সামাজিক মাধ্যমে ব্যবহারকারীর পরিচয় নিশ্চিত করা জরুরি

প্রকাশ | ০৩ নভেম্বর ২০১৯, ১৬:১৭ | আপডেট: ০৩ নভেম্বর ২০১৯, ১৬:৩১

ঢাকাটাইমস ডেস্ক

সাত বছর আগে কক্সবাজারের রামুর ঘটনা দিয়ে শুরু। সবশেষ ভোলার বোরহানউদ্দিনের সহিংসতা। মাঝে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর ও রংপুরেও দুটি ঘটনা। সবকটি ঘটনাই সংঘটিত হয়েছে ফেসবুকে ধর্ম অবমাননার অভিযোগে। এসব ঘটনা ঘিরে সহিংসতায় প্রাণও গেছে।

প্রতিটি ঘটনার ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, ফেসবুকে পোস্ট দেয়া কিংবা বার্তা পাঠানোর বিষয়টি উঠে এসেছে। সম্প্রতি মহানবীকে কটাক্ষ করে মেসেঞ্জারে পাঠানো বার্তাকে কেন্দ্র করে ভোলার ঘটনার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অপব্যবহার নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে জোরালোভাবে। বিশেষ করে ফেসবুক ব্যবহারে নীতিমালা প্রণয়নের বিষয়ে জোর দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।

এমতাবস্থায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারের বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি দিক বাতলেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও সমাজ বিশ্লেষক তৌহিদুল হক। সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের এই সহকারী অধ্যাপকের মতে সামাজিক মাধ্যমে নৈরাজ্য-বিশৃঙ্খলা ঠেকাতে প্রত্যেক ব্যবহারকারীর পরিচয় নিশ্চিত করা জরুরি। ঢাকা টাইমসকে দেয়া সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন মনিরুল ইসলাম।

প্রশ্ন: বর্তমান সময়টাকে বলা হচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়ার যুগ। ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা, হাতে হাতে স্মার্টফোন মানুষকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমমুখী করেছে। বাংলাদেশে প্রায় আড়াই কোটি মানুষ ফেসবুক ব্যবহার করেন বলে ধারণা করা হয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো বাস্তবে কতোটা সমাজের প্রতিনিধিত্ব করে?

তৌহিদুল: হ্যা, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের একটা সময় চলছে। মানুষ আগে সনাতনী যেসব প্রক্রিয়ায় অপর মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করত কিংবা একজনের বিপদে আরেকজনের এগিয়ে আসার প্রবণতা অথবা মানুষের পাশে দাঁড়ানোর যে প্রক্রিয়া বা উপলব্ধি ছিলো, সহযোগিতার যে ধরণ ছিলো, এখন সেসব ধরণে প্রক্রিয়াগত পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সেই প্রক্রিয়াগত পরিবর্তনেরই অংশ।

তবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারের উদ্দেশ্য কিংবা ব্যবহারের ধরণগুলো দেশভেদে ভিন্ন। আমাদের দেশে যেভাবে আমরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যাবহার করছি এই ব্যবহারের উদ্দেশ্যর ক্ষেত্রে আমাদের নানা ধরনের প্রশ্ন রয়েছে। বিশেষ করে আমরা যে ধরণের সাংস্কৃতিক পরিচয় বা বৈশিষ্টের মধ্যে বড় হয়েছি অথবা আমাদের দেশে যে ধরণের সমাজ কাঠামো রয়েছে সেই পেক্ষাপটে সবার হাতে যে ফোনটি রয়েছে সেই ফোনের মাধ্যমে ফেসবুক ব্যবহারের ক্ষেত্রে একেবারে অবাধ স্বাধীনতার বিষয়টি আমাদের অনেক ক্ষেত্রে বিশৃঙ্খলা কিংবা অশান্তি অথবা অবমাননাকর বিভিন্ন পরিবেশ বা পরিস্থিতির সৃষ্টি করছে। এমনকি গুজব রটিয়ে সহিংসতায় প্রাণহানিও হচ্ছে।

