জাবিতে অনড় দুই পক্ষই

প্রকাশ | ০৬ নভেম্বর ২০১৯, ২২:০৫ | আপডেট: ০৬ নভেম্বর ২০১৯, ২২:২৭

জাবি প্রতিনিধি, ঢাকাটাইমস

দুর্নীতির অভিযোগে উপাচার্য ফারজানা ইসলামের অপসারণের দাবিতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধ ক্যাম্পাসেই বিক্ষোভ অব্যাহত রেখেছেন আন্দোলনরত শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। আগের দিন ক্যাম্পাস বন্ধ ঘোষণা করে সব শিক্ষার্থীকে হল ছাড়তে নির্দেশ দেয়া হলেও বুধবার রাত পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের অনেকেই তা মানেননি। এ অবস্থায় ক্যাম্পাসে সব ধরনের সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। প্রয়োজনে পুলিশ ব্যবহারের হুঁশিয়ারি দিয়েছে প্রভোস্ট কমিটি। প্রশাসন ও আন্দোলনকারীদের অনড় অবস্থানে আতঙ্কিত সাধারণ শিক্ষার্থীরা। তারা দুশ্চিন্তায় পড়েছেন ক্লাস ও পরীক্ষা নিয়ে।

বুধভার সকালে মুরাদ চত্বরে জড়ো হওয়ার পর পৌনে ৯টার দিকে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন প্রশাসনিক কার্যালয় থেকে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বের করে দেন আন্দোলনকারীরা। এরপর বেলা সাড়ে ১০টায় মুরাদ চত্বর থেকে শতাধিক শিক্ষার্থীর একটি বিক্ষোভ মিছিল থেকে উপাচার্যের অপসারণের দাবি এবং মঙ্গলবার আন্দোলনকারীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলা ও হল বন্ধের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বিভিন্ন স্লোগান দেন তারা।

এর আগে মঙ্গলবার দিবাগত রাতে আন্দোলনকারী ছাত্রীদের দাবির মুখে ছাত্রী হলগুলোর কর্তৃপক্ষ তালাবদ্ধ গেট খুলে দিলে আটকে থাকা বেশ কয়েকজন ছাত্রীকেও মিছিলে যোগ দিতে দেখা যায়। এরপর দুপুর ১২টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরাতন প্রশাসনিক ভবনের সামনে সংহতি সমাবেশ শুরু হয়।

আন্দোলনকারীদের মুখপাত্র দর্শন বিভাগের অধ্যাপক রায়হান রাইন বলেন, ‘আমরা পরিস্থিতি বিবেচনা করে আমাদের আন্দোলনকে ধাপে ধাপে এগিয়ে নিয়ে যাব। যেহেতু হল ভ্যাকেন্ট করা হয়েছে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের কাছে শিক্ষার্থীরা নিরাপদ নয়, সেহেতু আমরা আন্দোলনের প্রবাহ নিয়ে সুনির্দিষ্ট করে কিছু বলতে পারছি না।’

সমাবেশে অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক অর্থনীতিবিদ আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগ প্রক্রিয়া এখনো সম্পূর্ণ সরকারের নিয়ন্ত্রণে। বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা, ছাত্রলীগ, সরকারি দলের রিপোর্টের ভিত্তিতে উপাচার্য নিয়োগ হয়ে থাকে। আমরা দেখতে পাচ্ছি, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের বিরুদ্ধে একের পর এক দুর্নীতির অভিযোগ। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে হলে যাদের নির্যাতন চলে তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় ভিসি টিকে আছে।’

‘জাহাঙ্গীরনগরে সরকার নিয়োগকৃত ভিসি এবং সরকারি ছাত্র সংগঠনের দুর্নীতি প্রকাশিত হয়েছে। এতদিন ধরে আন্দোলন চলছে অথচ সরকার কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। তদন্ত কমিটি গঠন করেনি। আমাদের দাবি থাকবে আজকের মধ্যেই এ সমস্যা সমাধানে সরকার সিদ্ধান্ত নেবে।’

জাবির সাবেক প্রক্টর তপন কুমার সাহা ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘চার বছর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরের দায়িত্ব পালন করেছি; কিন্তু কখনো তো বিশেষ ছাত্র সংগঠনকে নামানোর প্রয়োজন হয়নি! এখন কেন হলো? মঙ্গলবারের হামলার ঘটনায় আমি ব্যথিত।’

শিক্ষার্থী তাপসী প্রাপ্তি দে বলেন, ‘শিক্ষার্থীরা যাতে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতে না পারে সেজন্য হল তালা মেরে বন্ধ করে রাখা হয়েছিল। আমরা এই আচরণের তীব্র নিন্দা জানাই। অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম কোনোভাবেই শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করে ক্ষমতায় থাকতে পারবেন না।’

