সংসদে রাঙ্গাকে তুলোধুনো
নব্বইয়ে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে শহীদ নূর হোসেনকে নিয়ে কটূক্তি করায় জাতীয় পার্টির মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙ্গাকে শুধু বক্তব্য প্রত্যাহারই নয় জাতির কাছে ক্ষমা চাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন সরকারি দলের প্রবীণ সংসদ সদস্যরা।
তারা আজ মঙ্গলবার সংসদ অধিবেশনে রাঙ্গার কড়া সমালোচনা করে এই আহ্বান জানান।
গত রবিবার দলীয় এক অনুষ্ঠানে শহীদ নূর হোসেনকে ‘ইয়াবাখোর, ‘ফেনসিডিলখোর’ বলে আখ্যায়িত করেন মসিউর রহমান রাঙ্গা। এ সময় প্রয়াত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ যে স্বৈরাচার নন এ ব্যাপারে বিভিন্ন যুক্তি ও উদাহরণ দিতে গিয়ে রাঙ্গা একপর্যায়ে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াকেও ‘স্বৈরাচার’ বলে আখ্যায়িত করেন।
রাঙ্গার বক্তব্যটি ভাইরাল হলে এ ব্যাপারে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়। নূর হোসেনের পরিবার তার বিচার দাবিতে রাস্তায় নামে। আজ দুপুরে রাঙ্গা তার বক্তব্য প্রত্যাহার করে নূর হোসেনের মায়ের কাছে ক্ষমাও চান।
সন্ধ্যায় সংসদ অধিবেশনে পয়েন্ট অব অর্ডারে দাঁড়িয়ে প্রথমে প্রসঙ্গটি সামনে আনেন সরকারি দলের সদস্য তাহজীব আলম সিদ্দীকি। তিনি বলেন, ‘নূর হোসেন দিবসে বঙ্গবন্ধু, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং শহীদ নূর হোসেনকে নিয়ে কটূক্তিপূর্ণ বক্তব্য দিয়েছেন জাপা মহাসচিব ও সংসদের বিরোধী দলের চিফ হুইপ মশিউর রহমান রাঙ্গা। নূর হোসেনকে হত্যার পর সারাদেশের আনাচে-কানাচে স্বৈরারাচারবিরোধী আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে এবং হাজারো নূর হোসেনের জন্ম হয়। সেই নূর হোসেনকে নিয়ে অপমানজনক বক্তব্যের প্রতিকার চাই।’
তাহজীব বলেন, ‘তিনি (রাঙ্গা) বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কটূক্তি করেছেন, প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে কটূক্তি করেছেন। তার এই বক্তব্য প্রত্যাহার করতে হবে। একই সঙ্গে তাকে নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়ে ভবিষ্যতে এই ধরনের কাজ থেকে বিরত থাকার প্রতিশ্রুতিও দিতে হবে।’
এরপর ফ্লোর নেন প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা তোফায়েল আহমেদ। তিনি বলেন, ‘রাঙ্গা এমন একটি বক্তব্য দিয়েছেন, যেটাতে বাংলার মানুষের হৃদয়ে আঘাত লেগেছে। নূর হোসেন হত্যার ঘটনার পর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন বেগবান হয় এবং মানুষ স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। আমি অবাক হলাম রাঙ্গা বঙ্গবন্ধু, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং নূর হোসেনের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। অথচ রাঙ্গা ভুলে গেছেন এরশাদও নূর হোসেনের বাড়িতে গিয়ে তার মা-বাবার কাছে ক্ষমা চেয়েছিল, সংসদে ক্ষমা চেয়েছিল। রাঙ্গা তাকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেছে। তার এই বক্তব্যের ধিক্কার জানাই।’
তোফায়েল বলেন, ‘রাঙ্গা খুবই খারাপ বক্তব্য দিয়েছেন। আমি তার বক্তব্যে ঘৃণা প্রকাশ করি। সবাই এখন স্বৈরাচারী এরশাদ বলছে। একজন সুস্থ মানুষ, তিনি যদি স্বাভাবিক থাকেন তার পক্ষে বঙ্গবন্ধু, প্রধানমন্ত্রী ও নূর হোসেনকে নিয়ে এই বক্তব্য দেওয়া সম্ভব না।’
এরপর ফ্লোর নেন আওয়ামী লীগের আরেক প্রবীণ নেতা আমির হোসেন আমু। তিনি বলেন, ‘শাক দিয়ে মাছ ঢাকা যায় না। রাঙ্গা সেই চেষ্টা করেছেন। নূর হোসেন যখন হত্যা হয়, তখন দেশে ফেনসিডিল-ইয়াবা ছিল না। ভোট ডাকাতি, মিডিয়া ক্যু’র কথা বলা হয়। এই ভোট ডাকাতি-মিডিয়া ক্যু’র মূলহোতা ছিল এরশাদ। আজ সেটাকে ঢাকার জন্য রাঙ্গা এত বড় দুঃসাহস দেখাতে পারে না। এরশাদের সময় রাজনৈতিক নেতাদেরকে নির্যাতন ও পৈশাচিকভাবে হত্যা করা হয়েছে। এরশাদকে শুধু আওয়ামী লীগ স্বৈরাচার বলে না, সারাদেশের মানুষ তাকে স্বৈরাচার বলে অভিহিত করেছে। বিশ্বে স্বৈরাচার বলে পরিচিতি পেয়েছে। রাঙ্গাকে অবশ্যই তার বক্তব্যের জন্য ক্ষমা চাইতে হবে।’
এরপর এ ব্যাপারে কথা বলেন গণফোরাম নেতা সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমেদ। তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু, প্রধানমন্ত্রী, নূর হোসেনকে নিয়ে কটাক্ষ করে কথা বলেছেন রাঙ্গা। কথায় আছে, রতনে রতন চেনে। আমি বাকি কথাটা আর বললাম না। যে নূর হোসেনকে সামনে রেখে আমরা আন্দোলন করেছি। তাকে তিনি কটাক্ষ করেছেন। এটা করে তিনি সংসদকে অপমান করেছেন। কারণ স্বৈরাচারের পতন না হলে তিনি সংসদে এসে বসতে পারতেন না। একথা বলে তিনি প্রমাণ করেছেন, স্বৈরাচার, দালালদের চরিত্র পরিবর্তন হয় না। এর জন্য তাকে ক্ষমা চাইতে হবে।’
এরপর আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম বলেন, ‘রাঙ্গা যে কথা বলেছেন, এটা কোনো সুস্থ মানুষ বলতে পারে না। বঙ্গবন্ধু সর্ম্পকে কথা বলার আগে তার চিন্তা করা দরকার ছিল। রাঙ্গার এই বক্তব্য গণতন্ত্রের ওপর আঘাত করেছে। তাকে শুধু ক্ষমা চাইলেই হবে না, জাতীয় পার্টিতে তার এই বক্তব্যের ক্লারিফিকেশন দিতে হবে।’
রাঙ্গার বক্তব্য নিয়ে জাতীয় পার্টির পক্ষ থেকে আলোচনায় অংশ নেন কাজী ফিরোজ রশিদ ও মুজিবুল হক চুন্নু প্রমুখ। তারাও রাঙ্গার সমালোচনা করেন। ফিরোজ রশিদ দাবি করেন, এই বক্তব্য রাঙ্গার ব্যক্তিগত, জাতীয় পার্টির বক্তব্য নয়।
(ঢাকাটাইমস/১২নভেম্বর/জেবি)