এক্ষেত্রে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারে বয়স, বৈশিষ্ট, আচরণগত বৈচিত্র এই ব্যাপারগুলোকে বিবেচনায় আনা জরুরি। কারণ বাংলাদেশের মানুষের সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক যে ধরণ তার প্রেক্ষাপটে অবাধে ব্যবহারের সুযোগ বিপদগামীতার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। আমরা এর প্রমাণও হরহামশো দেখতি পাচ্ছি।

প্রশ্ন: ফেসবুকে বিভিন্ন পোস্ট দিয়ে, নোংরা ছবি-ভিডিও আপলোড করে নারীদের হয়রানি, গুজব ও ধর্মীয়বিদ্বেষ ছড়ানো, প্রশ্নফাঁসসহ গুরুতর অপরাধগুলো সংঘটিত হচ্ছে। সবশেষ ভোলার ঘটনা দেখলাম। এ ধরণের কর্মকাণ্ড আগে থেকে ঠেকানো যায় কিনা...

তৌহিদুল: অবশ্যই যাবে। যদি আমাদের দেশে ফেসবুক ব্যবহারে নির্দিষ্ট নীতিমালা থাকে এবং সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটি যদি নির্দিষ্ট মনিটিরিংয়ের মধ্যে নিয়ে আসা যায়। একজন ব্যক্তির একাধিক আইডি থাকতে পারবে না। তাহলেই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে। গুজব রটানোই হয় ফেইক আইডি ব্যবহার করে। তাই একজন ব্যক্তির একটি আইডি থাকলে সেক্ষেত্রে বিচার-বিবেচনার বিষয়টি চলে আসবে। ব্যবহারকারী তার নিজের বিষয়টিও ভাবতে বাধ্য হবেন।

প্রশ্ন: নীতিমালা করে ব্যবহারকারীকে তার আওতায় আনার কথা বলছেন?

তৌহিদুল: হ্যা, স্পষ্ট করে বলতে চাই ১৮ বছরের নিচে কাউকে ফেসবুক ব্যবহারের সুযোগ না দেয়া। আর অবশ্যই জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়ে ব্যবহারকারীর আইডেন্টিটি নিশ্চিত করা। একজন ব্যক্তি যাতে তার জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়ে শুধু একটি ফেসবুক আইডি খুলতে পারেন সেটি নিশ্চিত করা। সেক্ষেত্রে সরকার চাইলে ফেসবুক কতৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে নির্দিষ্ট নীতিমালার আওতায় নিয়ে আসতে পারে।

পাবলিক শিষ্টাচার, পাবলিক সম্মান, মর্যাদার বিষয়গুলো অর্থাৎ পাবলিক অনুশাসনগুলোর ব্যাপারে দেশের জনগণের  আচরণের মধ্যে সম্মানবোধ আমরা তেমন লক্ষ্য করি না। ফেসবুকে অবাধ স্বাধীনতার সুযোগে অনেকে এটিকে অপব্যবহার করছে অথবা হীন কোনও উদ্দেশ্যে বা তার ব্যক্তিগত কোনও উদ্দেশ্যে অথবা রাজনৈতিক কোনও উদ্দেশ্যে ফেসবুকের যে উপাদানগুলো রয়েছে সেসব উপাদানগুলোকে ব্যবহার করছে। সমস্যাটি তৈরি হচ্ছে এখান থেকেই।

পরিচয় নিশ্চিত করা গেলে ব্যবহারকারী নিজেই নিজের কাজে লাগাম টানবে। কোনও কিছু করার আগে অন্তত কিছুটা হলেও তার মধ্যে চিন্তা কাজ করবে। তাছাড়া একটি নির্দিষ্ট নীতিমালা কিংবা প্রক্রিয়া অথবা শিষ্টাচারের মধ্যে নিয়ে আসা হলে ইতিবাচকতার সংখ্যা এবং ইতিবাচকভাবে ফেসবুক ব্যবহার করার প্রবণতাও বেড়ে যাবে।

প্রশ্ন: সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বিশেষ করে ফেসবুককে ‘ডিজিটাল কোকেন’বলা হচ্ছে। আমাদের দৈনন্দিন বাস্তবতায় আসলে ফেসবুকের প্রয়োজনীতা রয়েছে কিনা?

