প্রকৃতির কোলে দেশের বৃহত্তম বোর্ডিং স্কুল

প্রকাশ | ০৭ নভেম্বর ২০১৯, ১৯:৩৪ | আপডেট: ০৭ নভেম্বর ২০১৯, ১৯:৪৭

তানিয়া আক্তার, জাফলং থেকে ফিরে

লোকালয় থেকে দূরে প্রকৃতির কোলে গড়ে ওঠেছে এক পাঠশালা। এর একপাশে ভারতের মেঘালয় রাজ্য অপরপাশে সিলেটের জাফলং। জীবন ও জগতকে প্রকৃতির কাছ থেকেও জেনে নেয় এই পাঠশালার বিদ্যার্থীরা। বিখ্যাত দার্শনিক জাঁ জ্যাক রুশোও তার ‘এমিলি’ বইয়ে প্রকৃতির মাঝে শিশুর পড়ালেখার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন।

প্রকৃতিকন্যা সিলেটের জৈন্তা উপজেলার শ্রীপুরে গড়ে তোলা এই বাতিঘরটির নাম ‘জাফলং ভ্যালি বোর্ডিং স্কুল’। শতভাগ আবাসিক সুবিধা নিয়ে দেড়শ একরজুড়ে গড়া এই বিদ্যাপীঠই দেশের প্রথম ও বৃহত্তম বোর্ডিং স্কুল। 

পাহাড়ের গাঁ বেয়ে উঠতেই চোখে পড়ে চূড়ায় চূড়ায় গড়ে তোলা একাডেমিক আর আবাসিক ভবনগুলো। প্রতিষ্ঠানটির ভেতরেও রয়েছে ছোট-বড় আটটি টিলা। আর টিলার ভাঁজে ভাঁজে রয়েছে চা বাগান। শিক্ষার্থীর পাশাপাশি শিক্ষকদের জন্যও রয়েছে আবাসিক ভবন।

ভিন্নধর্মী এই প্রতিষ্ঠানটির যাত্রা খুব বেশি দিন হয়নি। সম্প্রতি প্রতিষ্ঠার এক বছর পেরিয়েছে।শুধু ছাত্রদের পড়ালেখার সুযোগ রয়েছে সিলেট-তামাবিল মহাসড়কের পাশের এই প্রতিষ্ঠানটিতে।

ইংরেজি মাধ্যমেই সাধারণ বোডিং স্কুলে পড়ানো হলেও এখানে ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত  জাতীয় কারিকুলামের অধীনে ইংলিশ ভার্সনে পড়ালেখার সুযোগ রয়েছে। সম্পূর্ণ আবাসিক এই প্রতিষ্ঠানে বর্তমানে ১২০ জন ছাত্র রয়েছে। তবে প্রায় ৯৫০ জন শিক্ষার্থীর আবাসন সুবিধা রয়েছে। আর শিক্ষক  রয়েছেন ২১ জন। এছাড়া প্রিন্সিপালসহ তিনজন বিদেশি শিক্ষকও রয়েছেন।

অপার সৌন্দর্যে ঘেরা ভবনগুলো ৬৫টি ক্লাসরুম ও চারটি অত্যাধুনিক গবেষণাগারে সমৃদ্ধ। ভবনটির যেকোনো কাচের জানালার দিকে তাকালেই চোখে পড়ে বহু নান্দনিক দৃশ্য।

এছাড়াও ছয়টি খেলার মাঠ, তিনটি হোস্টেল ব্লক, ইনডোর গেমসের ব্যবস্থা, স্টাফ কোয়ার্টার, মসজিদসহ নানা স্থাপনায় সাজানো এই প্রতিষ্ঠানের বিদ্যার্থীদের পাঠগ্রহণের পাশাপাশি মানসিক সমৃদ্ধিও ঘটছে। 

ভিন্নধারার এই প্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠা করেছেন বেশ কয়েকজন শিক্ষানুরাগী। তারা স্বপ্ন দেখেন শিগগির প্রতিষ্ঠানটি গুণে-মানে হবে আন্তর্জাতিক।

তাদেরই স্বপ্ন পূরণে সারথী প্রতিষ্ঠানটির অধ্যক্ষ ব্রিজ কিশোর ভারদ্বাজ। দেশের সূর্য সন্তানদের দেশেই রাখার প্রবল ইচ্ছার কথা জানান তিনি।

