নিজের করা গণহত্যায় যিনি অভিনয় করেছেন

বিনোদন ডেস্ক
 | প্রকাশিত : ০৪ নভেম্বর ২০১৯, ১৫:২১
ছবিতে আনোয়ার কঙ্গো (ডানে)। ‘দ্য অ্যাক্ট অব কিলিং’ প্রামাণ্যচিত্র তৈরির জন্য মেকআপ করার সময় তোলা

এক বন্ধু দেখছিলেন যে, গণহত্যাকারী আনোয়ার কঙ্গো ধেই ধেই করে নাচছেন। অথচ এর মাত্র কয়েক মুহূর্ত আগেই যেভাবে তিনি খুন করতে পছন্দ করতেন, সেটি প্রদর্শন করে দেখিয়েছেন। তিনি দেখিয়েছেন, এক টুকরো তার গলায় পেঁচিয়ে কীভাবে মানুষের প্রাণ কেড়ে নিতে পছন্দ করেন। পিটিয়ে পিটিয়ে মারার চেয়ে এই পদ্ধতিটাই তার ঝামেলাবিহীন মনে হয়।

সাদা চুল আর শুকনো গোছের এই ব্যক্তি কম করে হলেও এক হাজার মানুষকে হত্যা করেছে বলে মনে করা হয়। অবশ্য, ব্যক্তিগতভাবে তার খুনের তালিকা আরও দীর্ঘ বলে ধারণা করেন অনেকে। তার সেই খুনের কাহিনি রয়েছে ২০১২ সালের অস্কার বিজয়ী ডকুমেন্টারি বা তথ্যচিত্র ‘দি অ্যাক্ট অব কিলিং’-এ। এটি পরিচালনা করেছেন ওপেনহেইমার।

বিংশ শতকের অন্যতম ভয়ংকর গণহত্যাগুলোর একটি, ইন্দোনেশিয়ার এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা খুব কম মানুষই জানে। ইন্দোনেশিয়ায় ১৯৬৫ থেকে ১৯৬৬ সালে যখন রাজনৈতিকভাবে নিধনযজ্ঞ চলছিল, তখন অন্তত পাঁচ লাখ মানুষের প্রাণসংহার করা হয়। ক্যু করতে ব্যর্থ হয়ে সেনারা সারাদেশের কমিউনিস্টদের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে ও হত্যা করে।

বামপন্থী শত শত মানুষকে যারা হত্যা করেছে, কঙ্গো ছিলেন তেমনি একটি হত্যাকারী দলের অংশ। তার সেই কুকর্মগুলোকে ক্যামেরার সামনে অভিনয় করে দেখানোর জন্য প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল ‘দি অ্যাক্ট অব কিলিং’ তথ্যচিত্রের পক্ষ থেকে। অভিনয়ে কঙ্গো রাজি হন। গত ২৫ অক্টোবর ৭৮ বছর বয়সে মারা যান কঙ্গো।

আনোয়ার কঙ্গোর বেড়ে ওঠা

ইন্দোনেশিয়ার উত্তরাঞ্চলের শহর মেদানের একটি তেলক্ষেত্রের কাছে কঙ্গোর পরিবার থাকতেন। সেখানেই তার বেড়ে ওঠা। আশপাশের লোকজনদের তুলনায় তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালোই ছিল। ১২ বছর বয়সেই বিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে কঙ্গো মেদানের অপরাধ জগতে ঢুকে পড়েন। সেখানকার সবচেয়ে জনপ্রিয় সিনেমা হলে শুরু করেন টিকিট কালোবাজারির কাজ।

এর অল্প কিছুদিনের মধ্যে আরও গুরুতর সব অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন তিনি। কালোবাজারি, অবৈধ জুয়া এবং স্থানীয় চাইনিজ ব্যবসায়ীদের থেকে চাঁদা আদায় শুরু করেন। ১৯৬৫ সালে ইন্দোনেশিয়াতে ব্যর্থ ক্যু হবার সময়টা আসতে আসতে কঙ্গো আর তার বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে মিলে শতাধিক অপরাধ ও অপকর্মে জড়িয়ে পড়েন।

সবচেযয়ে বিপজ্জনক হচ্ছে, কঙ্গো ও তার সহযোগীরা ছিলেন কমিউনিস্ট বা বামপন্থী বিরোধী। ইন্দোনেশিয়ার সেই গণহত্যার নীল নকশা এঁকেছিল সেনাবাহিনী। কিন্তু তা বাস্তবায়ন করেছিল গুণ্ডা-পাণ্ডা এবং ডানপন্থী আধা সামরিক বাহিনীর সদস্যরা।

আনোয়ার কঙ্গোর যে দলটা ছিল, সেটিকে নিয়োগ দিয়েছিল সেনাবাহিনী। নিয়োগের পর থেকে তারা শত শত মানুষকে নির্যাতন ও হত্যা করেন। দলটার নাম ছিল ‘ফ্রগ স্কোয়াড’, যাকে বাংলায় বলা যেতে পারে ‘ব্যাঙ বাহিনী’। তারা ছিলেন ওই অঞ্চলের সবচেয়ে শক্তিশালী হত্যাকারী গ্রুপ। এই গ্রুপের হত্যাকারী হিসেবে কঙ্গো কুখ্যাত হয়ে ওঠেন।

