি ভিক্ষাবৃত্তির মাধ্যমে কোনো রকমে জীবন নির্বাহ করি। অথচ আমার কাছ থেকে প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া বাড়ি বরাদ্দের জন্য ৪৫ হাজার টাকা নেওয়া হয়েছে।’

এই টাকার মধ্যে ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আলিফ ওরফে ফকির ২৫ হাজার, ১, ২ ও ৩ নম্বর ওয়ার্ডের সংরক্ষিত মহিলা মেম্বার আখতারা বেগম ও তার স্বামী বাচ্চা বাউ এবং সুমন নামের এক আওয়ামী লীগ কর্মী মিলে ২০ হাজার টাকা নেন বলে জানান ওবায়দুল।

ওই ব্যক্তিরা উপজেলা চেয়ারম্যান মোখছেদুল মোমিনের কথা বলে টাকা নিয়েছেন জানিয়ে ওবায়দুল বলেন, ‘এ কারণে আমি টাকা দিয়ে বাড়ি নিতে বাধ্য হয়েছি।’

এই টাকা তিনি জোগাড় করেছেন দুটি এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে, আর ভিক্ষার কিছু টাকা সঞ্চয় ছিল। ওবায়দুল বলেন, ‘এখন তাকে এনজিওর ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে হচ্ছে খেয়ে-না খেয়ে।’

এ ছাড়া বাড়ির নির্মাণকাজের সময় মিস্ত্রির খরচ ও খাওয়া, মালামাল আনার ভ্যান ভাড়া ওবায়দুলকে দিতে হয়। বাড়ির মেঝেতে মাটি ভরাটের জন্য লেবারের মজুরিও দিয়েছেন তিনি। ওবায়দুল বলেন, ‘এগুলো ইউনিয়ন চেয়ারম্যানের করার কথা ছিল। তার ছেলে বুলবুল চৌধুরী দায়িত্ব নিলেও সব খরচ আমাকেই বহন করতে হয়েছে।’

এটি প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ বরাদ্দ হওয়ায় এখানে উন্নত মানের ইট ও অন্যান্য সামগ্রী ব্যবহার করার কথা থাকলেও ৩ নম্বর গুড়িয়া ইট দিয়ে বাড়ি বানানো হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে স্থানীয় পর্যায়ে।

এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ২ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আলিফ ওরফে ফকির বলেন, ‘বাড়িটি মূলত সৈয়দপুর উপজেলা চেয়ারম্যান মোখছেদুল মোমিন আওয়ামী লীগের দরিদ্র সদস্যের জন্য বরাদ্দ দিয়েছেন। এ কারণে আমি ২৫ হাজার টাকা নিয়েছি। চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বললেই আপনাকে জানানো হবে।’

১, ২ ও ৩ নং ওয়ার্ডের সংরক্ষিত মহিলা মেম্বার আখতারা বেগম ও তার স্বামী বাচ্চা বাউয়ের বাড়িতে গেলে তাদের পাওয়া যায়নি। মুঠোফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলে তারা কোনো সাড়া দেননি।

নি¤œমানের ইট দিয়ে নির্মাণকাজের অভিযোগ অস্বীকার করেন ঠিকাদার তথা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এনামুল হক চৌধুরীর ছেলে বুলবুল চৌধুরী। তিনি জানান, বাড়ির কাজ শেষ। কোথাও কোনো ২ নম্বর ইট ব্যবহার করা হয়নি।

ওবায়দুল হককে আওয়ামী লীগের একজন কট্টর সমর্থক হিসেবে চেনেন-জানেন সৈয়দপুর উপজেলা চেয়ারম্যান মোখছেদুল মোমিন। তিনি বলেন, ‘সে খুবই গরিব। সৈয়দপুরের জন্য প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ বরাদ্দ ৩০টি বাড়ির মধ্যে ৫টি আমি পেয়েছি। তার একটি ওবায়দুলকে দেওয়ার জন্য ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের নেতাদের দায়িত্ব দিয়েছিলাম। কেউ যদি আমার নাম করে বা অন্য কোনোভাবে ওবায়দুলের কাছ থেকে অর্থ নিয়ে থাকে তাহলে তা খুব দুঃখজনক। বিষয়টি আমি খতিয়ে দেখছি।’

উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা আবু হাসনাত সরকারের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, তাদের কাজ ছিল বাড়ি তৈরি করে দেওয়া। সেটা তারা করেছেন। মেম্বার-চেয়ারম্যানরা অনিয়ম করে থাকলে তার দায়ভার তাদের।’

প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ বরাদ্দের বাড়ির জন্য কেউ টাকা দিয়ে থাকলে সে ব্যাপারে লিখিত অভিযোগ দিলে ব্যবস্থা নেবেন বলে জানান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এস এম গোলাম কিবরিয়া। আর নিম্নমানের ইট ব্যবহার কোনোভাবে সম্ভব নয়। বলেন, ‘কেননা বাড়ি করার জন্য ইট আমরাই সংগ্রহ করে সরবরাহ করেছি। এখানে দুই নম্বরি করার কোনো সুযোগ নেই।’

সৈয়দপুরের কাশিরাম বেলপুকুর ইউনিয়নে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ বরাদ্দের ৫টি বাড়ি দেওয়ার নামে প্রকাশ্যে অর্থ আদায়সহ নানা অনিয়মের বিষয়টি ইউনিয়নের মানুষের মুখে মুখে।

(ঢাকাটাইমস/০৩নভেম্বর/মোআ)