বাংলাদেশের সমবায় আন্দোলন ও বঙ্গবন্ধুর উন্নয়ন দর্শন

প্রকাশ | ০৩ নভেম্বর ২০১৯, ১৬:৫৮ | আপডেট: ০৪ নভেম্বর ২০১৯, ১১:১৫

মো. আবুল খায়ের

নিজেদের আর্থসামাজিক উন্নয়নে একই উদ্দেশ্যে সমষ্টিগতভাবে কোনো একটি কাজ করাই সমবায়। এ উপমহাদেশে সমবায়ের যাত্রা শুরু হয় উনিশ শতকের গোড়ার দিকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাত ধরে কৃষি সমবায়ের মাধ্যমে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিলেতে পড়াশোনা করতে গিয়ে ও রাশিয়ার বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে কৃষি সমবায়ের ধারণা লাভ করেন। তিনি এ উপমহাদেশে তা বাস্তবায়ন করার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তার বিভিন্ন লেখায় তৎকালীন সমবায় সম্পর্কে এ অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন। সমবায়কে আইনি কাঠামোর মধ্যে আনা হয় চল্লিশের দশকে বেঙ্গল কো-অপারেটিভ অ্যাক্ট প্রণয়নের মাধ্যমে।

দেশ বিভাগের পর পূর্ব বাংলায় ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠিত হয়। নতুন সরকারের কৃষি ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব প্রদান করেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে; আর তখন থেকেই মূলত সমবায় নিয়ে বিভিন্ন প্রকল্প পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। স্বাধীন বাংলাদেশের অর্থনীতিকে ঢেলে সাজানোর জন্য বঙ্গবন্ধু সমবায়কে বেছে নিয়েছিলেন।

স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু সমবায়কে সংবিধানের ১৩(খ) অনুচ্ছেদে মালিকানার দ্বিতীয় খাত হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করেন। বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন গ্রামে গ্রামে বহুমুখী সমবায় প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে গ্রাম অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে; আর তাই তিনি ১৯৭৩ সালে মিল্কভিটার মতো সমবায় প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন।

তিনি বলেছিলেন,আমার দেশের প্রতিটি মানুষ খাদ্য পাবে, আশ্রয় পাবে, শিক্ষা পাবে, উন্নত জীবনের অধিকারী হবে- এ হচ্ছে আমার স্বপ্ন। এ পরিপ্রেক্ষিতে গণমুখী সমবায় আন্দোলনকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। কিন্তু দুষ্কৃতিকারীরা ৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে এ দেশের সমবায়কেন্দ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন পরিকল্পনাকে থামিয়ে দেয়।

আধুনিক বাংলাদেশের রূপকার বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২১ বছর পর রাষ্ট্রক্ষমতায় এসে সমবায় নিয়ে ব্যাপক পরিকল্পনা গ্রহণ ও সমবায়ভিত্তিক বিভিন্ন প্রকল্প নেন। এসব প্রকল্প ও উদ্যোগের ফলে বাংলাদেশ আজ  মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে।

বাংলাদেশে বর্তমানে ১ লাখ ৭৪ হাজার ৬০০ সমবায় সমিতি বিদ্যমান; আর এসব সমবায় সমিতিতে প্রায় ১ কোটিরও বেশি সমবায়ী রয়েছে, যার ১৮ শতাংশ নারী সমবায়ী। এ বিপুলসংখ্যক সমবায়ীকে একই সুতায় বেঁধে রেখেছে সমবায় দর্শন। আর এ দর্শন আজ বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত।

সমবায়ের সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে আমাদের দেশের অর্থনীতিকে বিশ্বদরবারে উঁচু স্থানে নেয়া সম্ভব। জাতিসংঘ ঘোষিত ১৭টি এসডিজি লক্ষ্য অর্জনে সমবায় অত্যন্ত কার্যকর উপায়। বর্তমান সরকার যে উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে, সেখানে সমবায়কে অন্তর্ভুক্ত করা গেলে তা আরও টেকসই হবে। সরকার বিগত দিনে দারিদ্র্য দূরীকরণে যে সাফল্য দেখিয়েছে, তা ধরে রাখার জন্য সমবায়ভিত্তিক পরিকল্পনা গ্রহণ করতে পারলে উন্নয়ন টেকসই হবে।

দেশের সমবায়ী কৃষককে কৃষিঋণ প্রদানের জন্য বাংলাদেশ সমবায় ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। তৎকালীন সমবায়ী কৃষক এ ঋণ গ্রহণ করে কৃষি ক্ষেত্রে সাফল্য লাভ করে। বাংলাদেশ সমবায় ব্যাংক দেশের অতি পুরনো ব্যাংক হওয়া সত্ত্বেও বর্তমানে ব্যাংকটিকে স্পেশালাইজড ব্যাংক-তফসিলি ব্যাংক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়নি; ফলে সমবায় সমিতিগুলো তাদের বিভিন্ন কার্যক্রমে বড় পরিসরে কোনো ঋণ সুবিধা পাচ্ছে না। সমবায় ব্যাংকটিকে সত্যিকারের সমবায়ীদের ব্যাংক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে গতিশীল করতে না পারলে বঙ্গবন্ধুর সমবায় পরিকল্পনা বাস্তবায়ন অসম্ভব।

এ ছাড়াও দেশের সব জেলা-উপজেলায় সরকারি ও সমবায়ী মালিকানায় যেসব সম্পদ রয়েছে, তা উদ্ধার করে এখনই সরকারি ও সমবায় মালিকানায় সমবায় হাসপাতাল, সমবায় বিপণিবিতানসহ বিভিন্ন সমবায় প্রতিষ্ঠান স্থাপন করলে আধুনিক বাংলাদেশ বিনির্মাণে সমবায় দৃশ্যমান হবে।

একনজরে বাংলাদেশের সমবায়

১. মোট সমবায় সমিতির সংখ্যা : ১ লাখ ৭৪ হাজার ৬০৪টি

২. ব্যক্তি সদস্য সংখ্যা : ১ কোটি ৮ লাখ ৩৪ হাজার ৭৫০ জন

৩. কার্যকরী মূলধন : ১৩ হাজার কোটি টাকা (প্রায়)

৪. সমবায়ের মাধ্যমে কর্মসংস্থান : ৯ লাখ ২১ হাজার ৮৪৬ জন

৫. জাতীয় পর্যায়ে ১টি সমবায় ব্যাংক, ১টি কো-অপারেটিভ ইন্স্যুরেন্স

৬. বিসিএস (সমবায়) কর্মকর্তা : ১৯২ জন

৭. সমবায় একাডেমি ১টি ও ১০টি আঞ্চলিক সমবায় শিক্ষায়তন

৮. মোট জনবল : ৫ হাজার ৪ জন

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সমবায় পণ্য অত্যন্ত জনপ্রিয়; কারণ একমাত্র সমবায়েই রয়েছে ভোক্তা ও উৎপাদনকারীর অংশগ্রহণ। তাই এ দর্শনে এ দুপক্ষই সুবিধা লাভ করতে পারে। ইন্ডিয়ার আমূল, ডেনমার্কের আরলা ফুড, বাংলাদেশের মিল্কভিটা সারা বিশ্বে ব্যাপক সমাদৃত। কারণ এ পণ্যগুলো সমবায়ী পণ্য; যেখানে উৎপাদনকারী ও ভোক্তার সংযোগ রয়েছে।

বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে শ্রমিক সংকটের কারণে কৃষক তাদের উৎপাদিত কৃষিপণ্য উৎপাদন ও বিপণনে উৎসাহ হারিয়ে ফেলছে। এ সংকট উত্তরণে সমবায় পদ্ধতির চাষাবাদ অত্যন্ত কার্যকর। দেশের প্রতিটি গ্রামে একটি করে কৃষি উৎপাদন ও বিপণন সমবায় প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে গ্রামের সব জমি ওই সমিতিকে দিলে সমিতির উদ্যোগে চাষাবাদ, উৎপাদন ও বিপণন করলে এর সুফল অর্থনীতিতে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করবে। সমবায় অধিদফতরের মাধ্যমে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা যেতে পারে। এ ছাড়াও সমবায়ভিত্তিক বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প যেমন: আমার গ্রাম আমার শহর, সমবায় উদ্যোক্তা সৃষ্টি প্রকল্প গ্রহণের মাধ্যমে দেশের আমূল পরিবর্তন করা সম্ভব। এসব কাজের জন্য সমবায় অধিদফতরকে আরও  গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দারিদ্র্য দূরীকরণের জন্য সমবায়ভিত্তিক আশ্রয়ণ প্রকল্প, সুবিধাবঞ্চিত মহিলাদের ভাগ্যোন্নয়নের জন্য সমবায়ভিত্তিক ঋণ কার্যক্রম প্রকল্প, ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নসহ বিভিন্ন ধরনের প্রকল্প দিয়ে এ দেশ থেকে চিরতরে দারিদ্র্য দূর করার দৃঢ় সংকল্প করেছেন। আমার বাড়ি আমার খামার প্রকল্প যদিও সমবায়ভিত্তিক নয়; কিন্তু সমবায়ের ধারণার আলোকেই করা হয়েছে, যা এ দেশের দরিদ্র মানুষের জীবনমান উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রেখে চলেছে।

সমবায় সমিতিগুলো সাতটি মূলনীতির আলোকে পরিচালিত হয়ে থাকে, যা অনুসরণ করলে একটি সমবায় সমিতি অবশ্যই সফলতা অর্জন করবে। এ সাতটি মূলনীতির মধ্যে ঐক্যবদ্ধ ও স্বচ্ছতা এ দেশের প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং। এ ছাড়া গণতন্ত্র, বিশ্বস্ততা, সহযোগিতা, সামাজিক নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা সহজেই প্রতিষ্ঠা করা যায়। সমবায় অধিদফতর সমবায় সমিতিগুলোর নির্বাচন, অডিট, বার্ষিক সাধারণ সভা স্বচ্ছতার সঙ্গে মনিটরিং করতে পারলে এ দেশের সমবায় সেক্টর অন্য সেক্টরের মতো কার্যকর হয়ে উঠবে। নিবন্ধিত সমবায় সমিতিগুলোকে বাধ্যতামূলকভাবে জাতীয় সমবায় ইউনিয়নের সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। জাতীয় সমবায় ইউনিয়ন সমবায়ীদের সমবায় সংক্রান্ত বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান করে আগামীর নেত্বত্ব দিতে সক্ষম সমবায়ী তৈরি করবে। সমবায় অধিদফতর অতি প্রাচীন একটি বিভাগ, সে তুলনায় এর সংস্কার, জনবল কাঠামোর আপগ্রেডেশন ও সমবায় অধিদফতরকে শক্তিশালীকরণ করা হয়নি; কারণ সমবায়ের সঙ্গে পুঁজিবাদের দ্বন্দ্ব বিদ্যমান। সমবায় অধিদফতর ও সমবায় ক্যাডারকে সংস্কার করে নতুন রূপে ঢেলে সাজানো গেলে এ দেশের জাতীয় অর্থনীতিতে সুবাতাস বইবে।

প্রতিবছর নভেম্বর মাসের প্রথম শনিবার জাতীয় সমবায় দিবস পালন করা হয়ে থাকে।

এ বছর জাতীয় সমবায় দিবসের মূল প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে- বঙ্গবন্ধুর দর্শন, সমবায়ে উন্নয়ন। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা নির্মাণে সমবায়ের এ দর্শনকে ধারণ করে ২০২১ সালে মধ্যম আয়ের দেশ ও ২০৪১ সালের উন্নত বাংলাদেশ বিনির্মাণে সমবায় অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা রাখবে।

লেখক: উপনিবন্ধক (ইপি), সমবায় অধিদফতর, ঢাকা