তারক সাহা বিহীন বিউটি বোর্ডিং

প্রকাশ | ১২ নভেম্বর ২০১৯, ১৬:৩৫ | আপডেট: ১২ নভেম্বর ২০১৯, ১৬:৫০

এম. সুমন হোসেন

বিউটি বোর্ডিংয়ে আজও ভোর, দুপুর, সন্ধ্যা হয়। দর্শনার্থী ও ভোজন-রসিক মানুষ এখনো এখানে এসে ভিড় জমায়। কিন্তু তারা ক্যাশ কাউন্টারে দেখতে পায় না তাদের প্রিয় মুখ বিউটি বোর্ডিংয়ের কর্ণধার তারক সাহাকে। বোর্ডিংয়ের অতীত ইতিহাসের ধারক-বাহক তারক সাহার মুখে আর কোনোদিন শোনা যাবে না এই বোর্ডিংকেন্দ্রিক গড়ে ওঠা বাংলা সাহিত্য, শিল্প, চলচ্চিত্রের কথা। জসীম উদদীন, শামসুল হক, শামসুর রাহমান, শহীদ কাদেরীদের গল্প বলতে গিয়ে আর কোনোদিন তার গলা ভারী হয়ে উঠবে না। সারা জীবন এই বোর্ডিংয়ের ইতিহাস-ঐতিহ্যের ধারা আগলে রাখা তারক সাহা গত ১১ সেপ্টেম্বর হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে না ফেরার দেশে চলে গেছেন। 

তারক সাহার বড় ভাই সমর সাহা জানান, ১৯৪৯ সালে ১১ কাঠা জমি নিয়ে গড়ে ওঠা এই বিউটি বোর্ডিংটি ছিল বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতির গুণী মানুষদের আড্ডার প্রাণকেন্দ্র। সমমনাদের নির্জলা আড্ডা চলত দিনরাত। পঞ্চাশ, ষাট আর সত্তরের দশক ছিল বিউটি বোর্ডিংয়ের যৌবনকাল। আড্ডা দিতে আসতেন সে সময়ের প্রথিতযশা সাহিত্যিক, সাংবাদিক, চলচ্চিত্রকার, রাজনৈতিক ব্যক্তিরা। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে এই ঐতিহাসিক স্থানে এসেছিলেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু ও পল্লীকবি জসীম উদদীন। এসেছিলেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তখন এখানে আড্ডা দিতেন হাসান হাফিজুর রহমান, শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী, ফজলে লোহানী, কবি নির্মলেন্দু গুণ, কলাম লেখক আবদুল গাফফার চৌধুরী, ভাস্কর নিতুন কু-ু, কবি আল মাহমুদ, শহীদ কাদরী, রণেশ দাসগুপ্ত, ব্রজেন দাস, মহাদেব সাহা, আহমদ ছফা, হায়াৎ মামুদ, জহির রায়হান, খান আতিউর রহমান, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, বেলাল চৌধুরী, আনিসুজ্জামান, খান আতাউর, ফয়েজ আহমদ প্রমুখ। ঐতিহাসিক বিউটি বোর্ডিংয়ে থেকেছেন জাদুশিল্পী জুয়েল আইচ। রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে গাজীউল হক, কমরেড আবদুল মতিন, অলি আহাদ, সাইফুদ্দিন মানিক প্রমুখ আড্ডা দিতেন।

এখান থেকেই ১৯৫৬ সালে প্রকাশিত হয় কবিতাপত্র ‘কবি কণ্ঠ’। আহমদ ছফার সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ‘স্বদেশ’সহ আরো বেশ কয়েকটি সাহিত্য সাময়িকী। কবি সৈয়দ শামসুল হকের লেখালেখি করার জন্য একটা নির্দিষ্ট টেবিল-চেয়ার ছিল বিউটি বোর্ডিংয়ে। এখানে বসেই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য সবাক চলচ্চিত্র ‘মুখ ও মুখোশ’ নির্মাণের পরিকল্পনা করেছিলেন পরিচালক আবদুল জব্বার খান। সমর দাস অনেক বিখ্যাত গানের কথায় সুর বসিয়েছেন এখানে আড্ডা দেওয়ার ফাঁকে।