সমাবেশে উপস্থিত হয়ে সংহতি প্রকাশ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক তানজীম উদ্দিন খান, জাহাঙ্গীরনগরের শিক্ষক অধ্যাপক সাঈদ ফেরদৌস, অধ্যাপক মির্জা তাসলিমা সুলতানা, অধ্যাপক কামরুল আহসান, অধ্যাপক আনোয়ারুল্লাহ ভুঁইয়া, অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক, অধ্যাপক খবির উদ্দিন, অধ্যাপক কবিরুল বাশার, অধ্যাপক শরমিন্দ নীলোর্মি প্রমুখ শিক্ষক।

আন্দোলনকারীরা অবৈধভাবে মিছিল-সমাবেশ করছে বলে দাবি করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর আ স ম ফিরোজ উল হাসান বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ প্রশাসনিক বডি সিন্ডিকেটে সিদ্ধান্ত হয়েছে হল ছাড়ার ও ক্যাম্পাস বন্ধের।’

‘এখন কেউ এ নির্দেশ না মেনে হলে থাকলে ও মিছিল-সমাবেশ করলে তা তো অবৈধ ও আইনের লঙ্ঘন। তারপরও তারা যেহেতু আমাদের শিক্ষার্থী তাই আমি তাদের সবাইকে আহ্বান করব আইন মেনে  চলতে।’

যারা হল বন্ধের সিদ্ধান্ত প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়েছেন তাদের হলে থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে প্রক্টর বলেন, ‘সাধারণ প্রক্রিয়ায় হল না ছাড়লে আমাদের পুলিশ ও আইনের সহায়তা নিতে হবে। কিন্তু আমরা আশা করব তা না করেই সবাই হল ছেড়ে যাবে।’

হল না ছাড়লে পুলিশে ব্যবস্থার হুঁশিয়ারি

এদিকে হলগুলো থেকে শিক্ষার্থীদের বের করতে বুধবার সাড়ে ৩টার পর্যন্ত সময় বেঁধে দেয় কর্তৃপক্ষ। এরপর প্রয়োজনে পুলিশ ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। দুপুরে আন্দোলনকারীদের বিক্ষোভ চলাকালীন প্রভোস্ট কমিটির সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়।

প্রভোস্ট কমিটির সভাপতি শেখ হাসিনা হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক বশির আহমেদ বলেন, ‘সাড়ে ৩টার মধ্যে শিক্ষার্থীদের হল ছাড়তে হবে। তারপর তাদের হল থেকে বের করে দিতে প্রয়োজনে পুলিশের সহযোগিতা নেওয়া হবে।’

সাড়ে তিনটার মধ্যে হল ছাড়ার নির্দেশ দিলে আতঙ্ক দেখা দেয় শিক্ষার্থীদের মধ্যে। ফলে বেশ কিছু শিক্ষার্থীকে হল ছেড়ে যেতে দেখা গেছে। তবে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের অনেকেই প্রশাসনের হুঁশিয়ারি উপেক্ষা করে হল ছাড়েননি। বিকালের পর হলের গেটে তালা লাগিয়ে দেয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। একই সঙ্গে হল সংলগ্ন খাবার দোকানও বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।

সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি) বাইরে অবস্থানরত কোনো শিক্ষার্থী ক্যাম্পাসে এসে সভা-সমাবেশ, মিছিল কিংবা কোনো অফিস বা আবাসিক এলাকায় অবস্থান করতে পারবেন না।

বুধবার রাত আটটার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ কার্যালয় থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এই তথ্য জানানো হয়।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গত ৫ নভেম্বর অনুষ্ঠিত সিন্ডিকেটের জরুরি সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ৬ নভেম্বর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ক্লাস ও পরীক্ষা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়। ইতিমধ্যে শিক্ষার্থীরা আবাসিক হলগুলো ত্যাগ করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরের দোকানপাটও বন্ধ করা হয়েছে। তাই এই সময়ে ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরে কোনো শিক্ষার্থীর অবস্থান সমীচীন নয়।

যেকোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা রোধ এবং সার্বিক নিরাপত্তার স্বার্থে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের বাইরে অবস্থানরত কোনো শিক্ষার্থী ক্যাম্পাসে এসে সভা-সমাবেশ, মিছিল কিংবা কোনো অফিস বা আবাসিক এলাকায় অবস্থান না করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

জাবির উপাচার্য ফারজানা ইসলামের পদত্যাগ দাবিতে এক সপ্তাহ ক্যাম্পাস অচল করে রাখার পর ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে জাহাঙ্গীরনগর’ ব্যানারে আন্দোলনে নামা শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা গত সোমবার রাতে উপাচার্যের বাড়ি ঘেরাও করেন। পরের দিন দুপুরে ছাত্রলীগের একদল নেতাকর্মী আন্দোলনকারীদের ওপর চড়াও হয়। হামলায় আট শিক্ষকসহ অন্তত ৩০ জন আহত হন। এঘটনার পর থেকে জাবির সংকট আরও বেড়েছে।

(ঢাকাটাইমস/০৬নভেম্বর/মোআ/জেবি)