মায়ের বুকে খোকার শেষ নিদ্রা

প্রকাশ | ০৭ নভেম্বর ২০১৯, ১৯:০৬ | আপডেট: ০৭ নভেম্বর ২০১৯, ২০:১৫

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকাটাইমস

তরুণ বয়সে দেশ মাতৃকার জন্য লড়াই করেছেন পাক হানাদারদের বিরুদ্ধে। ছিলেন গেরিলা যোদ্ধা। রাজনৈতিক জীবনেও ছিলেন সফল। একাধিকবারের সংসদ সদস্য। ছিলেন দুইদফা মন্ত্রিপরিষদের সদস্য। অবিভক্ত ঢাকার সবশেষ মেয়র। বিএনপির প্রভাবশালী নেতা সাদেক হোসেন খোকার জীবনের শেষ কটি বছর গেছে ক্যান্সারের সঙ্গে লড়াই করে। এই বীর যোদ্ধা প্রায় পাঁচবছর চিকিৎসাধীন ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রে।

গত সোমবার নিউ ইয়র্কের ম্যানহাটনের মেমোরিয়াল স্লোয়ান ক্যাটারিং ক্যান্সার সেন্টারে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সোমবার মারা যান বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান খোকা। বয়স হয়েছিল ৬৭ বছর। ওইদিন নিউ ইয়র্কে কুইন্সের জ্যামাইকা মুসলিম সেন্টারে খোকার প্রথম জানাজা হয়।

পাসপোর্ট না থাকায় ট্রাভেল ডকুমেন্ট নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র থেকে গতকাল সকালে কফিনবন্দি হয়ে দেশে ফেরেন খোকা। বৃহস্পতিবার সকাল থেকে কয়েকদফা জানাজা আর শহীদ মিনারে সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধাজ্ঞাপন শেষে তার ইচ্ছামতো জুরাইনে মায়ের কবরে সমাহিত করা হয়।

এর আগে সকাল সাড়ে আটটার দিকে খোকার মরদেহ বাংলাদেশে পৌঁছায়। বিএনপি নেতা মির্জা আব্বাসসহ দলের শীর্ষ নেতারা তা গ্রহণ করেন। পরে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় সংসদে। দক্ষিণ প্লাজায় তার জানাজা হয়। এতে আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা তোফায়েল আহমেদ, সাবেক রাষ্ট্রপতি বদরুদ্দোজা চৌধুরী, জাতীয় পার্টি, বিএনপি, ওয়ার্কার্স পার্টি, এলডিপির শীর্ষ নেতৃবৃন্দ, ও সংসদ সচিবালয়ের কর্মকর্তারা-কর্মচারীরা অংশ নেন।

জানাজার আগে সংক্ষিপ্ত বক্তব্যের খোকার বড় ছেলে ইশরাক হোসেন বাবার জন্য সবার কাছে দোয়া চান। পাসপোর্ট না থাকায় জীবিত অবস্থায় তার বাবা দেশে ফেরতে না পারার আক্ষেপ নিয়ে মারা গেছেন বলেও দাবি করেন তিনি। তবে দেশে আনার ক্ষেত্রে সরকারকে সহযোগিতা করার জন্য ধন্যবাদ জানান ইশরাক।

শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা

সংসদ ভবন থেকে তার মরদেহ নিয়ে আসা হয় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। সেখানে ১২টা থেকে ১টা পর্যন্ত তার মরদেহ রাখা হয়। সেখানে রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের পাশাপাশি অনেকে ব্যক্তিগতভাবে তার কফিনে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। সংগঠনগুলোর মধ্যে সিপিবি, গণফোরাম, এলডিপি, মনোবিজ্ঞান অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন, জাগপা, জাতীয়তাবাদী মহিলা দল, তাঁতী দল, নাগরিক ঐক্য, বাংলাদেশ জাসদ, বাসদ, জাতীয় হিন্দু মহাজোট, ঋষিজ শিল্পীগোষ্ঠী, ছাত্র ইউনিয়ন, গণসংহতি আন্দোলন, জাতীয়তাবাদী মুক্তিযোদ্ধা দল ও বাংলাদেশ যুব সমিতির নেতারা শ্রদ্ধা জানিয়েছেন।