মাঝে ভাটা পড়ে ১৯৭১ সালের মার্চে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী জেনে যায় বাঙালির এই সাহিত্য-সংস্কৃতির মানুষদের মিলনমেলার কথা। ২৮ মার্চ ১৯৭১ এখানেই শহীদ হন বিউটি বোর্ডিংয়ের কর্ণধার তার বাবা প্রহ্লাদ সাহাসহ ১৭ জন। তারপর তার মা বাধ্য হন ভারতে চলে যেতে। ১৯৭২ সালে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হয়ে এলে দুই ছেলে তারক ও সমরকে নিয়ে ফিরে আসেন তার মা প্রতিভা সাহা। দুই ভাইয়ের মধ্যে ছোট তারক সাহাই বিউটি বোর্ডিংয়ের হাল ধরেন। তিনিই মূলত বোর্ডিংয়ের দেখাশোনা ও সব দায়িত্ব পালন করতেন। এই বোর্ডিংয়ের সঙ্গে তার আত্মার সম্পর্ক ছিল। তারক সাহা সন্তানের মতো ভালোবেসে পরিচালনা করতেন এই বোর্ডিং। তার অকালে মৃত্যুর কারণে এখন সব দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে সমর সাহাকে।

সমর সাহা আরো বলেন, এখন বিউটি বোর্ডিং আগের মতো জমে না। বিখ্যাত ব্যক্তিত্বদের আড্ডা বা পদচারণা অনেক কম। লেখকরা আসেন না, কারণ পুরান ঢাকার যানজট। তাছাড়া লেখকরা প্রায় সবাই নতুন ঢাকায় বসবাস করেন। যারা আশপাশে থাকেন তারা আসেন। জীবিতদের মধ্যে বুলবুল চৌধুরী নিয়মিত আসেন। দর্শনার্থীরা প্রতিনিয়তই আসে ঐতিহাসিক এ স্থানকে দেখতে। সবচেয়ে বেশি আসে ভোজনরসিক মানুষ। এখন দুপুরের খাবারে থাকে খিচুড়ি, মুরগির মাংস, খাসির মাংস, সবজি, বড়া, চচ্চড়ি, পোলাও, মুড়িঘণ্ট। এছাড়া বাইলা, কাতলা, রুই, তেলাপিয়া, চিতল, পাবদা, ফলি, সরপুঁটি, শিং, কই, মাগুর, ভাংনা, চিংড়ি, চান্দা, আইড়, বোয়াল, কোড়ালসহ প্রায় সব ধরনের মাছ থাকে। বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো, বছরের যেকোনো দিন সরষে ইলিশ পাওয়া যায়। আর রাতে থাকার জন্য এখন ২৬টি কক্ষ রয়েছে।

বিউটি বোর্ডিং নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা জানাতে গিয়ে সমর সাহা বলেন, আমার বাবা ও ভাইয়ের স্মৃতিবিজড়িত এবং বাংলাসাহিত্য বিকাশের আতুর ঘর বিউটি বোর্ডিংয়ের ঐতিহ্য অম্লান রাখতে আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাব। জানি না আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম কী করবে। ‘একাত্তরে আমার বাবাসহ যারা শহীদ হয়েছেন তাদের স্মৃতি রক্ষার্থে ম্যুরাল, তারক সাহার প্রতিকৃতি, পাঠাগার এবং একটি সংগ্রহশালা করতে চাইÑ যাতে তাদের কিছু স্মৃতি ধরে রাখতে পারি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য।

(ঢাকাটাইমস/১২নভেম্বর/এজেড)