সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য পুলিশের ‘আলোর ইস্কুল’

প্রকাশ | ০৩ নভেম্বর ২০১৯, ১৩:৪৭

আসাদুজ্জামান
ঢাকাটাইমস

বাবা ডাকতে শুরু করার কিছু দিনের মধ্যেই বাবাকে হারায় বীথি। তাকে লালন-পালন এবং পরিবারের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব বর্তায় মায়ের কাঁধে। মা অন্যের বাসাবাড়িতে কাজ করে সংসার সামলান। ফলে বীথির পড়াশোনা অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। এমনই সময় বীথির জীবনের আলোর দিশারী হয়ে ওঠে ‘আলোর ইস্কুল’। যেখানে ভর্তি হলে বিনা বেতনে পড়াশোনার সুযোগ পাওয়া যায়। বাড়তি পাওনা হিসেবে মেলে শিক্ষা উপকরণ, ইউনিফর্ম, খাবার এবং চিকিৎসা। বীথি এখন আলোর ইস্কুলের ছাত্রী। স্বপ্ন দেখছে পড়াশোনা শেষ করে শিক্ষক হবে। বীথির মতো আরো অনেকের স্বপ্নের সারথী এই ‘আলোর ইস্কুল’। 

বলা হচ্ছে শ্যামপুর থানার পুলিশ কর্মকর্তাদের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত ঝরে পড়া, দরিদ্র ও পথশিশুদের জন্য গড়ে তোলা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কথা। আর এর পেছনে রয়েছেন ওয়ারী বিভাগের শ্যামপুর জোনের জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ কমিশনার মো. মফিজুর রহমান। সামাজিক দায়বদ্ধতার অংশ হিসেবে শিক্ষাবঞ্চিত শিশুদের জন্য উদ্যোগী হয়েছেন তিনি। পরিচালনা করেছেন ‘আলোর ইস্কুল’।

ছিন্নমূল শিশুদের জন্য অনন্য এই উদ্যোগের কথা বলতে গিয়ে মো. মফিজুর রহমান এই সময়কে বলেন, ‘ঢাকায় ৪০ লাখ মানুষ বস্তিবাসী। এদের মধ্যে অনেকেই নানা রকম সামাজিক অপরাধে লিপ্ত। বস্তি ঘরে বিক্রি হয় গাঁজা, ইয়াবার মতো মাদক। এছাড়াও এই সমাজের শীর্ষ সন্ত্রাসীদের বেশিরভাগই বস্তি থেকেই বেড়ে উঠেছে। তাই এই বস্তিতে জন্ম নেওয়া শিশুদের যদি আমরা শিক্ষার আলোয় আনতে পারি, তবে ভবিষ্যতে অপরাধ অনেকটাই কমে যাবে। এই ধারণা থেকে এবং সামাজিক দায়বদ্ধতার অংশ হিসেবে আমি এই আলোর ইস্কুলটি পরিচালনা করছি।’

তিনি জানান, আলোর ইস্কুল পরিচালনার জন্য একটি গঠনতন্ত্র রয়েছে। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ঢাকার ওয়ারী বিভাগের শ্যামপুর জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার পদাধিকার বলে সংগঠনটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করবেন। এছাড়াও কদমতলী থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) সহ-সভাপতি, শ্যামপুর মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ সাধারণ সম্পাদক এবং আরো দুই পুলিশ কর্মকর্তা আলোর ইস্কুলটির পরিচালনার জন্য রয়েছেন। এছাড়াও রয়েছেন  কয়েকজন দাতা সদস্য। যারা সবাই মিলে চাঁদা দিয়ে এটি পরিচালনা করছেন। 