অধ্যক্ষ বলেন, ‘দেশ থেকে প্রতিবছরই প্রায় তিন হাজার শিক্ষার্থী দেশের বাইরে বিভিন্ন বোর্ডিং স্কুলে পড়তে যায়। বিশেষ করে দার্জিলিংয়েই বেশি যায়। আমাদের লক্ষ্য ওইসব শিক্ষার্থীকে ধরে রাখা।’

তিনি বিশ্বাস করেন প্রতিষ্ঠানটির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, নান্দনিক স্থাপনা আর প্রয়োজনীয় সুবিধার দৃশ্যগুলো একবার দেখলে যেকোনো অভিভাবকের হৃদয়ে তা রেখাপাত করবে। সন্তানের নিশ্চিত ভবিষ্যতের জন্য এই বোর্ডিং স্কুলকেই বেছে নেবেন তারা।

মধ্যবিত্তের সাধ্যের সঙ্গে সমন্বয় করেই পড়ালেখার খরচ রেখে মানসম্মত শিক্ষাদানে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ এই অধ্যক্ষ। বলেন, ‘বিদ্যালয়টিতে মানসম্মত শিক্ষা প্রদানের পাশাপাশি পড়ালেখার খরচটাও মধ্যবিত্তের নাগালে রাখা হয়েছে। টিউশন ফি, স্পেশাল ক্লাস, হোস্টেল, লন্ড্রিসহ সব খরচ মিলিয়ে একজন শিক্ষার্থীর মাসে খরচ মাত্র ২০ হাজার টাকা। আর বছরে সেশন ফি ৬০ হাজার টাকা।’

শিশু বয়স থেকেই যেন সময়জ্ঞান নিয়ে বড় হয় সেই প্রশিক্ষণও দেয়া হয় সেখানে। এছাড়া শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় পুষ্টিকর খাবার, সকালের ব্যায়ামের পাশাপাশি খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক চর্চার পর্যাপ্ত সুযোগ রয়েছে বলেও জানান তিনি।

শিক্ষকদের দক্ষতা বাড়াতে হাফিজ মজুমদার ট্রাস্টের রিসোর্স সেন্টারে তাদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় বলেও জানা যায়।

এই স্কুল কম্পাউন্ডে একদিন ও এক রাত অবস্থানকালে শিক্ষার্থীদের পড়ালেখা, থাকা, খাওয়া, খেলাধুলাসহ সবকিছুই গভীরভাবে দেখার সুযোগ হয়।

শিক্ষার্থীদের ১ নম্বর ডরমেটরি ভবনের ১০৩ নম্বর রুমের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী শাহীদুল ইসলাম মাহবুবের সঙ্গে কথা হয়। সে জানায়, ‘এখানে ভর্তির আগে যখন পড়ার কোনো একটি বিষয় বুঝতাম না সেটি পরদিনের কোচিংয়ের জন্য ফেলে রাখতে হতো। কিন্তু এখন স্কুল, স্পেশাল কোচিংয়ের বাইরেও সব সময়ের জন্য শিক্ষক পাচ্ছি আর প্রকৃতির সান্নিধ্য তো আছেই।’

সপ্তম শ্রেণি পড়ুয়া ওয়াসিফ আলী ঢাকার উত্তরা থেকে পড়তে গিয়েছে। ১০১ নম্বর রুমে থাকে। তার ভাষায়, ‘আমরা একেক রুমে চার থেকে পাঁচজন থাকি।সবার জন্যই স্বতন্ত্র খাট, টেবিল ও প্রয়োজনী আসবাব রয়েছে। এছাড়া বাড়িতে কথা বলতে চাইলে সেই সুযোগও পাওয়া যায়।’

১ নম্বর ডরমেটরি আবার পদ্মা, মেঘনা, সুরমা ও কুশিয়ারা চার ভাগে বিভক্ত। কুশিয়ারার হাউজ মাস্টার এমরান হোসেনের সঙ্গে আলাপকালে তিনি ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের যেকোনো সমস্যায় আমরা সাড়া দিই। কারণ ৩০ জন শিক্ষার্থীর পুরো দায়িত্ব আমার। আর স্কুলটির নিয়ম-কানুন ও ব্যবস্থাগত পদ্ধতি এতটাই উন্নত যে, শিক্ষার্থীদের পড়ালেখা নিয়ে নিজেকে ভাবতে হয় না। নিয়মের মধ্য থেকেই সে প্রস্তুত হয়ে ওঠে।’

(ঢাকাটাইমস/০৭নভেম্বর/টিএ/জেবি)