হলিউডের সিনেমা দেখে দেখে কঙ্গো ও তার বন্ধুরা মানুষকে খুন করার নতুন নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করতেন। বিশেষ করে আল পাচিনো অভিনীত মাফিয়া সিনেমা এবং জন ওয়েনের ওয়েস্টার্ন সিনেমাগুলো ছিল তাদের প্রিয়।

কঙ্গো তার নিজের হাতে কম করে হলেও হাজার খানেক মানুষকে হত্যা করেছেন। সেই সময়ে কঙ্গো কতটা ভয়ানক ছিল ‘দি অ্যাক্ট অব কিলিং’ তথ্যচিত্রে সেই স্মৃতি রোমন্থন করেছেন উত্তর সুমাত্রার গভর্নর শামসুল আরেফিন। তিনি বলেন, ‘সবাই কঙ্গোকে ভয় পেত। তার নাম শুনলেই লোকে ভয়ে সেঁধিয়ে যেত।’

রাজনৈতিক নিধনযজ্ঞের এই সময়টা ইন্দোনেশিয়াতে খুবই স্পর্শকাতর একটা ইস্যু। কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার কারণে সেই সময়ে লাখ খানেক মানুষকে কারাবন্দী করা হয়। কিন্তু কঙ্গো ও তার বন্ধুদের মত অপরাধীরা কখনোই কোনো জবাবদিহিতার মুখোমুখি হয়নি। উল্টো তিনি তখন ইন্দোনেশিয়ার সরকারপন্থী দল, ‘দি প্যানকাসিলা ইয়ুথ’-এর নেতা হয়ে ওঠেন।

যেভাবে কঙ্গোর তথ্যচিত্রে আসা

আনোয়ার কঙ্গোকে খুঁজে বের করেন নির্মাতা ওপেনহেইমার এবং তিনি যে কুকীর্তি করেছেন সেগুলোর মুখোমুখি করেন এবং বিবেকের সামনে দাঁড় করান। তবে শুরুতে তিনি ছিলেন বেশ অহংকারী। ওপেনহেইমারের সঙ্গে কঙ্গোর প্রথম মোলাকাত হয় ২০০৫ সালে। তখন সাবেক এই হত্যাকারী একে একে তার খুনের পদ্ধতিগুলো তুলে ধরেন।

‘দি অ্যাক্ট অব কিলিং’ তথ্যচিত্রটিতে কঙ্গো ও তার বন্ধুদের অনুসরণ করা হয়েছে। এই তথ্যচিত্রে তারা তাদের হত্যাকাণ্ডের স্মৃতি রোমন্থন করেছেন এবং খুনের পদ্ধতিগুলো তুলে ধরেছেন। তারা নিজেরাই চিত্রনাট্য লিখেছেন, নিজেরাই অভিনয় করেছেন এবং নিজেদের প্রিয় সিনেমাগুলোর আদলে সেগুলোকে প্রকাশ করেছেন।

চাইনিজদের খুন করা নিয়ে আনোয়ার কঙ্গো নিয়মিত ঠাট্টা-মস্করা করতেন। তথ্যচিত্রটিতে একসঙ্গে কাজ করার শুরুর দিকে কঙ্গো বলেন, ‘তরুণ বয়সে কী কী করেছি সেই গল্পই বলব।’ তবে সময় যত এগিয়েছে, নায়কের ভূমিকায় অভিনয় যত সামনে এগিয়েছে, ধীরে ধীরে তাদের মধ্যে বিবেকের উদয় হয়েছে।

এক পর্যায়ে কঙ্গো এটাও স্বীকার করেন যে, একসময় রাতে তিনি নিয়মিত দুঃস্বপ্ন দেখতেন। তিনি বলেন, ‘আমার ঘুমে খুব ব্যাঘাত ঘটে। কী জানি, গলায় প্যাঁচ দিয়ে শ্বাসরুদ্ধ করে মেরে ফেলার সময় আমি তাদের মরতে দেখি বলেই হয়তো এমন হয়েছে।’

তথ্যচিত্রটির একেবারে শেষ দিকের একটি দৃশ্যে কঙ্গো নিজেই একজন আক্রান্ত ব্যক্তির ভূমিকায় অভিনয় করেছেন। সেই দৃশ্যে তার গলায় রশি পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করা হয়। তখন তিনি ক্যামেরা বন্ধ করতে বলেন এবং খুব চুপচাপ বসে থেকে জিজ্ঞেস করেন, ‘আমি অপরাধ করেছি?’ পরে যখন তিনি এই দৃশ্য দেখেন, তখন কেঁদে বলেন, ‘কত মানুষের সঙ্গে আমি এমন করেছি!’

‘দি অ্যাক্ট অব কিলিং’-এর নির্মাতা ওপেনহেইমার বলেন, ‘তথ্যচিত্রটিতে কাজ করতে গিয়ে এক পর্যায়ে কঙ্গোর মধ্যে অপরাধবোধ দেখা দেয়। মানুষ তার নিজের কৃতকর্মের মাধ্যমেই নিজেকে ধ্বংস করে। আর এটাই হচ্ছে এই তথ্যচিত্রের মূল বার্তা।’

ঢাকাটাইমস/৪নভেম্বর/এএইচ

সংবাদটি শেয়ার করুন

বিনোদন বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :