বিদেশি কোম্পানিগুলো কেন বাংলাদেশে ব্যবসা বন্ধ করে দিচ্ছে

প্রকাশ | ১৩ নভেম্বর ২০১৯, ১০:২৯ | আপডেট: ১৪ নভেম্বর ২০১৯, ১১:৪৯

আবু আহমেদ
আবু আহমেদ

কিছু বিদেশি কোম্পানি বাংলাদেশে তাদের ব্যবসা বন্ধ করে দিচ্ছে, যখন বাংলাদেশ চারদিকে বুলন্দ আওয়াজে বলছে বিদেশি বিনিয়োগের জন্য বাংলাদেশ হলো পরবর্তী গন্তব্যস্থল। কেন পুরনো বিদেশি কোম্পানিগুলো ব্যবসা বন্ধ করে দিচ্ছে সে ব্যাপারে সর্বোত্তম হতো তাদের থেকে শোনা। কিন্তু আমরা কি তাদের থেকে শুনছি? কোনো ব্যবসাই বন্ধ হতে পারে না ব্যবসা যতক্ষণ পর্যন্ত লাভ করে।

গ্লাক্সোস্মিথক্লাইনের (জিএসকে) ক্ষেত্রে যেটা হয়েছে, তা হলো তারা ফার্মা বা ওষুধ বিক্রির ক্ষেত্রে স্থানীয় কোম্পানিগুলোর সঙ্গে টিকে উঠছিল না। তাহলে প্রশ্ন জাগে স্থানীয় ফার্মা কোম্পানিগুলোর হাতে কী এমন ম্যাজিক পাওয়ার ছিল, যা জিএসকের হাতে ছিল না! অথবা স্থানীয় ওষুধ কোম্পানিগুলোর পণ্য কি এতই উত্কৃষ্ট ছিল যে জিএসকে প্রতিযোগিতার বাজারে নিজেদের ওষুধগুলো বিক্রি করতে সক্ষম হচ্ছিল না! আসল ব্যাপার ছিল অন্য জায়গায়।

স্থানীয় ওষুধ কোম্পানিগুলো যে অনৈতিক চর্চা করে তাদের ওষুধকে বাজারজাতকরণের ক্ষেত্রে, জিএসকে সেটা করতে পারত না। কারণ জিএসকে তাদের গ্লোবাল প্র্যাকটিস অনুসরণ করতে গিয়ে কাউকে ঘুষ দিতে পারত না। সবাই বলে এখানে ডাক্তারদের খুশি রাখতে না পারলে সেই কোম্পানির ওষুধ রোগীদের জন্য প্রেসক্রাইব করানো যায় না।

ওষুধ মার্কেটিংয়ের ক্ষেত্রে এক ধরনের দুর্নীতি চলছে, যেটা নিয়ে কেউ উচ্চবাচ্য করে না। ফলে রোগীরা বেশি মূল্যে নিকৃষ্ট ওষুধ সেবন করতে বাধ্য হচ্ছে। দেশে ২৫০ থেকে ৩০০ ফার্মা কোম্পানির ওষুধের বাজার আছে। এসব ওষুধ কোম্পানি সবাই প্রায় একই ওষুধ ভিন্ন ভিন্ন নামে উত্পাদন করছে। আমাদের ওষুধের বাজারে বেশির ভাগ ডাক্তার আছেন, যারা শুধু ট্রেড নেইমের

(Trade names) মাধ্যমে ওষুধ চেনেন। ওষুধের জেনিরিক নেইমস তাঁদের অনেকের কাছে অজানা। আর রোগীরাও ইচ্ছামতো ওষুধ সেবন করতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। অনেকে বলেন, রোগ হলে ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ সেবন করবেন না। কিন্তু বাস্তবতা হলো অনেক রোগীই ওষুধের দোকান থেকে চেয়ে নিজের খুশিমতো ওষুধ কিনছেন।

তাদের কথা হলো, ডাক্তারের কাছে গেলে একই ওষুধ ডাক্তার সাহেবও দেবেন, শুধু তাঁর পছন্দের কোম্পানির। আর দেশে ছোট-বড় এত অসুখ হচ্ছে যে সব সময় যদি ডাক্তার-হাসপাতালে যেতে হয় ওষুধের প্রেসক্রিপশন আনার জন্য, তাহলে তাঁদের প্রতি মাসে মাসেই ডাক্তারের কাছে দৌড়াতে হবে। তাই অনেকে কমন ওষুধগুলো যেমন গ্যাস নিবারণের জন্য, ব্যথা নিবারণের জন্য, হরেক রকম ভিটামিনের জন্য এখন ওষুধের দোকানের ছেলেটিকে বলেন ওই ওষুধ দাও।