আলোর  ইস্কুলটির যাত্রা শুরু হয় এ বছরের জানুয়ারি মাসে। পোস্তগোলার পুলিশ ফাঁড়ির একটি পরিত্যক্ত কক্ষ সংস্কার করে শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে সেখানে অল্প কিছু শিক্ষার্থীর পাঠদান শুরু হয়। ফেব্রুয়ারি মাসে ওয়ারী বিভাগের শ্যামপুর জোনে জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ কমিশনার হিসেবে যোগ দেন মো. মফিজুর রহমান। এর পরপরই আলোর ইস্কুলটি পূর্ণতা পায়। বতর্মানে আলোর ইস্কুলটি চারকক্ষের একটি টিনশেড ভবন। শিক্ষার্থীর সংখ্যা অর্ধশত। আলোর ইস্কুলটিতে শিশু থেকে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পাঠদান করা হচ্ছে। 

মো. মফিজুর রহমান জানান, ভবিষ্যতে তাদের পরিকল্পনা রয়েছে এটি সরকারিকরণের। পাশাপাশি প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্নকারী শিক্ষার্থীদের জন্য কারিগরি শিক্ষা চালুরও পরিকল্পনা রয়েছে। 

আলোর ইস্কুলের সূচনালগ্ন থেকে সহযোগিতা করে আসছেন পোস্তগোলা পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ উপ-পরিদর্শক হালদার অর্পিত ঠাকুর। তিনি বলেন, ‘আমাদের ফাঁড়ির আশপাশের বস্তিবাসী ও ছিন্নমূল শিশুরা মূলত এখানকার শিক্ষার্থী। 

এটির দাতা সদস্য স্থানীয় বাসিন্দা মো. আতিকুর রহমান জানান,   আলোর স্কুলটি পরিচালনার জন্য পুলিশের পাশাপাশি স্থানীয় সচ্ছল ব্যক্তিরাও এগিয়ে এসেছেন। যার ফলে প্রায় ১৫ লাখ টাকা ব্যয় করে এর জন্য নতুন ভবন নির্মাণ করা সম্ভব হয়েছে। 

আলোর ইস্কুলটির শুরু থেকে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করছেন স্থানীয় বাসিন্দা ফয়সাল মৃধা রাজু। তিনি বলেন, মফিজুর স্যারের তত্ত্বাবধানে আলোর স্কুলটি স্থানীয় ঝরে পড়া দরিদ্র শিশুদের আশ্রয়স্থল। বিনা পয়সা শিক্ষা লাভের অনন্য বিদ্যাপীঠ এটি।

বতর্মানে আলোর ইস্কুলে চারজন শিক্ষক রয়েছেন। এর মধ্যে প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন মো. মমিনুল ইসলাম। যিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থ বিজ্ঞানে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন। তিনি বলেন, ছাত্রজীবনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন অসহায় পথশিশু, প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য কাজ করেছি। এরই ধারাবাহিকায় আলোর ইস্কুলের প্রতিষ্ঠাকালীন সময় থেকে রয়েছি।’

বুড়িগঙ্গা নদীর কূল ঘেঁষে মনোরম পরিবেশে গড়ে তোলা আলোর ইস্কুলটি এখন লিমন,  হোসেন, ফাহিম, ফাতেমা, মুন্নির স্বপ্নকে বাস্তব করার অনন্য ক্ষেত্র। কেননা, এর পরিচালক মো. মফিজুর রহমান শত ব্যস্ততার মধ্যেও নিয়মিত শিক্ষার্থীদের খোঁজখবর নিতে আলোর ইস্কুলটি পরিদর্শন করেন। পরম মততায় শিশুদের মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। হাতে তুলে দেন খাবার, শিক্ষা উপকরণ। কখনো বা শিক্ষকের মতো পড়াশোনাও করান। অভিভাবকরা মনে করেন ঢাকার অন্যান্য থানায়ও পুলিশের এমন ধরনের আলোর ইস্কুল চালু করা উচিত। যাতে করে সুবিধাবঞ্চিত শিশুরাও শিক্ষার আলোয় আলোকিত হয়।

(ঢাকাটাইমস/৩নভেম্বর/এজেড)