তৌহিদুল: সময়ের প্রেক্ষাপটে এখন আমরা এখন এমন জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছি, বৈশ্বিকভাবে যে প্রক্রিয়ায় মানুষ এখন চিন্তা করছে , একজন আরেকজনের সাথে যোগাযোগ করছে এই বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। বলা যেতে পারে যোগাযোগের বিষয়গুলো হলো, বন্ধুত্ব স্থাপন কিংবা পরষ্পরে ভাবের আদানপ্রদান। এছাড়া জ্ঞান বিনিময় করা অথবা নতুন কিছু আবিষ্কারের বিষয়টি সবাইকে জানান দেয়া অথবা অতি অল্প সময়ের মধ্যে কোনও একটি ঘটনা অধিকসংখ্যক মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়া, একটি মেসেজ অথবা সংবাদ- এই ব্যাপারগুলোর প্রেক্ষাপটে আমরা ফেসবুকের গুরুত্বকে অস্বীকার করতে পারি না।

কিন্তু আমাদের দেশে যেটা দাঁড়িয়েছে, অবাধ ফেসবুক ব্যবহারের স্বাধীনতার সুযোগে এটি একধরণের  অ্যাডিকশনে দাঁড়িয়েছে । এটাকে আমরা ডিজিটাল কোকেন বা ডিজিটাল অ্যাডিকশন বলি। এটিও কিন্তু সরকার চাইলে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। ফেসবুক কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলে একজন ব্যক্তি তার আইডি দিনে কত ঘন্টা বা কতসময়  ওপেন করতে পারবে বা ব্যবহার করতে পারবে তা নির্ধারণ সম্ভব।

সুতরাং এটি সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করছে রাষ্ট্র কিংবা রাষ্ট্রের সদিচ্ছার উপরে। এখন ফেসবুকের মাধ্যমে আমরা যেমন অনেক ইতিবাচক ঘটনা বা অপরাধের সন্ধান পেয়েছি, অপরাধীদেরকে চিহ্নিত করতে পেরেছি; একইভাবে আমরা যদি গঠনমূলকভাবে, কাক্সিক্ষতভাবে বা প্রত্যাশিত উপায়ে যদি ফেসবুক ব্যবহার করতে পারি তাহলে সে অ্যাডিকশনের জায়গাটি কমে আসবে।

কারণ বর্তমান প্রজন্মের মধ্যে কিন্তু ফেসবুককেন্দ্রীক মূল এডিকশনের জায়গাটি হচ্ছে লাইক, কমেন্টস রিলেটেড। আমার একটি পোস্টে বা ভিডিওতে কতজন লাইক দিল,  কি কমেন্টস করেছে, সেসব লাইক কমেন্টস নিয়েও কিন্তু পরবর্তীতে নানা ধরনের বিপত্তি বা বিশৃঙ্খলা তৈরি হচ্ছে। সমষ্টিগত সম্প্রীতি নষ্ট হয়েছে, বন্ধুত্ব নষ্ট হয়েছে, এমনকি নষ্ট ভেঙে যাচ্ছে। এ ব্যাপারগুলো কিন্তু আছে।

সেই জায়গা থেকে যেহেতু আমরা জাতিগতভাবে আমাদের ব্যক্তিজীবন বা সামষ্টিক জীবনে শিষ্টাচার কিংবা ম্যানার বা কার্টেসির বিষয়টি আমরা খুব একটা বেশি সচেতন নই এবং আমরা অনেক ক্ষেত্রে তা পালনও করতে চাই না, এই যে একটা প্রবণতার সঙ্গে ফেসবুকের অবাধ স্বাধীনতা আমাদের অনেককে বেপরোয়া করে তুলেছে। আর অনেকের বেলায় সেটি এডিকশনের চূড়ান্ত রূপ নিচ্ছে।