বাংলাদেশের লোকেরা অতি ওষুধ সেবন করছে এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। বাস্তবতা হলো তাদের অতি (excessive) ওষুধ খাওয়ানো হচ্ছে। যেদিকেই তাকান শুধু ওষুধের দোকান আর ওষুধের দোকান। আর আমাদের সরকারি-বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজগুলো প্রতিযোগিতা দিয়ে ডাক্তার উত্পাদন করে চলেছে। অনেকেরই বিশ্বাস এসব কলেজের ডাক্তার ভালো ডাক্তার হবে না।

এমনও হতে পারে ডাক্তারি বাজারে বেকারত্ব দেখা দেবে। আনাচে-কানাচে প্রাইভেট হাসপাতাল-ক্লিনিক গড়ে উঠেছে। এগুলোর ব্যবসাই হলো রোগী ধরা। কে এগুলোকে অনুমোদন দিল। তিন রুমের একটা বাসা ভাড়া করে কি কোনো হাসপাতাল হতে পারে! অথচ সবার সামনে এসব প্রতারণার ব্যবসাগুলো চলছে। ভুয়া ডাক্তার-ভুয়া হাসপাতালে দেশ ছেয়ে গেছে।

ডাক্তারি-হাসপাতাল ব্যবসাকে বিশ্বের সর্বত্রই শক্তভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। কিন্তু বাংলাদেশে এই দুই ব্যবসা টোটাল ফ্রি! অবস্থা এমনই দাঁড়িয়েছে যে এখন রোগীরা আর ডাক্তার বিশ্বাস করতে চায় না। রোগী মনে করে ডাক্তার সাহেব শুধু নিজ স্বার্থে তাকে অপ্রয়োজনীয় ওষুধ খাওয়াচ্ছেন।

প্রফেসর নুরুল ইসলাম বলতেন, ভালো ডাক্তার হলেন উনি, যিনি কম ওষুধ রোগীর জন্য লেখেন। এখন কি ওই রকম ডাক্তার আপনি অনেক পাবেন? অন্য দেশে যেসব নষ্ট ল্যাব যন্ত্রপাতি ফেলে দেওয়া হচ্ছে, সেগুলোকে কম মূল্যে এনে অনেকে হাসপাতাল স্থাপন করছেন। এসব যন্ত্রপাতির মান দেখার কেউ নেই।

এই যে প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে কয়েক লাখ রোগী চিকিৎসার জন্য বিদেশে যায়, তাদের কি কেউ জিজ্ঞাসা করছে তারা কেন যাচ্ছে? অধিকাংশ ক্ষেত্রে অবিশ্বাসের কারণে। বিদেশিরা বলে, তোমাদের দেশে কি এই সহজ চিকিৎসাটাও নেই? আছে বটে, তবে অবিশ্বাসটা এত গভীর যে রোগীরা হাসপাতাল-ডাক্তারকে বিশ্বাস করতে পারে না। তাই তো তাদের এত সংখ্যায় বিদেশ গমন।

যে দেশে প্রতি ঘরে ঘরে লোকে কারণে-অকারণে ওষুধ খায়, যে দেশের লোকসংখ্যা ১৭ কোটি, যে দেশের মাথাপিছু আয় বাড়ছে, সেই দেশ থেকে কেন জিএসকের মতো এত বিশ্ববিখ্যাত একটি ওষুধ কোম্পানি ব্যবসা বন্ধ করে দিল? এখন চলে যাচ্ছে ফ্রান্সের সানোফি অ্যাভেনটিজ (Sanofi Aventis)। এই দুটি কোম্পানির কয়েকটি অতি মূল্যবান ওষুধ ছিল যেগুলো তারা বাজারজাত করলেও বাইরে রপ্তানি করত। আমাদের ওষুধের বাজারে অনৈতিক দূষিত দুর্নীতিগ্রস্ত অবস্থায় তারা এই দেশে ওষুধের উত্পাদন বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছে।