সেখানে খোকাপুত্র অভিযোগ করে বলেন, তার বাবা রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার। আজকে আমরা ভুক্তভোগী। আমার বাবা রাজনীতির প্রতিহিংসার শিকার হয়েছে। গত পাঁচ বছরে আমি বাবার সঙ্গে অনেক সময় কাটিয়েছি। তার থেকে আমি অনেক কিছু শিখতে পেরেছি।’ বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে আলাপ আলোচনা করে রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান করতে প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আহ্বান জানান ইশরাক।

নয়াপল্টনে নেতাকর্মীদের শেষ শ্রদ্ধা

এরপর শেষবারের মত নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে নিয়ে যাওয়া হয় খোকার মরদেহ। বাদ জোহর জানাজা শেষে তার কফিনে শ্রদ্ধা জানান বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মী।  খোকার মরদেহ আনার আগে থেকে বুকে কালো ব্যাজ পড়ে জানাজায় শরিক হতে হাজার হাজার নেতাকর্মী নয়াপল্টন আসতে থাকেন। জানাজা পড়ান ওলামা দলের শাহ নেসারুল হক।

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, ভাইস চেয়ারম্যান শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, আবদুল্লাহ আল নোমান, চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফ, আলতাফ হোসেন চৌধুরীসহ দলের শীর্ষ নেতারা এবং বিএনপি জোটের শরিক দলের শীর্ষ  নেতারা জানাজায় অংশ নেন।

পরে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নগর ভবনে নেয়া হয় খোকার মরদেহ। সেখানে জানাজাও অনুষ্ঠিত হয়। মেয়র সাঈদ খোকনসহ সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তা, কর্মচারীরা এতে অংশ নেন। এরপর বাদ আসর ধুপখোলা মাঠে তার জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এরআগে গোপীবাগের বাসায় মরহুমের কফিন কিছুক্ষণ রাখা হয়। পরে জুরাইন কবরস্থানে মা সালেহা খাতুনের কবরে চীরনিন্দ্রায় শায়িত করা হয় গেরিলা থেকে জননেতা খোকাকে।

দাফনের আগে গার্ড অব অনার

খোকার মরদেহ কবরে নামানোর আগে ক্র্যাক প্ল্যাটুনের এই গেরিলা কমান্ডারকে পুলিশের ১৭ সদস্যের একটি চৌকস দল ঢাকা জেলা প্রশাসনের সহকারী কমিশনার আবদুল আউয়ালের নেতৃত্বে রাষ্ট্রীয় সালাম জানায়। তারা এই মুক্তিযোদ্ধাকে গার্ড অব অনার প্রদান করে। রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষ থেকে আবদুল্লাহ আল নোমানের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধা স্যালুট জানানো হয় সাদেক হোসেন খোকাকে। এসময় পুলিশের এডিসি নাজমুন নাহারসহ উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

মুক্তিযোদ্ধা খোকা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বাধীন ন্যাপ থেকে বিএনপিতে এসেছিলেন শুরুতেই। ব্রাদার্স ইউনিয়নের সূত্রে বিএনপির ঢাকা মহানগরের সাবেক সভাপতি খোকার ক্রীড়া সংগঠক হিসেবেও পরিচিত রয়েছে।

খোকা অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের নির্বাচিত মেয়র এবং ঢাকার সূত্রাপুর-কোতোয়ালি আসন থেকে চারবার সংসদে গিয়েছিলেন। ২০১৪ সালের ১৪ মে চিকিৎসার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার পর তার বিরুদ্ধে দেশে কয়েকটি দুর্নীতি মামলা হয় এবং কয়েকটিতে সাজাও দেয় আদালত।

(ঢাকাটাইমস/০৭নভেম্বর/বিইউ)