ওষুধ খাতকে এবং সেই সঙ্গে হাসপাতাল-ডাক্তারি ব্যবসাকে নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি শক্তিশালী রেগুলেটরি কমিশন থাকা উচিত ছিল, যা বাংলাদেশে নেই। হয়তো কোনো একদিন ওই ধরনের কমিশন স্থাপিত হবে যখন বিশ্বব্যাংকের মতো কোনে বড় ঋণ বিক্রেতা ওই শর্ত দিয়ে বাংলাদেশের কাছে ঋণ বেচবে। এর অর্থ হলো আমরা নিজ থেকে কিছু করি না।

আমরা করার বোধটাও অনুভব করি না যতক্ষণ না পর্যন্ত অনেক ক্ষতি হয়ে যায়। বাংলাদেশে আমরা অর্থ ব্যয় করি না, অর্থের অপচয় করি। এখানে আমরা অনেক লোককে রোগী বানাচ্ছি, যাদের রোগী হওয়ার কথা ছিল না। রোগীরা চিকিৎসা পেতে গিয়ে যে প্রতারণা ও ভুল চিকিৎসার শিকার হচ্ছে সেই বিচার তারা কোথায় দেবে?

একটা স্বাধীন রেগুলেটরি কমিশন থাকলে ওষুধ-ডাক্তার-হাসপাতাল খাতের সব বিষয় জনস্বার্থে প্রেক্ষাপট থেকে দেখত। বিশ্বের অন্য দেশে এই রেগুলেটরি কমিশন অনেক আগেই স্থাপিত হয়েছে। সেসব দেশে কয়েকটি রুম ভাড়া করে কেউ হাসপাতাল স্থাপন করতে পারে না। বিনা লাইসেন্সে কেউ ডাক্তারিও করতে পারে না। রোগীর ক্ষতি হলে এটা প্রতিকারের ব্যবস্থা আছে। ওষুধ কোম্পানিগুলো অল্প মূল্যের দুই নম্বরি ওষুধ তৈরি করতে পারে না।

বাংলাদেশ থেকে বিশ্বের নামি ওষুধ কোম্পানিগুলো আগেই চলে গেছে। গেল বছর চলে গেল ব্রিটিশ-ডাচ্ কোম্পানি গ্লাক্সোস্মিথক্লাইন। আর হালে চলে যাচ্ছে Sanofi Aventis। বড় দুঃখ লাগে। যারা মানসম্পন্ন ওষুধ তৈরি করত, তারা চলে গেল বা যাচ্ছে। আমরা কারণগুলো অন্বেষণ করলাম না। অথচ এই আমরা দেশ-বিদেশে বলে বেড়াচ্ছি যে বিদেশিরা তোমরা বাংলাদেশে এসে বিনিয়োগ করো।

যেটা আমরা জানি না সেটা হলো নতুন বিনিয়োগকারীরা পুরনোদের জিজ্ঞেস করবে তোমরা কেন বাংলাদেশ ত্যাগ করলে। তখন পুরনোদের থেকে শুনে নতুন বিনিয়োগকারীরা কি বাংলাদেশমুখী হবে? এগুলো আমাদের ভাবতে হবে। আমাদের অর্থনীতি থেকে যদি ঘুষ-দুর্নীতি-প্রতারণা এসব না যায় তাহলে লাভ বেশি হলেও বিদেশিরা এই দেশে বিনিয়োগ করতে আসবে না।

আমরা কাগজে-কলমে বিনিয়োগের জন্য অতি উত্তম ক্ষেত্র প্রদান করেছি মনে হবে। বাস্তব অবস্থা ভিন্ন। ভিয়েতনাম ২৮০ বিলিয়নের পণ্য রপ্তানি করে। আর লোকসংখ্যার দিক দিয়ে আমরা ওই দেশ থেকে অনেক বড় হলেও আমাদের অর্জন এ ক্ষেত্রে কত? আমাদের আলো-ঝলমল দিনগুলো সামনে অনুরূপ থাকবে কি না ভেবে দেখতে হবে।

ব্যবসা করার জন্য যদি সমতল ভূমি আমরা না দিতে পারি তাহলে বাংলাদেশ কখনো কাঙ্ক্ষিত বিনিয়োগ পাবে না। আমরা অনেক ক্ষেত্রে এমন ব্যবহার করি, যাতে মনে হবে এই দেশের নীতিনির্ধারণের পেনি ওয়াইজ পাউন্ড ফুলিশ। অল্প ক্ষতি আমাদের নজরে পড়ে। বড় ক্ষতিকে আমরা দেখি না।

লেখক: অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়